Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

দামপাড়া: সেই অস্ত্রাগার, শহিদ এসপি-ওসি ফিরছেন পর্দায়

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৩১ ডিসেম্বর ২০২১ ২১:৩৯

চট্টগ্রাম ব্যুরো: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই পাকিস্তানি হানাদারদের প্রতিরোধের ইতিহাস রচনা করেছিলেন চট্টগ্রামের তৎকালীন পুলিশ সুপার শামসুল হক, কোতোয়ালী থানার ওসি আব্দুল খালেক এবং দামপাড়া পুলিশ লাইনের আর আই আকরাম হোসেন। তাদের নির্দেশে দামপাড়া পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র নিয়ে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন পুলিশ সদস্যরা। এই তিন অকুতোভয় বীরকে পাকিস্তানিরা নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। শহিদ হয়েছিলেন অন্তঃত ৫১ জন।

বিজ্ঞাপন

পাকিস্তানিদের প্রতিরোধে পুলিশের সেই বীরত্বগাঁথা নিয়ে স্বাধীনতার ৫০ বছর পর নির্মিত হচ্ছে চলচ্চিত্র ‘দামপাড়া’। সেই অস্ত্রাগার, সেই শহিদ এসপি-ওসি-আর আইসহ পুলিশ সদস্যরা ফিরছেন সেলুলয়েডের পর্দায়। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) প্রযোজনায় চলচ্চিত্রটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে আছেন উপ পুলিশ কমিশনার বিজয় কুমার বসাক।

শুক্রবার (৩১ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় নগরীর দামপাড়ায় নগর পুলিশ লাইনের মাল্টিপারপাস শেডে চলচ্চিত্রটির আনুষ্ঠানিক মহরত হয়েছে, যদিও ২৪ ডিসেম্বর থেকেই আনুষ্ঠানিক দৃশ্যধারণ শুরু হয়ে গেছে। মহরত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।

গবেষক জামাল উদ্দিনের ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম শহর’—বইয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের মার্চে চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার শামসুল হক, কোতোয়ালী থানার ওসি আব্দুল খাল এবং দামপাড়া পুলিশ লাইনের আর আই আকরাম হোসেনের সম্মিলিত পরিকল্পনায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে পুলিশের প্রতিরোধের ইতিহাস রচিত হয়।

২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর ২৮ মার্চ ভোররাতে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী দামপাড়া পুলিশ লাইন আক্রমণ করে। আর আই আকরাম হোসেন পুলিশ সদস্যদের নিয়ে মরণপণ লড়াই করেন। সেদিন শহিদ হয় ৫১ জন পুলিশ সদস্য, যাদের সবাই পুলিশ ব্যারাকে ছিলেন। একইদিন রেলওয়ে এলাকায় পুলিশ সুপারের বাসভবনের সামনে পুলিশের সঙ্গে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর আরেক দফা যুদ্ধ হয়। শহিদ হন ১১ জন পুলিশ সদস্য। ১২ এপ্রিল আর আই আকরাম হোসেনকে চট্টগ্রাম শহরের আন্দরকিল্লা থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী গ্রেফতার করে। ১৭ এপ্রিল এসপি শামসুল হককেও গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যান্টনমেন্টে। শেষবারের মতো দুই বীর যোদ্ধার দেখা হয় কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। দু’জনকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তাদের লাশও পাওয়া যায়নি।

বিজ্ঞাপন

ওসি আব্দুল খালেককে হত্যার কাহিনী আরও মর্মন্তুদ। ১৬ এপ্রিল তিনি গ্রেফতার হন, যিনি এসপি শামসুল হকের নির্দেশে হানাদার প্রতিরোধে চট্টগ্রামের ছাত্র-যুবকদের হাতে পুলিশের অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন। ওসি খালেককে হত্যা করা হয় মধ্যযুগীয় বর্বরতায়। জামাল উদ্দিন লিখেছেন— ’১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল শুক্রবার বিকেলে চট্টগ্রাম শহরের কোনো প্রত্যক্ষদর্শী যদি শহরের রাজপথে খোলা একখানি জিপ গাড়ির সামনে দু’হাত দু’দিকে দিয়ে বিধ্বস্ত একটা লোককে বাঁধা অবস্থায় হানাদার দস্যুদের গাড়িতে ঘোরাতে দেখে থাকেন— তবে তিনি নিশ্চয়ই বিবস্ত্র লোকটার ওপর খড়িমাটি দিয়ে সাদা অক্ষরে লেখা লাইনটিও পড়ে থাকবেন—কোতোয়ালীর ওসি খালেক এরেস্টেড। সম্ভবত হানাদাররা গ্রেফতারের পর এভাবে আর কোনো বাঙালিকে প্রকাশ্যে রাজপথে প্রদর্শনী সহকারে পাশবিক অত্যাচার করেনি।’

চলচ্চিত্রটিতে শহিদ এসপি শামসুল হকের ভূমিকায় দেখা যাবে অভিনেতা ফেরদৌস আহমেদকে। তার স্ত্রী মাহবুবা হক চৌধুরীর ভূমিকার অভিনয় করছেন হাসনা হাবিব ভাবনা। শহিদ ওসি খালেকের ভূমিকায় অভিনয় করছেন অভিনেতা অনন্ত হীরা। আর আই আকরাম হোসেন হয়ে পর্দায় আসছেন অভিনেতা ঝুনা চৌধুরী। পরিচালনা করছেন শুদ্ধমান চৈতন এবং চিত্রনাট্য লিখেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আনান জামান।

মহরত অনুষ্ঠানে শহিদ এসপি শামসুল হকের স্ত্রী মাহবুবা হক চৌধুরীও এসেছিলেন। বক্তব্য রাখতে গিয়ে সেই বিভীষিকাময় দিনগুলোর কথা স্মরণ করে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। বক্তব্যে তিনি বলেন, ’৫০ বছর পরে হলেও পুলিশ সুপার শামসুল হককে নিয়ে, যে মানুষটা দেশের শহিদ হয়েছে, তাকে নিয়ে কিছু করার কথা যে তারা (সিএমপি) ভেবেছে, এটা আমার কাছে খুব ভালো লাগছে। আমার সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে, মানুষটা তিন দিন ধরে বাসায় আসেননি। আমি টেলিফোন ঘুরিয়েই যাচ্ছি, কোতোয়ালী থানায়, আর আই অফিসে। কেউ কিছু জানে না। একদিন কণ্ঠটা শুনলাম। বুঝলাম, তিনি বেঁচে আছেন। এরপর তাকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলা হলো। আমার ভাইও গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। সে ফিরেছে, কিন্তু আমার স্বামী ফেরেনি।’

তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘দামপাড়া একটি ঐতিহাসিক জায়গা। ১৯৩০ সালে বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেন তার বিপ্লবী বাহিনী নিয়ে অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র লুট করে চট্টগ্রামকে ১১দিন স্বাধীন করে রেখেছিলেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানিদের প্রতিরোধে আরেক ইতিহাসের জন্ম দিয়েছিল পুলিশ। তবে ১৯৩০ আর ১৯৭১ এর ঘটনার মধ্যে একটা বৈপরীত্য আছে। ১৯৩০ সালে অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র লুট করতে হয়েছিল। ১৯৭১ সালে পুলিশই অস্ত্রাগারের অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানিদের প্রতিরোধ করেছিলেন, এসপি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অস্ত্র সরবরাহ করেছিলেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এখনও অনেক অজানা রয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধারা চলে যাচ্ছেন, মুক্তিযুদ্ধকে দেখেছেন একদিন এমন মানুষও আর থাকবেন না।’

সত্য ঘটনা যখন পর্দায় মূর্তরূপে ফিরে আসে তখন সেটা মানুষের হৃদয়ে আরও বেশি গেঁথে যায় মন্তব্য করে তথ্যমন্ত্রী চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়ায় সিএমপিকে ধন্যবাদ জানান। মুক্তির পর তথ্যমন্ত্রী নিজে চট্টগ্রামে সিনেমা হলে গিয়ে চলচ্চিত্রটি দেখবেন বলে ঘোষণা দেন।

তিনি পুলিশকে সিনেমা হল নির্মাণে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সিনেমা হল সংস্কার ও নতুন হল নির্মাণের জন্য এক হাজার কোটি টাকার একটি ফান্ড দিয়েছেন। বিভাগীয় শহরে যদি পুলিশ সিনেমা হল করতে চায় তাহলে ৫ শতাংশ সুদে এবং জেলা শহরে করতে চাইলে সাড়ে ৪ শতাংশ সুদে ঋণ পাবে। কক্সবাজারে অনেক পর্যটক বেড়াতে যান, সেখানে কয়েকটি সিনেপ্লেক্স নির্মাণের প্রয়োজন।’

অভিনেতা ফেরদৌস আহমেদ বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের যে বীরত্ব সেটা নিয়ে নাটক-সিনেমা খুব একটা হয়নি। পুলিশের ভূমিকা আমরা চলচ্চিত্রে ফুটিয়ে তুলতে পারিনি। এটা আমাদের ব্যর্থতা। মুক্তিযুদ্ধের এমন সত্য ঘটনা নিয়েও চলচ্চিত্র আগে সম্ভবত হয়নি। এই সিনেমা আমাদের চলচ্চিত্র জগতের নতুন দ্বার উন্মোচন করবে।’

হাসনা হাবিব ভাবনা বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের চেয়ে বড় কিছু আমাদের জাতির জীবনে আর ঘটেনি। এই সিনেমার চিত্রনাট্য পড়ার পরে আমার মধ্যে এমন এক অনুভূতি তৈরি হয়েছে, নির্মাণ শেষে সিনেমা দেখার পরও একই অনুভূতি তৈরি হবে বলে আমার বিশ্বাস।’

সিএমপি কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীরের সভাপতিত্বে মহরত অনুষ্ঠানে পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন, সিনেমার পরিচালক শুদ্ধমান চৈতন এবং চিত্রনাট্যকার আনান জামানও বক্তব্য রাখেন।

উল্লেখ্য, ১৯৩০ সালে মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে দামপাড়ায় অস্ত্রাগার লুট এবং ১৯৭১ সালের প্রতিরোধ যুদ্ধের ইতিহাসকে সংরক্ষণ করে রাখতে সিএমপি ইতোমধ্যে সেখানে নির্মাণ করছেন জাদুঘর।

সারাবাংলা/আরডি/আইই

দামপাড়া

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর