Wednesday 27 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনার ধাক্কা সামলে ‘আশার আলো’ চট্টগ্রাম বন্দরে

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২৫ ডিসেম্বর ২০২১ ১০:০৬

চট্টগ্রাম ব্যুরো: বৈশ্বিক করোনা মহামারির ধাক্কায় আমদানি-রফতানি বাণিজ্য ও কনটেইনার পরিবহন কমে গিয়ে বিশ্বের ব্যস্ততম বন্দরগুলো থেকে পিছিয়ে পড়ার ধাক্কা সামলে উঠছে চট্টগ্রাম বন্দর। করোনার সংক্রমণ শুরুর পর গতবছর কনটেইনার, কার্গো ও জাহাজ হ্যান্ডলিং কমে গেলেও এবছর রেকর্ড গড়েছে চট্টগ্রাম বন্দর।

বছর শেষের আগেই চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ ৩১ লাখ টিইইউস এবং জাহাজ হ্যান্ডলিং প্রায় চার হাজার ছাড়িয়ে গেছে, যা বিগত বছরগুলোর সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। সমাপ্ত হতে যাওয়া বছরে ১১ কোটি মেট্রিকটনেরও বেশি পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে ওঠানামা হয়েছে, এটাও অতীতের রেকর্ড ভেঙেছে বলছেন বন্দরের কর্মকর্তারা।

বিজ্ঞাপন

বন্দর ব্যবহারকারীরা বলছেন, এ ধারা অব্যাহত থাকলে চট্টগ্রাম বন্দর আবারও বিশ্বতালিকায় এগিয়ে যাবে। তবে দ্রুততার সঙ্গে বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো এবং বার্থ অপারেটরের সংখ্যা বাড়িয়ে প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরির তাগিদ দিয়েছেন তারা।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩০ লাখ ৯৬ হাজার ৯২৩ টিইইউস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে। ২০২০ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ২৮ লাখ ৩৯ হাজার ৯৭৭ টিইইউস। ২০১৯ সালে হয়েছিল ৩০ লাখ ৮৮ হাজার ১৮৭ টিইইউস। ২০১৮ সালে ২৯ লাখ ৩ হাজার ৯৯৬ এবং ২০১৭ সালে ২৬ লাখ ৬৭ হাজার ২২৩ টিইইউস কনটেইনার হ্যান্ডলিং করেছিল চট্টগ্রাম বন্দর।

২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরে ১১ কোটি ২৬ লাখ ৮২ হাজার মেট্রিকটন পণ্য ওঠানামা হয়েছে। ২০২০ সালে এ সংখ্যা ছিল ১০ কোটি ৩২ লাখ ৯ হাজার মেট্রিকটন এবং ২০১৯ সালে ১০ কোটি ৩০ লাখ ৭৭ হাজার মেট্রিকটন।

বিজ্ঞাপন

২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ এসেছে ৪ হাজার ৫৪টি। ২০২০ সালে এসেছি ৩ হাজার ৭২৮টি এবং ২০১৯ সালে ছিল ৩ হাজার ৮০৭টি।

বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের প্রভাবে ২০২০ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার পরিবহন এবং বন্দরে জাহাজ আসার পরিমাণ কমে যায়। তবে এক বছরের মাথায় কনটেইনার পরিবহন ও জাহাজ হ্যান্ডলিং আবারও অগ্রগতির ধারায় ফিরেছে।

শুক্রবার (২৪ ডিসেম্বর) চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘বছর শেষের এক সপ্তাহ আগেই চট্টগ্রাম বন্দর ৩১ লাখ কনটেইনার পরিবহনের টার্গেট পার করে ফেলেছে। জাহাজের সংখ্যাও চার হাজার পেরিয়েছে। বিগত বছরসমূহের তুলনায় কনটেইনার, কার্গো এবং জাহাজ হ্যান্ডলিং- এই তিনদিকেই আমরা আগের সমস্ত রেকর্ড ভঙ্গ করেছি। ১০ থেকে ১২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আমরা ঘোষণা করেছিলাম। সেটা আমরা অর্জন করতে পারব বলে আমাদের বিশ্বাস।’

১৯৭৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার পরিবহন শুরু হয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কনটেইনার পরিবহনেও সার্বিক অগ্রগতি আসে গত এক দশকে। বৈশ্বিক তালিকায় চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থানও গত এক দশকেই ওপরের দিকে যেতে শুরু করে। তবে করোনা মহামারিতে ২০২১ সালে এসে সেই অগ্রগতি বড় ধরনের ধাক্কা খায়। কমে যায় প্রবৃদ্ধি।

বিশ্বের বন্দরগুলোর এক বছরের কাজের গতি এবং কনটেইনার পরিবহনের হিসেব করে প্রতি বছর বিশ্বের শীর্ষ ১০০টি বন্দরের তালিকা করে লয়েডস লিস্ট। ২০১৮ সালে কনটেইনার পরিবহনের হিসেব করে ২০১৯ সালে প্রকাশিত তালিকায় বন্দরের অবস্থান ছিল ৬৪ তম। ২০১৯ সালের হিসেবে ২০২০ সালে প্রকাশিত তালিকায় চট্টগ্রাম বন্দর আরও ছয় ধাপ এগিয়ে যায়, বন্দরের অবস্থান হয় ৫৮ তম। কিন্তু ২০২১ সালে এসে আগের বছরের হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান ৯ ধাপ পিছিয়ে হয়ে যায় ৬৭তম।

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কনটেইনারে তৈরি পোশাক, ওষুধ, ইস্পাতসহ বিভিন্ন শিল্পপণ্য ও ভোগ্যপণ্য আমদানি করা হয়। আর বাংলাদেশ যেসব পণ্য রফতানি করে তার পুরোটাই কনটেইনারের মাধ্যমে হয়। বৈশ্বিক তালিকায় পিছিয়ে পড়ার জন্য বন্দরের কর্মকর্তা ও ব্যবহারকারীরা তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছিলেন। এসব কারণ হচ্ছে- ২০২০ সালে বৈশ্বিক করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে আমদানি-রফতানি কমে যাওয়া, লকডাউন ঘোষণার কারণে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে বাণিজ্যিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়া এবং বিশ্বের বিভিন্ন বন্দর বন্ধ থাকা।

বন্দরের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২১ সালে দেশে আরও একদফা করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেই পরিস্থিতিতেও বন্দরের কার্যক্রম ২৪ ঘণ্টা সচল রাখা হয়, যার প্রভাব পড়েছে চলতি বছরের কনটেইনার, কার্গো ও জাহাজ হ্যান্ডলিংয়ে। বন্দরের এই সক্ষমতা নিয়ে ব্যবহারকারীরা আশার আলো দেখলেও সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাবও দিয়েছেন সংগঠনগুলোর নেতারা।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট এসোসিয়েশনের চেয়ার‌ম্যান সৈয়দ মোহাম্মদ আরিফ বন্দরে কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে নিয়োজিত বেসরকারি বার্থ অপারেটর বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘২০০৭ সালের পর বন্দরে আর একজনও বার্থ অপারেটর বাড়েনি। যেভাবে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য বাড়ছে, তাতে বার্থ অপারেটরের সংখ্যাও বাড়াতে হবে। এতে প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। এখন বিষয়টা অনেকটা মনোপলি হচ্ছে। প্রতিযোগিতা বাড়লে কাজের গতি বাড়বে। কাজের গতি বাড়লে খরচ কমবে। বার্থ অপারেটর বাড়ালে বন্দরের প্রোডাকটিভিটিও বাড়বে।’

তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম কনটেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে বন্দরে আরও আধুনিক সরঞ্জাম সংযোজন এবং জেটি বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বন্দরের সক্ষমতা আরও বাড়ানোর জন্য অটোমোশন লাগবে। মালামাল হ্যান্ডলিংয়ের জন্য আরও আধুনিক ইকুইপমেন্ট আনতে হবে। সঙ্গে বন্দরের জেটি বাড়াতে হবে। এটা আমরা অনেকদিন ধরে বলে আসছি যে, বন্দরে জেটি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। কয়েকটি জেটি অকেজো হয়ে আছে। সেগুলোকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে নতুন জেটি সম্প্রসারণ করতে হবে।’

চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মাহবুবুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বন্দরের সক্ষমতা দিন দিন বাড়ছে, এটা খুবই জরুরি ছিল। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ৬০ বিলিয়ন ডলারের রফতানির যে টার্গেট, সেটা পূরণ করতে হলে বন্দরকে আরও বেশি সক্ষমতা নিয়ে কাজ করতে হবে। বে-টার্মিনাল চালু করতে হবে। পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল চালু করতে হবে। এগুলোর কোনো বিকল্প নেই।’

চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। কিছু প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে আমাদের কাজ করতে হয়। অপারেশনাল কার্যক্রমটা নিরবচ্ছিন্ন রাখতে আমাদের শ্রমিক সংগঠন, কর্মচারি সংগঠন এবং বন্দরের বাইরে পরিবহন সংক্রান্ত যেসব সংগঠন আছে সেগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হয়। চলতি বছরেও আমাদের দুই দফা পরিবহন ধর্মঘটের প্রতিকূলতা সামাল দিতে হয়েছে। তারপরও আমরা এগিয়ে গেছি। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, সবার সঙ্গে সার্বক্ষণিক সমন্বয় করে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া।’

সারাবাংলা/আরডি/এসএসএ

চট্টগ্রাম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর