দেড় দশকে জরায়ুমুখ ক্যানসার স্ক্রিনিংয়ে সাফল্য মাত্র ১০%
৮ জানুয়ারি ২০২২ ২১:৫৮
ঢাকা: দেশে ২০০৫ সালে ভায়া পরীক্ষাভিত্তিক জরায়ুমুখ ক্যানসারের স্ক্রিনিং কর্মসূচি শুরু হলেও গত দেড় দশকে এর সাফল্য মাত্র ১০ শতাংশ। জাতীয় ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় স্ক্রিনিং কর্মসূচি হিসেবে প্রণীত ও পরিচালিত না হওয়া, গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের সম্পৃক্ত করতে না পারা, এই স্ক্রিনিং কর্মসূচি সম্পর্কে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে না পারাসহ কয়েকটি বিষয়ে এর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
শনিবার (৮ জানুয়ারি) জরায়ুমুখ সচেতনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে এসব বিষয় উঠে এসেছে। ‘জরায়ুমুখের ক্যানসার নির্মূলে বৈশ্বিক কৌশল: বাংলাদেশ প্রেক্ষিত’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকটি জাতীয় প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত হয়। পরে অনুষ্ঠিত হয় ‘মার্চ ফর মাদার’ বা ‘জননীর জন্য পদযাত্রা’ শীর্ষক এক সচেতনতামূলক র্যালি।
জরায়ুমুখের ক্যানসার নির্মূলের বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনসহ দেশের সার্বিক ক্যানসার সেবার সুষম ও সর্বজনীন উন্নয়ন করতে ব্যাপক মাত্রার আলোচনা, পর্যালোচনা, সব অংশীজনের অংশগ্রহণ ও চলমান কার্যক্রমকে একটি জাতীয় ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় এনে ঢেলে সাজানো দরকার বলে এসব আয়োজনে মন্তব্য করেন বক্তারা।
গোলটেবিল বৈঠকে দেশে জাতীয় ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ কৌশল, কর্মপরিকল্পনা ও কর্মসূচি নেই বলে মন্তব্য করেন ক্যানসার রোগতত্ত্ববিদ ডা. মো. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন। ‘জননীর জন্য পদযাত্রা’র প্রধান সমন্বয়কারী এই চিকিৎসক বলেন, প্রথম অবস্থায় নির্ণয় হলে ও সঠিক চিকিৎসা পেলে এটি নিরাময়যোগ্য। কিন্তু দেশে পরীক্ষার হার খুবই কম।
ডা. রাসকীন বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে স্তন, জরায়ুমুখ ও মুখগহ্বরের ক্যানসার স্ক্রিনিং উন্নয়নশীল দেশেও বাস্তবায়ন সম্ভব। সে অনুযায়ী ২০০৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমইউ) উদ্যোগে ভায়া পরীক্ষাভিত্তিক জরায়ুমুখের ক্যানসার স্ক্রিনিং কর্মসূচি চালু হয়। বিভিন্ন পর্যায়ের প্রায় ৪০০ স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রে এই ভায়া সেন্টার চালু হয়েছে। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ১৫ বছরে সাফল্যের হার মাত্র ১০ শতাংশ।
স্ক্রিনিং কর্মসূচির সাফল্য না পাওয়ার কিছু কারণও চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানান ডা. রাসকীন। কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে— জাতীয় ক্যানসার নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় জাতীয় ক্যান্সার স্ক্রিনিং কর্মসূচি হিসেবে প্রণীত ও পরিচালিত না হওয়া; জাতীয় পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনদের সম্পৃক্ত না করা; প্রশিক্ষণ ও তত্ত্বাবধানসহ স্বাস্থ্যসেবার বিভিন্ন ধাপে বিকেন্দ্রীকরণ না করা; চিকিৎসাকেন্দ্রভিত্তিক অসংগঠিত স্ক্রিনিং থেকে দীর্ঘ ১৫ বছরেও সমাজভিত্তিক সংগঠিত স্ক্রিনিংয়ে উন্নীত করার জন্য পাইলট কার্যক্রম শুরু করতে না পারা; স্ক্রিনিং কেন প্রয়োজন, এটি যে ইনভেসিভ অর্থাৎ কাটাছেঁড়া বা কষ্টদায়ক কোনো পরীক্ষা নয়— এসব বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন ও উদ্বুদ্ধ করার যথেষ্ট উদ্যোগ না থাকা; পেশাজীবি, স্বেচ্ছাসেবী জাতীয় ও স্থানীয় সংগঠনগুলোকে এই কাজে সম্পৃক্ত না করা; এবং স্ক্রিনিং কোনো ক্লিনিক্যাল প্রোগ্রাম নয়, এটি একটি জনস্বাস্থ্য কর্মসূচি— কর্মসূচি প্রণয়ন ও পরিচালনার কোনো পর্যায়ে এই বিষয়টি প্রতিফলিত না হওয়া।
ডা. রাসকীন আরও বলেন, ২০১৮ সালে এই ক্যানসারে তিন লাখের বেশি নারীর মৃত্যু হয়েছে, যার ৯০ শতাংশ নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলোতে। এতে বৈশ্বিক অসাম্যের চিত্র প্রতিফলিত হয় বলে জানান তিনি। জরায়ুমুখ ক্যানসারের এই বিপুল মৃত্যুর পেছনে সবার জন্য সমান স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার ব্যবস্থা না থাকাকে দায়ী করেন তিনি।
জরায়ুমুখ ক্যানসারের চিকিৎসা প্রসঙ্গে গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা বলেন, অন্যান্য ক্যানসারের মতই জরায়ুমুখ ক্যানসারের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল। এই ক্যানসারের অধিকতর ঝুঁকিতে থাকা অস্বচ্ছল ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য এই ব্যয় নির্বাহ করা দুঃসাধ্য। দেশের বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসাব্যয় সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। আবার সরকারি চিকিৎসাসেবা রাজধানীকেন্দ্রিক হওয়ায় তাও সবার নাগালের মধ্যে নেই। ফলে সারাদেশ থেকে আগত বিপুলসংখ্যক অপেক্ষমাণ ক্যানসার রোগীর তালিকা শুধু দীর্ঘই হতে থাকে।
এর মধ্যে দেশের আটটি বিভাগীয় শহরে ১০০ শয্যার পূর্ণাঙ্গ ক্যানসার চিকিৎসা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রোববার (৯ জানুয়ারি) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন। একনেকে অনুমোদিত ডিপিপিতে অন্তর্ভুক্ত ক্যানসার প্রতিরোধ ও গবেষণাসহ ক্যানসারের সাতটি বিশেষায়িত বিভাগ চালু হলে ক্যানসার সেবা সাধারণ মানুষের নাগালের আনার একটি ধাপ অগ্রসর হবে বলে গোলটেবিল বৈঠকে আশাবাদ জানান বক্তারা।
গোলটেবিল বৈঠকে জানানো হয়, ২০১৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আহ্বানের পর ২০২০ সালের বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে ২০৩০ সালের মধ্যে জরায়ুমুখ ক্যানসার নির্মূলে তিন দফা লক্ষ্য ও কৌশল ঘোষণা করা হয়। এ ক্ষেত্রে জরায়ুমুখ ক্যানসার নির্মূলের কথা বলা হলেও প্রতি লাখে আক্রান্তের সংখ্যা চার বা এর নিচে নিয়ে আসাকে লক্ষ্য ধরা হয়েছে।
বৈশ্বিক কৌশল ছাড়াও জরায়ুমুখ ক্যানসার থেকে বাঁচার জন্য ডা. রাসকীন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেশ কিছু সচেতনতার বিষয় তুলে ধরেন। তিনি বলেন, জরায়ুমুখ ক্যানসারের প্রায় শতভাগের সঙ্গে এইচপিভি ভাইরাসের সম্পর্ক আছে। তাই এই ক্যানসারের প্রাথমিক প্রতিরোধে এইচপিভি ভ্যাকসিন প্রয়োগ অতি জরুরি। ২০১৬-১৭ সালে সরকারিভাবে গাজীপুর জেলায় ১০ বছর বয়সী প্রায় ৩১ হাজার কিশোরীকে বিনামূল্যে দুই ডোজ ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে। সারাদেশে এই কার্যক্রম এই বছর শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সেটি হয়নি। সারাদেশের কিশোরীদের (৯-১৪ বছর) এই ভ্যাকসিন নিতে উদ্বুদ্ধ করাও একটি বড় চ্যালেঞ্জ, যা সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণ ছাড়া বাস্তবায়ন করা কঠিন।
জরায়ুমুখ ক্যানসারের ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন অনুষঙ্গ যেমন— বাল্যবিয়ে, অল্প বয়সে সন্তানধারণ, অনেক সন্তানের মা হওয়া, ঘন ঘন সন্তান প্রসব, ব্যক্তিগত অপরিচ্ছন্নতা— গোলটেবিল বৈঠকে এসব বিষয়েও সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন বক্তারা।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন গাইনি অনকোলজিস্ট ও কমিউনিটি অনকোলজি সেন্টার ট্রাস্টের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সাবেরা খাতুন। প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। প্যানেল আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ডা. হালিদা হানুম আখতার, ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজের অধ্যাপক সারিয়া তাসনিমসহ অন্যরা।
আলোচনা শেষে ‘জননীর জন্য পদযাত্রা’ ও তথ্যসমৃদ্ধ লিফলেট বিতরণ করা হয় প্রেস ক্লাব থেকে বিজয়নগর, কাকরাইল, মালিবাগ হয়ে মগবাজার চৌরাস্তা পর্যন্ত।
জানুয়ারি মাসকে জরায়ুমুখ ক্যানসার সচেতনতা মাস হিসেবে পালনের পাশাপাশি ২০১৮ সাল থেকে জানুয়ারির দ্বিতীয় শনিবার বাংলাদেশে বেসরকারিভাবে জরায়ুমুখ ক্যানসার সচেতনতা দিবস পালন করে আসছে মার্চ ফর মাদার (জননীর জন্য পদযাত্রা) নামের প্ল্যাটফর্ম। দিবস উদযাপনের অংশ হিসেবে ১৭টি সংগঠনের সমন্বয়ে গোলটেবিল আলোচনা, পদযাত্রা ও লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি পালন করা হয়।
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর
জননীর জন্য পদযাত্রা জরায়ুমুখ ক্যানসার জরায়ুমুখ ক্যানসার সচেতনতা দিবস মার্চ ফর মাদার