অনিয়মের অভিযোগে আ.লীগের ওয়ার্ড সম্মেলন ‘বন্ধের নির্দেশ’
২৩ ডিসেম্বর ২০২১ ১৪:৩০
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ইউনিট সম্মেলন নিয়ে বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড সম্মেলন আপাতত বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। এ কারণে ২৬ ডিসেম্বর থেকে শুরু হতে যাওয়া ওয়ার্ড সম্মেলন স্থগিত করা হয়েছে।
কেন্দ্র সিদ্ধান্ত নিয়েছে, ৮ জানুয়ারি দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভা হবে। সেই সভায় ওয়ার্ড সম্মেলনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
তৃণমূলের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগে দু’টি ধারার সৃষ্টি হয়েছে। নগর কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের বিরোধী হিসেবে পরিচিত ধারার কয়েকজন জ্যেষ্ঠ্য নেতা বুধবার (২২ ডিসেম্বর) ঢাকায় গিয়ে চট্টগ্রাম বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ এবং সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে সমাপ্ত হওয়া ইউনিট সম্মেলন এবং অনুষ্ঠিতব্য ওয়ার্ডের সম্মেলন নিয়ে তাদের আপত্তির কথা তুলে ধরেন। এরপরই কেন্দ্রীয় নেতারা আপাতত ওয়ার্ড সম্মেলন বন্ধ রাখার বিষয়ে নির্দেশনা দেন বলে জানা গেছে।
এর আগে, ১৬ নভেম্বর থেকে চট্টগ্রাম নগরীর ৪৩টি সাংগঠনিক ওয়ার্ডে ইউনিট সম্মেলন শুরু করে নগর আওয়ামী লীগ। প্রতিটি ওয়ার্ডে তিনটি করে ইউনিট আছে। শুরুর দিনই দেওয়ানবাজার ওয়ার্ডের ক-ইউনিটে সম্মেলনে গোলযোগ হয়। প্রয়াত নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও তার অনুসারীদের সদস্য না করা এবং সম্মেলনে আমন্ত্রণ না জানানোর অভিযোগ তুলে স্থানীয় নেতাকর্মীদের বড় অংশের বিক্ষোভের মুখে সেই সম্মেলন স্থগিত করা হয়।
এরপর গত ২৫ নভেম্বর উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডের তিনটি ইউনিটে পাল্টাপাল্টি সম্মেলন করে মহিউদ্দিন ও নাছির অনুসারীরা। সেখানে পাল্টাপাল্টি কমিটি হয়েছে। ১৩ ডিসেম্বর চান্দগাঁও ওয়ার্ডে ইউনিট সম্মেলন করতে গিয়ে বিক্ষোভের মুখে পড়েন নেতারা। নগর কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক নোমান আল মাহমুদসহ কয়েকজন নেতাকে অবরুদ্ধ করে রাখেন মহিউদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা। পরে ক-ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন না করেই নেতারা ফিরে যান। একইভাবে আরও অন্তত ১০টি ইউনিটে সম্মেলন নিয়ে সমস্যা হয়েছে।
মহিউদ্দিনের অনুসারী নেতাদের অভিযোগ, বিভিন্ন ইউনিটে তাদের পক্ষের নেতাকর্মীদের বিভিন্ন কৌশলে সদস্য করা হয়নি। তাদের বাদ দিয়েই সম্মেলন করে এক নেতার অনুসারীদের মাধ্যমে কমিটি করে ফেলা হয়েছে। এছাড়া ওয়ার্ড ও ইউনিট সম্মেলনের আগে সদস্যপদ নবায়ন ও নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্তির জন্য নগর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একটি তথ্য বিবরণী ফরম সরবরাহ করা হয়। সেটি নিয়েও আপত্তি আছে নগর আওয়ামী লীগের নেতাদের।
নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইউনিট সম্মেলন চলাকালে বিভিন্ন আপত্তি নিয়ে জ্যেষ্ঠ্য নেতারা নগর কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরীর বাসায় বৈঠক করেছিলেন। সেখানে সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনও ছিলেন। বৈঠকে বিভিন্ন অনিয়মের কথা বলার পর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সেগুলো সংশোধন করে সুন্দরভাবে সম্মেলন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে আগের নিয়মেই ইউনিট সম্মেলনগুলো সম্পন্ন হচ্ছিল। এর মধ্যে গত সপ্তাহে কয়েকজন জ্যেষ্ঠ্য নেতা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের সঙ্গে বৈঠক করে সার্বিক বিষয়ে আলাপ করেন।
এ অবস্থায় বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে বুধবার ঢাকায় যান নগর আওয়ামী লীগের ৫ জন সহ-সভাপতি, ২ জন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং একজন সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। তাদের সঙ্গে এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সন্তান শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলও কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। নওফেল চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও কোতোয়ালি আসনের সাংসদ।
ঢাকায় যাওয়া নগর আওয়ামী লীগের এক জ্যেষ্ঠ্য নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইউনিট সম্মেলনে জ্যেষ্ঠ্যতা লঙ্ঘন করা হয়েছে। সিনিয়র নেতাদের অন্ধকারে রেখে ইউনিট সম্মেলন সম্পন্ন করা হচ্ছে। অনেক প্রবীণ, ত্যাগী নেতার সদস্যপদ নবায়ন করা হয়নি। এমন আরও অনেক অনিয়ম হয়েছে। এছাড়া কেন্দ্র থেকে পাঠানো সদস্যপদ নবায়ন ও নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্তির ফরমের বাইরে নগর আওয়ামী লীগ থেকে একটি ফরম দেওয়া হয়েছে। সেই ফরমে এমনভাবে তথ্য চাওয়া হয়েছে, যাতে শুধুমাত্র নিজস্ব পছন্দের বলয়ের লোকজনই সদস্য হতে পারবেন।
‘এসব বিষয় আমরা কেন্দ্রীয় নেতাদের অবহিত করেছি। আমরা বলেছি, কেন্দ্র থেকে ফরম পাঠানোর পর আবার মহানগর আওয়ামী লীগ থেকে ফরম বিলি করা হল কেন ? তাহলে নগর আওয়ামী লীগ কি কেন্দ্রের কাউন্টার পার্ট ? নগর আওয়ামী লীগে কি আলাদা কর্তৃত্ব সৃষ্টি হয়েছে ? সম্মেলনের ক্ষেত্রে সাংগঠনিক বিধিবিধান, নিয়মনীতি কিছুই অনুসরণ করা হচ্ছে না। এতে চট্টগ্রাম মহানগরের মতো গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক ইউনিটে আওয়ামী লীগের রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
বৈঠকের বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোশাররফ হোসেন কিছু বলতে রাজি হননি। মাহবুবউল আলম হানিফ মিটিংয়ে ব্যস্ত থাকায় কথা বলতে পারেননি। আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপনের মোবাইল বন্ধ পাওয়া গেছে। তবে চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
ঢাকায় কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের কথা স্বীকার করে নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাচ্চু সারাবাংলাকে বলেন, ‘আপাতত ওয়ার্ড সম্মেলন হবে না। ৮ তারিখ (জানুয়ারি) কেন্দ্রীয় নেতা মাহবুবুল আলম হানিফ এবং আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন সাহেব চট্টগ্রামে আসবেন। ওইদিন ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং হবে। সেখানে ওয়ার্ড সম্মেলনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।’
২৬ নভেম্বর নগরীর বাগমনিরাম ওয়ার্ডে প্রথম সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। সেই ওয়ার্ডে গত ১৬ নভেম্বর প্রথম তিনটি ইউনিটে নির্বিঘ্নে সম্মেলন সম্পন্ন হয়েছিল।
জানতে চাইলে বাগমনিরাম ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র গিয়াস উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ’২৬ তারিখ (ডিসেম্বর) সম্মেলনের সব প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। কিন্তু এখন সম্মেলনের কার্যক্রম বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। আগামী মাসে (জানুয়ারি) সম্মেলন হবে বলে নগর আওয়ামী লীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা জানিয়েছেন।’
ওয়ার্ড সম্মেলন বন্ধের বিষয়ে চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের বক্তব্য জানতে পারেনি সারাবাংলা।
তবে নাছিরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত নগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নোমান আল মাহমুদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘গতকাল (বুধবার) নাছির ভাই কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। কেন্দ্র থেকে বলা হয়েছে ওয়ার্ড সম্মেলন আপাতত বন্ধ রাখতে। ইউনিট সম্মেলন শেষ করে ওয়ার্ড সম্মেলন করতে বলা হয়েছে। আরও ৭-৮টি ইউনিটে সম্মেলন বাকি আছে। সুতরাং ২৬ ডিসেম্বর যে ওয়ার্ডে আমরা সম্মেলন ঘোষণা করেছিলাম, সেটি হচ্ছে না। ৮ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক স্বপন ভাই চট্টগ্রামে আসবেন। উনার উপস্থিতিতে ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং হবে। সেখানে ওয়ার্ড সম্মেলনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। তবে ১২ জানুয়ারি থেকে ওয়ার্ড সম্মেলন শুরুর একটি সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ হয়েছে বলে আমরা জানতে পেরেছি।’
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতি মোটামুটি তিন ধারায় বিভক্ত। এর মধ্যে একটি অংশ এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত, মহিউদ্দিনের অবর্তমানে যাদের নিয়ন্ত্রণে আছেন তার সন্তান শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। আরেকটি অংশ সাধারণ সম্পাদক সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী। এছাড়া সহ-সভাপতি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজনদের একটি বলয় আছে। এই বলয়ের অনেক নেতাকর্মী আবার নওফেল-নাছিরের সঙ্গেও ভাগ হয়ে আছেন। চট্টগ্রাম নগরের দুই সাংসদ আফছারুল আমীন, এম এ লতিফেরও আলাদা-আলাদা অনুসারী আছেন।
সারাবাংলা/আরডি/একেএম