Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভয়ংকর আইস— দেশে বাজার তৈরির চেষ্টায় মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২ জানুয়ারি ২০২২ ২১:০৯

চট্টগ্রাম ব্যুরো: আইস বা ক্রিস্টাল মেথ। নিষিদ্ধ মাদক ইয়াবার চেয়েও ভয়ংকর এক মাদক। বছর তিনেক আগে প্রথম এর একটি চালান ধরা পড়ে রাজধানীতে। এরপর নিয়মিতই এই মাদক ধরা পড়েছে দেশের এখান-ওখান থেকে। সংশ্লিষ্টদের শঙ্কা— ফেনসিডিল, ইয়াবার মতো এই মরণ নেশাও পরিণত হতে পারে নিরব ঘাতকে। আর তার জন্যই বাংলাদেশকে এর বাজার হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরও ভয়ংকর এই মাদক নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। তাদের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ক্রিস্টল মেথের বাজার তৈরির এই চেষ্টায় জড়িত মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কে যুক্ত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। দেশের ইয়াবা গডফাদারদের মাধ্যমে তারা এই বাজার তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে গত চার বছর ধরে। শুরুতে তারা ক্রিস্টাল মেথ মজুত করছে কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পগুলোতে। সেখান থেকে বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে।

বিজ্ঞাপন

ক্রিস্টাল মেথ নিয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে সংস্থার চট্টগ্রাম বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয়। প্রতিবেদনটি আরও বলছে, বাংলাদেশে ক্রিস্টাল মেথ ঢুকতে সহযোগিতা দিচ্ছে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

বাংলাদেশে প্রথম ক্রিস্টাল মেথ ধরা পড়ে ২০১৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি, ঢাকার মোহাম্মদপুরে। ৮ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথ বা আইসসহ তিন জনকে আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। এরপর ওই বছরের ২৭ জুন ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে ক্রিস্টাল মেথসহ নাইজেরীয় এক নাগরিককে আটক করে অধিদফতর। তার কাছে ৫২২ গ্রাম আইস পাওয়া যায়।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রামে প্রথম ১৪০ গ্রাম ক্রিস্টাল মেথের একটি চালান ধরা পড়ে ২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি। র‌্যাবের এক অভিযানে নগরীর খুলশী থেকে দু’জন মাদক পাচারকারীকেও আটক করা হয়েছিল। পরে ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২৯টি অভিযানে বিপুল ক্রিস্টাল মেথসহ ৩৭ জনকে আটক করা হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, র‌্যাবের চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জোন, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ এবং বিজিবি পৃথকভাবে অভিযান চালিয়ে ক্রিস্টাল মেথের এসব চালানসহ ৩৭ জনকে আটক করেছে।

আটক মাদক কারবারিদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য এবং অনুসন্ধানের ভিত্তিতে বাংলাদেশে ক্রিস্টাল মেথের উৎস, সরবরাহ, গন্তব্য ও বাজার পরিস্থিতি নিয়ে সদ্য বিদায়ী ডিসেম্বরে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয়ের উপপরিচালক হুমায়ুন কবির খোন্দকার।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের হিসাবে দেশে মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩৬ লাখ। তবে বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার গবেষণা বলছে, মাদকাসক্তের সংখ্যা ৭০ লাখেরও বেশি। বাংলাদেশে প্রতিবছর মাদকের পেছনে ব্যয় হয় প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। বিপুল অর্থের এই বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিতেই পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশে ক্রিস্টাল মেথ ঢোকানো হচ্ছে— এমনটিই মনে করছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা।

অধিদফতরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় গোয়েন্দা কার্যালয়ের উপপরিচালক হুমায়ুন কবির খোন্দকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইয়াবা কিন্তু সংরক্ষণ করা যায় না। সর্বোচ্চ তিন মাস পর্যন্ত ইয়াবা সংরক্ষণ করা যায়। এরপর সেটি গুণাগুণহীন পাউডারে পরিণত হয়। অন্যদিকে ক্রিস্টাল মেথ যতদিন ইচ্ছা ততদিন, সর্বনিম্ন এক থেকে দেড় বছর কিংবা তার চেয়েও বেশি সময় সংরক্ষণ করা যায়। ফলে যারা ইয়াবার ব্যবসায় আছেন, তাদের কাছে ইয়াবার চেয়ে ক্রিস্টাল মেথে বিনিয়োগ বেশি লাভজনক। কারণ ইয়াবা নষ্ট হওয়া মানে বিনিয়োগ করা টাকাও নষ্ট হয়ে যাওয়া। ক্রিস্টাল মেথে বিনিয়োগ নষ্ট হওয়ার খুব বেশি সুযোগ নেই।’

‘আবার বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তি দামের মাদকের প্রতিও আগ্রহ বাড়ছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে ক্রিস্টাল মেথের বাজার তৈরি করা সহজ হয়ে উঠেছে,’— বলছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের এই কর্মকর্তা।

ক্রিস্টাল মেথ কী?

ক্রিস্টাল মেথের পরিচিতি তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্রিস্টাল মেথ দেখতে অনেকটা স্বচ্ছ কাঁচের মতো, কাঁচা সামুদ্রিক দানাদার লবণ কিংবা শক্ত বরফের মতো ছোট খণ্ডাকৃতি যা উৎকট গন্ধযুক্ত। ইয়াবার মতো ক্রিস্টাল মেথেরও মূল উপাদান মেথামফেটামিন। তবে ক্রিস্টাল মেথে ইয়াবার চেয়ে ১৫ থেকে ২০ গুণ বেশি মেথামফেটামিন থাকে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্রিস্টাল মেথ ইয়াবার চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে মানবদেহে। ইয়াবা শরীরে প্রবেশের পর যতটুকু হরমোনজনিত উত্তেজনা তৈরি করে, তার চেয়ে ৫০ থেকে ৬০ গুণ বেশি উত্তেজনা তৈরিতে সক্ষম ক্রিস্টাল মেথ। এর ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে তিন গুণেরও বেশি। এটি আত্মহত্যার প্রবণতাও তৈরি করে।

কোন দেশ থেকে কারা পাঠাচ্ছে ক্রিস্টাল মেথ?

ইয়াবার মতো মিয়ানমার থেকেই মূলত বাংলাদেশে আসছে ক্রিস্টাল মেথ। মালয়েশিয়া, চীন, থাইল্যান্ড থেকে আসার প্রাথমিক তথ্যও পেয়েছেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মায়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কে যুক্ত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো বিভিন্ন সীমান্তবর্তী দেশ থেকে ক্রিস্টাল মেথ তৈরির কাঁচামাল সংগ্রহ করে। গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল অর্থাৎ মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও লাওসের সীমান্ত এলাকায় আফিম উৎপাদনকারী অঞ্চলে বিভিন্ন কারখানায় তৈরি হচ্ছে ক্রিস্টাল মেথ। কারখানাগুলোর নিয়ন্ত্রণে আছে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ।

মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিক অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল আলম চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘মিয়ানমারে শান নামে একটি রাজ্য আছে। এটি চীন, লাওস ও থাইল্যান্ডের সীমান্তবর্তী। সেখানে কোকাং এবং ওয়া উপজাতিদের সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপ আছে। সেখানে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীরও খুব একটা নিয়ন্ত্রণ নেই। এই বিদ্রোহী গ্রুপগুলো তাদের সশস্ত্র কার্যক্রম চালাতে অর্থের প্রয়োজনে প্রথমে হেরোইনের ব্যবসা করত। এরপর তারা ইয়াবার কাঁচামাল মেথামফেটামিন সংগ্রহ করে বিশ্বজুড়ে সরবরাহ করতে শুরু করে। সবশেষ তারা এখন ক্রিস্টাল মেথ উৎপাদন করে বিভিন্ন দেশে সরবরাহ করছে।’

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতবাদী সশস্ত্র গ্রুপ তাদের সে দেশীয় প্রতিনিধির মাধ্যমে বাংলাদেশের সীমান্ত দিয়ে পাঠাচ্ছে ক্রিস্টাল মেথ। এক্ষেত্রে তাদের সহযোগিতা দিচ্ছে মায়ানমারের সীমান্তরক্ষী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

গোয়েন্দা কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীর খোন্দকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইয়াবা যে পথে আসে, একই পথে ক্রিস্টাল মেথও আসছে। বাংলাদেশে যারা ইয়াবার শীর্ষ গডফাদার, তারা এখন ক্রিস্টাল মেথের দিকে ঝুঁকছে। তারা ক্রিস্টাল মেথে বিনিয়োগ করছে। মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী, সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের ইয়াবা গডফাদারদের যোগাযোগ আছে। তারাই মূলত বাংলাদেশে ক্রিস্টাল মেথ নিয়ে আসছে। তবে চাহিদা এখনো খুব বেশি না হওয়ায় ইয়াবার সঙ্গেই ক্রিস্টাল মেথ আনছে তারা।’

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, মিয়ানমার থেকে বিভিন্ন পণ্যের আড়ালে ক্রিস্টাল মেথ আসে। এক্ষেত্রে সুকৌশলে টেকনাফ স্থলবন্দর ব্যবহার হচ্ছে। কক্সবাজার ও বান্দরবান সীমান্ত দিয়েও আসছে ক্রিস্টাল মেথ। দেশের দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের শীর্ষ ইয়াবা কারবারিদের গড়ে তোলা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের কয়েকটি মাদক সিন্ডিকেট ক্রিস্টাল মেথ আনা ও দেশের ভেতরে ছড়িয়ে দেওয়া নিয়ন্ত্রণ করছে। আর এসব সিন্ডিকেটের প্রধানরা অবস্থান করেন ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে।

র‌্যাবের চট্টগ্রাম জোনের প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ ইউসুফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘সদ্য শেষ হওয়া বছরে আমরা ক্রিস্টাল মেথের তিনটি চালান ধরেছি। এর সূত্র ধরে আমরা অনুসন্ধান করে বেশকিছু তথ্য পেয়েছি। আমাদের কাছে তথ্য আছে, মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী কয়েকটি গোষ্ঠী বাংলাদেশে ক্রিস্টাল মেথ সরবরাহ করছে। মিয়ানমারে যেসব কারখানায় ইয়াবা তৈরি হয়, সেসব কারখানায় এখন ক্রিস্টাল মেথও তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশে যারা বড় বড় ইয়াবা ব্যবসায়ী, তারা ইয়াবার সঙ্গে অতিরিক্ত ব্যবসা হিসেবে ক্রিস্টাল মেথ মাদক হিসেবে দেশে চালু করে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।’

এমপিটি সিমে কারবারিদের সঙ্গে যোগাযোগ

মিয়ানমারের টেলিযোগাযোগ সংস্থা মিয়ানমার পোস্ট অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশনের (এমপিটি) মোবাইল সিমের মাধ্যমে দেশটির বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গ্রুপের সদস্য ও তাদের প্রতিনিধি, যারা বাংলাদেশে ইয়াবা সরবরাহের সঙ্গে জড়িত, তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের মাদক কারবারিদের যোগাযোগ হয়। প্রতিবেদনে বিষয়টি সবচেয়ে উদ্বেগের বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

এতে আরও বলা হয়েছে, এমপিটি সিম দিয়ে মিয়ানমার থেকে কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় সরাসরি কথা বলা যায়। কক্সবাজারেও কারবারিদের অনেকে এমপিটি সিম ব্যবহার করেন। আবার এমপিটি মোবাইল সিমে রোমিং সুবিধায় বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে কথা বলা যায়। বাংলাদেশের মাদক কারবারিরা এমপিটি সিমে মিয়ানমারের ক্রিস্টাল মেথ সরবরাহকারীদের সঙ্গে কথা বলেন।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গোয়েন্দা কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীর খোন্দকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘এমপিটি সিমের মাধ্যমেই মূলত ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথ সংক্রান্ত বিষয়ে দুই দেশের সংশ্লিষ্টরা যোগাযোগ করেন। এটি এ কারণে উদ্বেগের বিষয় যে এই সিম ব্যবহারকারীরা নজরদারির আওতায় নেই। বাংলাদেশ থেকে সম্ভবত নজরদারির সুযোগও নেই।’

যেভাবে ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার শাহপরীর দ্বীপ, সাবরাং হ্নীলা, হোয়াক্যং এবং উখিয়া উপজেলার বালুখালী, পালংখালী, রাজাপালং এবং পার্বত্য জেলা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুমসহ বিস্তীর্ণ সীমান্ত এলাকা ইয়াবার পাশাপাশি ক্রিস্টাল মেথ প্রবেশের মূল রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আবার এই স্থলপথের পাশাপাশি মাছ ধরার ট্রলারে করে সাগর পথে কক্সবাজারের টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, মহেশখালী, কর্ণফুলী চ্যানেলে আনোয়ারা, গহিরা, বাঁশখালী, জলদি এবং চট্টগ্রামের পারকির চর, পতেঙ্গা, সন্দ্বীপ, সীতাকুণ্ড ও মীরসরাইয়ের উপকূলীয় এলাকা পাচারের নৌরুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। এই দুই পথে আসা ক্রিস্টাল মেথ চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে অথবা রেলপথে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যাচ্ছে।

নৌপথে আসা ক্রিস্টাল মেথের চালান পাচারে আরও কয়েকটি রুটও ব্যবহার হয়। চালান নৌপথে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় এসে মেঘনা নদী পাড়ি দিয়ে বরিশাল, ভোলা, বরগুনা, পিরোজপুর, নোয়াখালীর হাতিয়া, লক্ষ্মীপুর মজু চৌধুরীর ঘাট, চাঁদপুর, মুন্সীগঞ্জ, ষাটনল এবং নারায়ণগঞ্জ হয়ে ঢাকায় পৌঁছে ক্রিস্টাল মেথের চালান।

তবে ক্রিস্টাল মেথের চালান মিয়ানমার থেকে ভারত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের তথ্যও পাওয়া গেছে বলে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

র‌্যাব-৭ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম এ ইউসুফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ক্রিস্টাল মেথের চালান সড়কপথ, সাগরপথ এবং কখনো কখনো পাহাড়ি পথে আসছে বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত অনুসন্ধান চলছে। আমরা যে তিনটি চালান আটক করেছি, এর দু’টি সড়কপথে এবং একটি সাগরপথে এসেছে।’

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সড়কপথে মূলত আসে বিভিন্ন পণ্যের আড়ালে অথবা ইয়াবার চালানের সঙ্গে। আর নৌপথে আসে মাছ ধরার নৌযানের মাধ্যমে। বাংলাদেশের জেলেরা মাছ ধরার জন্য গভীর সাগরে গেলে মিয়ানমারের মাদক কারবারিরা বিভিন্ন রঙের শক্তিশালী লেজার লাইট দিয়ে সেগুলোকে সিগন্যাল দেয়। এর মধ্যে যেসব জেলে বাংলাদেশের মাদক কারবারিদের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে, তারা ফিরতি নির্ধারিত সিগন্যাল দেয়। এতে ক্রিস্টাল মেথ সরবরাহকারীরা নিশ্চিত হয়ে চালান হস্তান্তর করে। নৌপথেই ক্রিস্টাল মেথের চালান হাতবদল হয়।

স্থলপথে ক্রিস্টাল মেথ সরবরাহে ব্যবহার করা হয় জরুরি পণ্য পরিবহনের ট্রাক, লাশবাহী গাড়ি, জ্বালানি তেলের লরি, অ্যাম্বুলেন্সে, বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিসের গাড়িতে, দূরপাল্লার যানবাহন ও গণপরিবহন। এগুলোর মাধ্যমে প্যাকেট আকারে বিভিন্ন মোড়কে ট্রাভেল ব্যাগে করে ক্রিস্টাল মেথ ছড়িয়ে পড়ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। অন্যদিকে আকাশপথে কার্গো বিমানে বিভিন্ন পণ্যের সঙ্গে কাঁচা মালামাল ও বিমানযাত্রীর লাগেজ এবং ট্রাভেল ব্যাগে করেও ক্রিস্টাল মেথ পাচার হচ্ছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীর খোন্দকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্থলপথ, নৌপথ ও আকাশপথ— তিন রুটেই ইয়াবা পাচার হয়। একইভাবে ক্রিস্টাল মেথও ছড়িয়ে পড়ছে বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। অনেক সময় মাদক নিয়ে কারবারিরা বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে পড়ে বলেও তথ্য পাওয়া গেছে।’

এদিকে ইয়াবার মতো ক্রিস্টাল মেথ পাচারেও রোহিঙ্গারা এখন বাংলাদেশে মূল ভূমিকা পালন করছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী ও বাংলাদেশের ইয়াবা গডফাদাররা কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের ক্রিস্টাল মেথ বহন করে বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেতে ব্যবহার করছে। সীমান্ত পার করে মাদকের চালান নিয়ে আসা, আবার বাংলাদেশের ভেতরে বিভিন্ন গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া— দুই ধরনের কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে রোহিঙ্গারা।

কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় যেসব রোহিঙ্গা ক্যাম্প আছে, সেখানে ক্রিস্টাল মেথ মজুত রাখা হয় বলেও তথ্য এসেছে প্রতিবেদনে।

মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিক অবসরপ্রাপ্ত মেজর এমদাদুল আলম চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘মায়ানমার থেকে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে, তাদের দরকার টাকা। তারা টাকার জন্য যে যা করতে বলছে সেটাই করছে। তাদের ব্যবহার করছে মাদকের দেশীয় শীর্ষ ব্যবসায়ী যারা আছে, তারা।’

ক্রিস্টাল মেথের বাজার তৈরির কৌশল

কম দামে অথবা বিনামূল্যে ক্রিস্টাল মেথ সরবরাহ করে বাংলাদেশে বাজার তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে দুই দেশের মাদক কারবারিরা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গোয়েন্দা বিভাগের তৈরি করা এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মিয়ানমার থেকে আসা প্রতি কেজি ক্রিস্টাল মেথের দাম টেকনাফে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা। কক্সবাজার শহরে ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা। তবে মিয়ানমার থেকে প্রকৃত দামের চেয়ে অনেক কম দামে বাংলাদেশের ইয়াবার গডফাদারদের কাছে ক্রিস্টাল মেথ সরবরাহ করা হচ্ছে।

গোয়েন্দা কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীর খোন্দকার বলেন, ‘একসময় বাজারে একটি গুঁড়ো দুধ কিনলে আরেক কোম্পানি গুঁড়ো দুধ ফ্রি পাওয়া যেত। পরে দেখা যেত, ফ্রি-তে দেওয়া কোম্পানির পণ্যই বাজার দখল করে নিয়েছে। ক্রিস্টাল মেথের ক্ষেত্রেও একই কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে। ইয়াবার সঙ্গে ডাম্পিং ভ্যালুতে ক্রিস্টাল মেথ দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের মাদক কারবারিরা সেগুলো এনে আগ্রহী লোকজনের কাছে অনেক কম দামে অথবা বিনামূল্যে সরবরাহ করছে। এটাই হচ্ছে ক্রিস্টাল মেথের বাজার তৈরির চেষ্টা।’

এই কর্মকর্তার মতে, বাংলাদেশের নিকটবর্তী দেশ থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, লাওস, চীন থেকে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত ক্রিস্টাল মেথের বিস্তৃতি ঘটেছে। সেখানে ইয়াবার ব্যবহার নেই। ফিলিপাইন বাংলাদেশের কাছাকাছি আকারের অর্থনীতির একটি দেশ। সেখানে ক্রিস্টাল মেথের ব্যবহার চলছে। মিয়ানমারের গোষ্ঠীগুলোর এখন টার্গেট হচ্ছে বাংলাদেশ।

সাবেক কূটনীতিক এমদাদুল আলম চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘মিয়ানমারের সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর টার্গেট শুধু বাংলাদেশ নয়। ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কিন্তু তারা এটি ছড়িয়ে দিতে পেরেছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশ থেকে ক্রিস্টাল মেথ উৎপাদন ও সরবরাহকারীদের মোকাবিলায় কিছু পদক্ষেপ এসেছে। তবে চেইনটা ভাঙা যায়নি, এটি বহালই আছে। আন্তর্জাতিক চাপ ছাড়া এটি নির্মূল করা যাবে না।’

ভয়ংকর মাদক ক্রিস্টাল মেথের বিস্তারের বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে র‌্যাব-৭ তাদের আটক করা তিনটি চালানের মামলায় নিজেরাই তদন্ত করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানিয়েছে।

সারাবাংলা/আরডি/টিআর

আইস ক্রিস্টাল মেথ ক্রিস্টাল মেথের বাজার মাদক আইস মাদক কারবারি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর