শুরুতে থাকলেও বছরের শেষভাগে ছিল না ‘বাংলাদেশ ভ্যারিয়েন্ট’
৩ জানুয়ারি ২০২২ ১২:১৭
ঢাকা: চীনের উহানে নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শনাক্ত হলেও খুব অল্পসময়েই তা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ২০২০ সালের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথমবারের মতন তিনজনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এরপরে ধীরে ধীরে সারাদেশেই এই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। বিগত দুইবছরে বিশ্বজুড়েই নানাভাবে রূপ পাল্টাতে থাকে কোভিড-১৯ ভাইরাস। এই রূপ পরিবর্তনের উৎপত্তি ঘটে নানা দেশে। পরবর্তীতে তা ছড়াতে থাকে অন্যান্য দেশেও। বাংলাদেশেও এমন একটি রূপ পরিবর্তন দেখা যায় ২০২০ সালের শেষ ভাগে, যা পাওয়া যায় ২০২১ সালের শুরুর দিকেও।
দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণের প্রথম ওয়েভ (৮ মার্চ, ২০২০ থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২১) চলাকালীন জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের তথ্য বলছে, এই সময়ে আধিপত্য বিস্তার করেছে B.1.1.25 ভ্যারিয়েন্ট। বেশিমাত্রায় প্রাধান্য বিস্তার করার কারণে একে বলা হয় ‘বাংলাদেশ লাইনেজ’ বা ‘বাংলাদেশ ভ্যারিয়েন্ট’।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি বাংলাদেশের অন্যতম একটি ভ্যারিয়েন্ট। যুক্তরাজ্যে প্রথম শনাক্ত হলেও জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ে দেখা যায়, B.1.1.25 ভ্যারিয়েন্ট সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে বাংলাদেশে। আর তাই একে ‘বাংলাদেশ ভ্যারিয়েন্ট’ও বলা হয়ে থাকে। তবে স্বস্তির বিষয় হলো— ২০২১ সালের মে মাসের পর আর দেশে এই ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া যায়নি। এই সময়ে আলফা ও ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের কারণে দুর্বল হয়ে পড়ে বাংলাদেশ ভ্যারিয়েন্ট।
বৈশ্বিক অনলাইন ডাটাবেজ জিআইএসএইড-এ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের তথ্য আপলোড করা হয়ে থাকে। গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডাটা (জিআইএসএইড) জার্মান সরকারের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান।
২৯ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠানটির এপিকভ দলের সদস্য রাফায়েল সারাবাংলাকে বলেন, বাংলাদেশ থেকে এখন পর্যন্ত তিন হাজার ৮০৮টি সিকোয়েন্সিং ফলাফল জমা হয়েছে জিআইএসএইডে। এর মাঝে ১১১টি ছিল প্যাঙ্গো লাইনেজের। ২০২০ সালে বাংলাদেশে সংক্রমণ শুরুর পরের যদি একটি টাইমলাইন আকারে দেখা হয়, তবে প্রথম ১০টি লাইনেজের মাঝে অন্যতম একটি হলো B.1.1.25।
২০২০ সালের ৩১ মার্চ যুক্তরাজ্যে সংগ্রহ করা একটি নমুনায় প্রথমবারের মতো B.1.1.25 বা বাংলাদেশ ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া যায়। এরপর জার্মানি ও যুক্তরাজ্যে ১ এপ্রিল সংগ্রহ করা কিছু নমুনার সিকোয়েন্সিংয়েও মেলে এর উপস্থিতি। প্রায় একই সময়ে এর দেখা মেলে ইতালিতেও। কাছাকাছি সময়ে ৭ এপ্রিল বাংলাদেশে প্রথম উপস্থিতি পাওয়া যায় এই ভ্যারিয়েন্ট। ওই নমুনাটি সংগ্রহ করেছিল স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। সিকোয়েন্সিংয়ের ফল জিআইএসএইড-এ আপলোড করে ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপিং সায়েন্স অ্যান্ড হেলথ ইনিশিয়েটিভস (আইদেশি)।
রাফায়েল আরও বলেন, B.1.1.25 লাইনেজটি বাংলাদেশের একটি অন্যতম ভ্যারিয়েন্ট, যা অন্য দেশে উৎপন্ন হলেও প্রভাব বিস্তার করেছে একটি সময় পর্যন্ত। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি B.1.1.25 ভ্যারিয়েন্টের তথ্য আপলোড করা হয়েছে বাংলাদেশ থেকেই। পরবর্তী সময়ে ডেল্টা ও আলফার সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এটি ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়ে।
B.1.1.25 ভ্যারিয়েন্টের বিস্তার বাংলাদেশে কীভাবে?
জিআইএসএইড পুরো বিশ্বে এখন পর্যন্ত ২০১২টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ে এই ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি দেখা যায়। এর মাঝে বাংলাদেশ থেকে ৯৮২টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ে এর উপস্থিতি দেখা গেছে।
২০২০ সালের ৭ এপ্রিল সংগ্রহ করা একটি নমুনার সিকোয়েন্সিংয়ে প্রথমবারের মতন B.1.1.25-এর উপস্থিতি পাওয়া যায়। পরে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮৩৬টি নমুনার সিকোয়েন্সিংয়ে পাওয়া গেছে এর উপস্থিতি।
২০২১ সালে ঢাকা ও সিলেট থেকে সংগ্রহ করা নমুনায় এই ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি পাওয়া যায়। এই নমুনাগুলোর সিকোয়েন্সিং তথ্য জিআইএসএইডে আপলোড করে চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন (সিএইচআরএফ)। ২০২১ সালের ১৮ মে সংগ্রহ করা একটি নমুনার সিকোয়েন্সিংয়ে শেষবারের মতো B.1.1.25-এর উপস্থিতি দেখা যায়। এ বছরে মোট ১৪৬টি নমুনায় পাওয়া গেছে এর উপস্থিতি।
এর আগে, ২০২০ সালের ১১ মে দেশে প্রথমবারের মতো জিআইএসএইডে কোভিড-১৯ নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সিং তথ্য আপলোড করে চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন। ২২ বছর বয়সী এক তরুণীর নমুনাটি সংগ্রহ করা হয়েছিল ১৮ এপ্রিল। এরপর ২০২১ সালের মে মাস পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে দুই হাজার ৬২টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সিং ফলাফল জমা দেওয়া হয় জিআইএসএইডে। এর মাঝে ৯৮২টি নমুনার সিকোয়েন্সিং ফলাফলে B.1.1.25 লাইনেজ দেখা যায়, যা শতকরা হিসাবে ৪৭ শতাংশ। বাংলাদেশ থেকে এখন পর্যন্ত যে তিন হাজার ৮২৮টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সিং ফলাফল জিআইএসএইডে প্রকাশিত হয়েছে তার ২৫ শতাংশেরও বেশি নমুনায় পাওয়া গেছে B.1.1.25 বা বাংলা ভ্যারিয়েন্ট।
কোথায় ও কোন বয়সসীমায় পাওয়া গেছে B.1.1.25?
নবজাতক থেকে শুরু করে ৯৫ বছর বয়সী মানুষের কোভিড-১৯ শনাক্তকরণের নমুনার সিকোয়েন্সিংয়ে B.1.1.25 লাইনেজ বা ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে সংগ্রহ করা নমুনায়— ৫২১টি।
এছাড়া সিলেট বিভাগের ৫৩টি নমুনা, রংপুর বিভাগের ৩৩টি, রাজশাহী বিভাগের ৪০টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ১৭টি ও খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলার ৪২টি নমুনায় এই ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি দেখা গেছে। এর বাইরে চট্টগ্রাম বিভাগের ১২৪টি ও বরিশাল বিভাগের ৪৫টি নমুনায় ছিল বাংলা ভ্যারিয়েন্ট।
বিশ্বের অন্যান্য দেশে B.1.1.25 ভ্যারিয়েন্টের প্রভাব
জিআইএসএইডে বিশ্বের ৩২টি দেশের করোনাভাইরাসের নমুনায় B.1.1.25 ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। ২০২২ সালের ২ জানুয়ারি পর্যন্ত এক হাজার ৯২২টি নমুনার সিকোয়েন্সিংয়ে মিলেছে এর উপস্থিতি। এর মধ্যে বাংলাদেশের পর সর্বোচ্চ ৫৮৮টি নমুনায় বাংলা ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে কানাডায়। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে ১৮৮টি, যুক্তরাজ্যে ৮৫টি, অস্ট্রেলিয়ায় ৫০টি, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৩০টি, ইতালিতে ২০টি, জাপানে ১২টি, ফ্রান্সে ৯টি এবং ডেনমার্ক, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরে ছয়টি করে নমুনায় এই ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি দেখা গেছে।
এর বাইরে ভারত ও জার্মানিতে পাঁচটি করে, ফিলিপাইনে তিনটি এবং নিউজিল্যান্ড, বাহরাইন, সাইপ্রাস ও হংকংয়ের দুইটি করে নমুনায় B.1.1.25 ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি দেখা গেছে। আর একটি করে নমুনায় বাংলাদেশ ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে সুইজারল্যান্ড, বেলজিয়াম, ইসরায়েল, দক্ষিণ আফ্রিকা, লুক্সেমবার্গ, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ওমানসহ আরও একটি দেশে।
শতকরা হিসাবে বাংলাদেশে ৪৯ শতাংশ, কানাডায় ২৯ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ৯ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে চার শতাংশ ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে দুই শতাংশ নমুনায় এই লাইনেজের উপস্থিতি দেখা গেছে।
সারাবাংলা/এসবি/একে
B.1.1.25 করোনা কোভিড-১৯ নভেল করোনাভাইরাস বাংলা ভ্যারিয়েন্ট বাংলাদেশ ভ্যারিয়েন্ট