মূল দল ছোট হচ্ছে, বাড়ছে নতুন জাপার সংখ্যা
৩০ ডিসেম্বর ২০২১ ২১:৫৮
ঢাকা: ৬৮ হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে— এই স্লোগান নিয়ে ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি জাতীয় পার্টি গঠন করেন সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এরশাদের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জাতীয় পার্টি পাঁচটি অংশে ভাগ হয়েছে। এর মধ্যে বর্তমানে মূল দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন গোলাম মোহাম্মদ কাদের। অন্য চারটি অংশের একটির নেতৃত্বে আছেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, আরেক অংশের নেতৃত্বে আন্দালিব রহমান পার্থ এবং অপর একটি অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন কাজী জাফর আহমেদ। এছাড়া বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (এম এ মতিন) নামে একটি অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন ডা. এম এ মুকিত।
বর্তমানে জাপার মূল অংশ নিয়ে একাদশ জাতীয় সংসদে বিরোধীদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন দলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ ও চেয়ারম্যান জি এম কাদের। বর্তমান সংসদে জাপার মূল অংশের ২৪ সদস্য প্রতিনিধিত্ব করছেন।
২০০১ সালে এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাপা থেকে বেরিয়ে জাতীয় পার্টি (জেপি) নামে নতুন দল গঠন করেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। দলটি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক। এ অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছেন আনোয়ার হোসেন মঞ্জু। তিনি বর্তমানে পিরোজপুর- ২ আসনের সংসদ সদস্য।
২০০১ সালের নির্বাচনের আগে এরশাদ জোট থেকে বেরিয়ে নতুন আরেকটি জাপা গঠন করেন সাবেকমন্ত্রী নাজিউর রহমান মঞ্জু। পরবর্তী সময়ে এ অংশের নাম হয় বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি)। এই অংশটি বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের সদস্য ছিল। কিন্তু বর্তমানে নেই। নাজিউর রহমান মঞ্জুর মৃত্যুর পর বর্তমানে এই বিজেপির নেতৃত্ব দিচ্ছেন তার ছেলে আন্দালিব রহমান পার্থ। এর আগে পার্থ সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হয়েছেন।
জাপার আরেক অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন কাজী জাফর আহমদ। তার মৃত্যুর পর জাপার এই অংশের নতুন চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার। এই জাপা অবশ্য বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক। দলটির নিজস্ব কোনো কর্মকাণ্ড নেই বললেই চলে। জোট ঘোষিত কর্মসূচিতে অংশগ্রহণই তাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড।
নির্বাচন কমিশনের আরেকটি নিবন্ধিত দল বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি। দলটির প্রতিষ্ঠাতা সাবেকমন্ত্রী এম এ মতিন। তিনি জিয়াউর রহমান ও এরশাদের মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। ২০১২ সালে তার মৃত্যুর পর দলের চেয়ারম্যান হন ছেলে ডা. এম এ মুকিত। বর্তমানে দলটির তেমন কোনো কার্যক্রম নেই বললেই চলে।
এভাবেই মূল জাতীয় পার্টি ছোট হচ্ছে। বাড়ছে নতুন জাপার সংখ্যা। এদিকে গত এক বছরে দলটির অভ্যন্তরীণ কোন্দল তীব্র হয়েছে। তৃণমূল জাপার নেতাকর্মীরা অন্য দলে গেছে। আবার জাতীয় পার্টি পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় অংশ হিসেবে এরশাদের দ্বিতীয় স্ত্রী (তালাকপ্রাপ্ত) বিদিশার নেতৃত্বে নতুন দল গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। যার নাম হতে পারে ‘তৃণমূল জাতীয় পার্টি’। এখন দেখার পালা এই জাপার ভবিষ্যৎ আসলে কী।
জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ মারা গেছেন ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই। এর মধ্যে গড়িয়ে গেছে দু’বছরের বেশি সময়। এরশাদপত্নী রওশন বর্তমানে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার দায়িত্ব পালন করলেও জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব দিচ্ছেন জি এম কাদের এমপি। যদিও রওশন এরশাদ অসুস্থ হয়ে ব্যাংককে চিকিৎসাধীন। তার শারীরিক অবস্থা দেখে দলটির শীর্ষ নেতাদের ধারণা, তিনি হয়তো আর রাজনৈতিক অঙ্গনে তৎপর হতে পারবেন না। তাই রওশনের গ্রুপটি মূল দলের নেতৃত্ব নেওয়ার জন্য তৎপরতা অব্যহত রেখেছেন।
রওশন ও জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি বর্তমানে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করছে। কিন্তু তাদের এই ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ রাজনৈতিক অঙ্গনে। গত একবছর সংসদে উত্থাপিত এবং পাস করা বিলগুলোতে জাপা দলীয় সংসদ সদস্যরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে সংশোধন-সংযোাজনসহ বিলের উপর আরও যাচাই-বাছাইয়ের প্রস্তাব করেছে। যদিও তাদের প্রস্তাব কণ্ঠভোটে নাকচ হয়েছে। তবে পয়েন্ট অব অর্ডারে দাঁড়িয়ে সরকারের বিরুদ্ধে তারা জোর কোনো বক্তব্য দিতে পারেনি। অথচ দলটির প্রেসডিয়াম বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, তারা সংসদে সরকারের ভুলত্রুটির বিষয় নিয়ে কঠিন অবস্থানে থাকবে। প্রয়োজনে ওয়াকআউট করবে। কিন্তু তারা তা করেননি। বরং অন্যদলের সংসদ সদস্যদের সরকার বিরোধী বক্তব্যের জবাব দিয়ে তারা সরকারি দলের হাত তালি পেয়েছেন। এতে করে দলটি গত এক বছরে পাকাপোক্তভাবে গৃহপালিত বিরোধীদল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
এছাড়া গত এক বছরে দলটি ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য একাধিক পদক্ষেপ নিয়েও তা করতে পারেনি। ঢাকা মহানগরসহ জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের নতুন নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে পারেনি। ঢাকা মহানগর উত্তর এবং দক্ষিণের ওয়ার্ড এবং থানা কমিটি নেই। নামকাওয়াস্তে কমিটিতে যারা আছেন তারা সংগঠনিক কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয়। গত এক বছরের অভ্যন্তরীণ কোন্দল মিটিয়ে জাতীয় পার্টি সুসংগঠিত ও শক্তিশালী বৃহৎ রাজনৈতিক দলে পরিণত হতে পারেনি। অথচ দলটির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল- জনসমর্থনের দিক দিয়ে বিএনপির জায়গা দখল করবে। বরং নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব নিয়ে দলটির ভাঙন দিন থেকে দিনে তীব্র হচ্ছে।
এদিকে, রওশন এরশাদের সঙ্গে জিএম কাদেরের দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্বের কারণে রওশনপুত্র রাহগির আল মাহে সাদ এরশাদ ও এরিক এরশাদের মা বিদিশার নেতৃত্বে নেতাকর্মীদের বিভক্তি ছিল গত এক বছরের আলোচিত ঘটনা। তাদের এই পৃথক তৎপরতা জাতীয় পার্টিতে জিএম কাদেরের নেতৃত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে বলেও মনে করেন দলটির নেতাকর্মীরা।
শুধু তাই নয়, দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত, যোগ্য ও ত্যাগী নেতাদের জাতীয় পার্টিতে অবমূল্যায়ন, কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে ত্যাগীদের বাদ দিয়ে অযোগ্য ও বিতর্কিতদের পদায়ন, বিভিন্ন সময় পদ বাণিজ্যের অভিযোগ, পার্টির চেয়ারম্যান কেন্দ্রিক গড়ে ওঠা শক্তিশালী সিন্ডিকেট, পদ-পদবি ও কমিটি গঠন নিয়ে কেন্দ্র থেকে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে নেতাদের কোন্দল-গ্রুপিং, পার্টির চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে অনেক নেতাকর্মীর।
এদিকে, জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়া উদ্দিন বাবলুর মৃত্যুর পর মুজিবুল হক চুন্নু এমপি দলটির মহাসচিব মনোনীত হয়েছেন। তিনি চেষ্টা করছেন দলটির অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখতে।
জাতীয় পার্টি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, ‘জাতীয় পার্টি ছোট হওয়ার সুযোগ নেই। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির দুঃশাসনের কারণে জনগণ অতিষ্ঠ। বিভিন্ন দল থেকে নেতাকর্মীরা জাতীয় পার্টিতে যোগদান করছে। আরও যোগদান করবে। সাধারণ জনগণ ও জাতীয় পার্টির পতাকা তলে চলে আসছে। জনগণই মনে করে, দেশ, জাতি ও জনগণের কল্যাণের জন্য একমাত্র দল জাতীয় পার্টি। সেজন্যই আমাদের স্লোগান- ৬৮ হাজার গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে।’
সারাবাংলা/এএইচএইচ/পিটিএম
জাতীয় পার্টি জিএম কাদের টপ নিউজ রওশন এরশাদ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ