Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নগর পরিবহন- বিজয়ের মাসে ঢাকাবাসীর জন্য স্বস্তির উপহার

আনিস মণ্ডল, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর
৩১ ডিসেম্বর ২০২১ ১১:১৭

পৌষের সকালে মিষ্টি রোদ গায়ে লাগিয়ে বসিলা বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছেই দেখি আমার প্রতিদিনের সঙ্গী ‘রজনীগন্ধ্যা’ বাস একরাতে নাম বদলে ‘টি থ্রি’ হয়ে গেছে। হঠাৎ এই নাম বদলের কারণ ভাবতে ভাবতেই নজর গেল ঢাকা নগর পরিবহন বাসের কাউন্টারের দিকে। সবুজ ছাতার নিচে চেয়ার-টেবিল নিয়ে বসা একজন কাউন্টার ম্যান। একযুগের ঢাকা জীবনের শুরুতে এভাবেই কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে বাসে উঠতাম আমরা। পুরনো স্মৃতি স্মরণ ও নতুনকে স্বাগত জানাতেই হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে দাঁড়ালাম ঢাকা নগর পরিবহনের কাউন্টারে।

বিজ্ঞাপন

সকাল ৯টা ৩ মিনিটে কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়াল একটি দুইতলা বিআরটিসির বাস। সামনে বড় করে লেখা ‘ঢাকা নগর পরিবহন’। বিভিন্ন খবরে আগেই জানতাম ৩০টি বিআরটিসি বাস ও ২০টি ট্রান্স সিলভার বাস নিয়ে ঢাকা নগর পরিবহনের যাত্রা শুরু হয়েছে। এর আগেই আমার গন্তব্য মৎসভবন পর্যন্ত টিকিট কেটে রেখেছিলাম। কাউন্টার ম্যান তার সামনে থাকা মেশিনে বসিলা টু রমনাপার্ক লিখতেই ১৮ টাকা মূল্যের একটি টিকিট বের হয়ে এলো। এই দূরত্বে প্রতিদিন আমাকে ২৫ টাকা ভাড়া দিয়ে যেতে হয়। সম্প্রতি বাস ভাড়া বাড়ানোর সময় এইটুকু পথেই কোনো কোনো বাস ৩৫ টাকা আদায় করেছে।

বিজ্ঞাপন

বাস উঠে দেখলাম ২৬ ডিসেম্বর উদ্বোধনের সময় যেসব রঙিন কাগজ ব্যবহার করা হয়েছিল, তা এখনো আছে। উপর-নিচ মিলিয়ে গোটা বিশেক যাত্রী পুরো বাসে। ছেড়ে এসেছে ঘাটারচর থেকে। কাউন্টারে মিনিটখানিক অপেক্ষা শেষে শুরু হলো যাত্রা। তিন রাস্তা মোড় পার হয়ে বাসটি থামলো তার পরবর্তী কাউন্টারে। সেখানেও খুব একটা অপেক্ষা করতে হয়নি। দাঁড়িয়ে থাকা তিনজন যাত্রী তুলেই রওনা দিল বাস। বাসটি যখন মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড অতিক্রম করছে, তখন একদল যাত্রী চিৎকার করে চালককে থামানোর আহ্বান জানাতে থাকে। কিন্তু নির্দিষ্ট কাউন্টার ছাড়া থামার নিয়ম না থাকায় বাসটি মুহূর্তে মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড পার হয়ে থামলো থানার সামনে। বাইরে ডাকাডাকি করা যাত্রীদের উদ্দেশ্যে ভেতর থেকে একজন যাত্রী উচ্চস্বরে বলছিলেন, ‘এইসব দিন শ্যাষ। কাউন্টারে আইসা নিয়ম মাইনা বাসে ওঠেন।’ প্রসঙ্গত, অন্য কোম্পানির বাস হলে ওইসব যাত্রীদের তোলার পরও এই জায়গায় ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতো ৫/১০ মিনিট। বাসের ভেতরে থাকা যাত্রীদের গালিগালাজ সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছালে চালক আস্তে আস্তে সামনে এগোতে শুরু করতেন।

মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডেও খুব একটা যাত্রী হলো না। এরপর একটানে এসে থামল ধানমন্ডির শংকর স্টপিজে। সেখানেও যাত্রী নেই! শুক্রবার হওয়ায় যাত্রীর চাপও একটু কম। আমাদের বাসটি কাউন্টার ম্যানের কাছ থেকে ক্লিয়ারেন্স পেয়েই ছুটলো জিগাতলার দিকে। তখনো শংকর বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে গুলিস্তান-মতিঝিল-শাহবাগ বলে ডাকাডাকি করছে ‘তরঙ্গ প্লাস’ ও ‘মিডলাইন’ বাসের দুই কন্ডাক্টর। এই রুটের ঐতিহ্যবাহী এসব বাস ফেলে সামনের দিকে ছুটতে শুরু করল ঢাকা নগর পরিহন।

অন্তত ১৫/২০টি বাসকে পেছনে ফেলে আমাদের বাস যখন রমনা পৌঁছায়, সময় তখন ঘড়ির কাঁটায় ৯টা ২৭ মিনিট। হিসাব বলছে, মাত্র ২৪ মিনিটে বসিলা থেকে মৎসভবন পৌঁছে গেছি আমি! ব্যস্ত এই শহরে, লোভী বাস মালিকদের দৌরাত্ম্যের মধ্যে এ যে কত স্বস্তির খবর, তা শুধু নিয়মিত বাসে চলাচলকারিরাই বুঝতে পারবেন।

যাত্রা শুরুর আগে কথা হয় বসিলা কাউন্টারম্যানের সঙ্গে। তিনি বলেন, দ্রুত বাসের সংখ্যা বাড়াতে হবে। বাস কম হওয়ায় যাত্রীদের অনেক সময় কাউন্টারে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। বাসের সংখ্যা বাড়লে যাত্রীর সংখ্যাও দ্রুত বাড়বে।

বাসের জন্য অপেক্ষারত এক শিক্ষার্থী শারমিন আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, আমি প্রায় ১৫ মিনিট কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছি। চাইলেই অন্যবাসে উঠতে পারতাম। কিন্তু তারা ১ ঘণ্টায় যে পথ অতিক্রম করে, এই বাস আধা ঘণ্টায় ততটুকু চলে যায়। এজন্যই একটু কষ্ট হলেও অপেক্ষা করে এই বাসেই উঠছি।

শফিক নামে এক যাত্রী কাউন্টারম্যানকে বলছিলেন, বাসের সংখ্যা বাড়ান। গতকাল আপনাদের বাসের জন্য আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করছি।

শারমিন-শফিকদের মতো সব যাত্রীরই একই দাবি, বাসের সংখ্যা বাড়াতে হবে। সেবার মান যতটুকু তা নিয়েই শতভাগ সন্তুষ্টু তারা।

মাত্র ২৪ মিনিটের এই পথচলায় শিখলামও অনেক। এদিন একজন যাত্রীও বাসচালককে গালি দেননি। অথচ এইটুকু পথ পাড়ি দিতেও অন্য বাসের চালকরা শতাধিক গালি ও তিরস্কারমূলক কথা শুনে থাকেন। শুনতে হয় অকথ্য গালিগালাজও। এই গালি দিতে যে যাত্রীরও ভালো লাগে না, নগর পরিবহনের বাস জার্নি তারই প্রমাণ। এমন নির্ঝঞ্ঝাট যাত্রা ঢাকার বাসযাত্রীদের কপালে নিকট অতীতে কখনো জোটেনি, সেটি বলছিলেন যাত্রীরাই। তারাই বলছেন, বিজয়ের মাসে ঢাকা নগর পরিবহন ঢাকাবাসীর জন্য এক স্বস্তিময় উপহার।

উল্লেখ্য, বাস রুট রেশনালাইজেশন প্রকল্পের অধীনে মাত্র ৫০টি বাস নিয়ে গত ২৬ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু হয় ঢাকা নগর পরিবহনের। আপাতত ‘ঘাটারচর-কাঁচপুর’ রোডে এই সেবা চালু হয়েছে। এক অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এর উদ্বোধন করেন। প্রাথমিকভাবে যে ৫০টি বাস চলাচল করবে, প্রতিটির গায়ে ঢাকা নগর পরিবহন লেখা থাকবে। দ্রুতই এই বহরে আরো ৫০টি বাস যুক্ত করা হবে। সকাল ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত বাসগুলো যাত্রী পরিবহন করবে। সকাল ৬টা থেকে সকাল ১১টা এবং বিকেল ৪টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ‘পিক টাইম’ নির্ধারণ করা হয়েছে। এই সময় ৫ মিনিট পর পর যাত্রীছাউনিতে বাস এসে দাঁড়াবে। অন্য সময় আসবে প্রতি ১০ মিনিট পর পর। নির্দিষ্ট জায়গা ছাড়া যাত্রীরা ওঠানামা করতে পারবে না।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, এটা আমদের জন্য নতুন দিগন্ত। সড়কের শৃখলা আনতে গেলে বাস রুট রেশনালাইজেশনের কোনো বিকল্প নেই। তবে এটা বাস্তবায়ন করা আমাদের জন্য অনেক চ্যালেঞ্জ হবে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, আমরা প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের স্বপ্ন পূরণের শুভসূচনা করতে যাচ্ছি। গাড়ির চালকেরা এতদিন গালি পেয়েছে, অবজ্ঞার শিকার হয়েছে। আজ তারা সম্মান পেয়েছে। তারা এখন মাসিক বেতন পাবে।

সারাবাংলা/এএম

Dhaka Nogor poribahan ঢাকা নগর পরিবহন ঢাকাবাসী বাস রুট রেশনালাইজেশন

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর