দেশ জুড়ে নেটওয়ার্ক তৈরি করছেন শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান
২৭ ডিসেম্বর ২০২১ ২০:১৯
ঢাকা: সারাদেশে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মাধ্যমে অপরাধ কর্মকাণ্ডের নেটওয়ার্ক তৈরি করছেন দুবাইয়ে পালিয়ে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান। এমন সংবাদের ভিত্তিতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগ জিসানের ৭ সহযোগীকে গ্রেফতার করে।
ডিবি জানায়, কাশিমপুর কারাগারে থাকা দণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামির মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অপরাধ কর্মকাণ্ডের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে দুবাইয়ে পালিয়ে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান। দুবাই থেকেই জিসান দেশের বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে।
সোমবার (২৭ ডিসেম্বর) দুপুর ১২টার দিকে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার এ সব তথ্য জানান।
তিনি বলেন, ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও তার ভাই শামীম দুবাইয়ে পালিয়ে আছেb। সেখানে বসে সে দেশে বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড করেb। এতে তাকে সহযোগিতা করে কাশিমপুর কারাগারে থাকা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মুন্না এবং মামুন ওরফে ছক্কা মামুন। কারাগারে বসে এই দুজন আবার তাদের অনুসারীদের দিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় চাঁদাবাজি করে থাকেb।’
কারাগারে থাকা এই দুই সন্ত্রাসীর সঙ্গে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের এবং দেশে থাকা সন্ত্রাসীদের যোগাযোগের প্রমাণ পেয়েছে ডিবি।
গত ১৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় পূর্ববাড্ডা আলিফ নগর এলাকার জেনারেটর ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম খান টুটুলের পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা চান। শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের নামে এই চাঁদা চাওয়া হয়। তা না হলে তার সন্তানকে খুন করার হুমকি দেয় সন্ত্রাসীরা। এই ঘটনায় বাড্ডা থানায় একটি মামলা করেন শহিদুল ইসলাম।
ডিবি এ ঘটনায় ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ উদ্ধার করে। ফুটেজ পর্যালোচনা করে গত ২১ ডিসেম্বর ওই ঘটনায় অস্ত্র ব্যবহারকারী সন্ত্রাসী মো. নাসিরকে (২১) গ্রেফতার করে পুলিশ। ২২ ডিসেম্বর সে আদালতে জবানবন্দি দেয়। জবানবন্দিতে ওমর খৈয়াম নিরু, জীবন হোসেন, ফারহান মাসুদ সোহান, নাঈম, রানা ও কাওছার আহমেদ ইমনের নাম বলে সে।
নাসিরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী— ডিবির গুলশান জোনের টিম পার্বত্য বান্দরবান জেলার দুর্গম এলাকা থেকে গত ২৬ ডিসেম্বর দুপুরে কাওছার আহমেদ ইমনকে (২৪) গ্রেফতার করে।
তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী— বাড্ডার বেরাইদ এলাকা থেকে একইদিন রাতে সন্ত্রাসীদের ভাড়া করা বাসা থেকে মোহাম্মদ জীবন হোসেনকে (২৫) একটি পিস্তল, চার রাউন্ড গুলিসহ একটি ম্যাগজিন ও এক হাজার পিস ইয়াবা, ওমর খৈয়াম নিরুকে একটি রিভলবার, চার রাউন্ড ২২ বোরের রিভলভারের গুলিসহ একটি ম্যাগাজিন ও ৪০০ পিস ইয়াবা, ফারহান মাসুদ সোহানকে একটি বিদেশি পিস্তল, পাঁচ রাউন্ড গুলি এবং ৬০০ পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতার করা হয়।
ইমনের তথ্য অনুযায়ী— তার ঘরের একটি ব্যাকপ্যাক এর ভেতর থেকে দুই হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয় এবং একই ঘরে থাকা মো. আসালামকেও দুই হাজার পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতার করা হয়।
হাফিজ আক্তার আরও বলেন, ‘দুবাইয়ে অবস্থানরত জিসান ও তার ভাই শামিম এবং কাশিমপুর কারাগারে থাকা ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মামুনের ক্যাডার সোহান, ইমন, জীবন এবং নিরুর টাকার প্রয়োজন হলে তারা এলাকার বড় ভাই মো. মহিন উদ্দিন জালালের (৪৩) কাছে যায় এবং একটি কাজ অর্থাৎ টার্গেট দেওয়ার জন্য বলে। পরে মো. মহিন উদ্দিন জালাল জেনারেটর ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম টুটুলের খোঁজ দেয়। নীরু, জীবন ইমন কাজটি করার জন্য নাসিরকে ঠিক করে।’
দুবাইয়ে বসে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক পরিচালনা করে জিসান। ক্যাডার জীবন হোসেন কীভাবে গুলি করতে হবে অর্থাৎ পিস্তল চালাতে হয় তা বাসের হেলপার নাসিরকে শিখিয়ে দেয়। ২০ ডিসেম্বর সকালে জীবন এবং নাঈম নাসিরকে অস্ত্র দিলেও ওইদিন নাসির গুলি করতে যেতে পারেনি। পরদিন বিকেলে নাসির তার সহযোগী রানাকে নিয়ে টুটুলের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে হত্যার হুমকি দেয় এবং চাঁদা দেওয়ার কথা বলে গুলি করে চলে আসে। গুলি করার পরে নাসির অস্ত্রটি রামপুরা ব্রিজের কাছে গিয়ে জীবনের কাছে ফেরৎ দিয়ে আসে।
যে অস্ত্র ব্যবহার করে ব্যবসায়ী টুটুলের ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে গিয়ে গুলি করা হয় সেই অস্ত্রটি আসামি জীবনের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়। আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদকালে তারা দুবাই প্রবাসী চিহ্নিত শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের ক্যাডার বলে স্বীকার করে। তথ্যপ্রযুক্তির উপাত্ত বিশ্লেষণে দুবাই প্রবাসী চিহ্নিত শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়।
রাজধানীর দক্ষিণ বাড্ডায় ২০০৬ সালের ফোর মার্ডার মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত এবং বর্তমানে কাশিমপুর কারাগারে বন্দি মামুন ওরফে ছক্কা মামুনের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের প্রমাণ পাওয়া যায়। মূলত মামুন ও ছক্কা মামুনের মাধ্যমে জিসানের সঙ্গে সন্ত্রাসী জীবনের পরিচয় হয়। দুবাইয়ে অবস্থানরত জিসান কাশিমপুর কারাগারে অবস্থানরত আসামি মামুনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে। পরবর্তীকালে জীবনের মাধ্যমে সন্ত্রাসী জিসানের সঙ্গে সোহান এবং অন্যান্যদের পরিচয় হয়। তারা হোয়াটসঅ্যাপে তাদের যোগাযোগ রক্ষা করতো।
এ ছাড়া অস্ত্র মামলায় কাশিমপুর কারাগারে থাকা আসামি মুন্নাও গ্রেফতারকৃত আসামিদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতো এবং নির্দেশনা দিতো। জিসান একাধিকবার বিভিন্ন ব্যক্তির মাধ্যমে সোহানকে অস্ত্র সরবরাহ করেছে বলে স্বীকার করে। প্রথমদিকে জীবন হোসেনের মাধ্যমে জিসান সোহানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করলেও পরে সোহানসহ অন্যদের সঙ্গে জিসান সরাসরি যোগাযোগ রক্ষা করে।
জিসান, মামুন, এবং মাহফুজ (মামুনের ভাই হত্যা মামলায় কাশিমপুর কারাগারে বন্দি) বিভিন্ন সময়ে নিরু, জীবন, সোহান, আসলামসহ অন্যদের মামলায় হাজির হওয়াসহ অন্যান্য খরচ বিকাশের মাধ্যমে পাঠিয়ে দেয়। এই ক্যাডাররা বিভিন্ন সময়ে চাঁদাবাজির টাকা তুলে মামুনকে দিয়েছে বলে জানা যায়।
গ্রেফতারকৃত পিচ্চি আসলাম ওরফে ক্যাশিয়ার আসলাম এরই মধ্যে অস্ত্র মামলায় ৯ বছর কারাগারে বন্দি ছিল। গ্রেফতারকৃত অন্যদের বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক ও অন্যান্য একাধিক মামলা রয়েছে।
হাফিজ আক্তার বলেন, ‘ব্যবসায়ী টুটুলকে যারা গুলি করেছে তারা সবাই নিম্ন আয়ের মানুষ। কিছু সন্ত্রাসী তাদের ব্যবহার করেছে।’
এ সন্ত্রাসীদের চারজনের রাজনৈতিক পরিচয় রয়েছে। তিনজন বিএনপি ও একজন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলেও জানিয়েছে ডিবি।
হাফিজ আক্তার বলেন, ‘যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে তারা রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার চেষ্টা করে। গ্রেফতার সাতজনের মধ্যে তিনজন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং একজন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।’
তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসীরা সবসময় রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থেকে তাদের অপরাধ কর্মকাণ্ড চালানোর চেষ্টা করে।’
তবে তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে– অপরাধ কর্মকাণ্ড করে অর্থ আদায় করা। জিসানকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি।
সারাবাংলা/ইউজে/একে