আসন কমানোর সিদ্ধান্ত— ঢাবি’র বিবেচনায় নিড বেজড এডুকেশন-গবেষণা
৮ জানুয়ারি ২০২২ ২৩:৫৩
আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে প্রায় এক হাজার আসন কমানোর সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে দেশের অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিই তাদের লক্ষ্য। তবে ঢাবি কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্তের সমালোচনা রয়েছে নানা মহলে। অবকাঠামো সম্প্রসারণসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রার সঙ্গে এমন সিদ্ধান্ত সাংঘর্ষিক— রয়েছে এমন মন্তব্যও।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়াশীল সংগঠনগুলো বলছে, এই সিদ্ধান্ত গণবিরোধী। শ্রেণিকক্ষের আকার, সংখ্যা তথা অবকাঠামোগত দুর্বলতা— এসব বিষয়কে কারণ হিসেবে দেখিয়ে আসন কমানোর সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, ‘নিড বেইজড এডুকেশন’ এবং গবেষণায় জোর দেওয়ার বিষয়টিকে মাথায় রেখেই তারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মাধ্যমে গবেষণাকেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠার পাশাপাশি দক্ষ জনবল গড়ে তোলাও সম্ভব হবে।
কেন ঢাবি প্রশাসন আসনসংখ্যা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে— এ বিষয়ে সারাবাংলার সঙ্গে সবিস্তারে আলাপ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল। দীর্ঘ আলাপে নীতিগত জায়গা থেকে মূলত দুইটি বিষয়কেই গুরুত্ব দেওয়ার কথা জানিয়েছেন তিনি। প্রথমত, ডিগ্রিধারী তৈরির বিপরীতে ‘নিড বেজড এডুকেশন’ বা প্রয়োজনভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে চায় ঢাবি প্রশাসন। দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয়টিকে একটি গবেষণাকেন্দ্রে পরিণত করার লক্ষ্য তাদের।
‘নিড বেজড এডুকেশন’ বা প্রয়োজনভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার কথা তুলে ধরে ড. মাকসুদ কামাল বলেন, শিক্ষার্থী কমানো বা বাড়ানো নয়— নীতিগতভাবে আমরা মূলত ‘নিড বেজড এডুকেশনে’র দিকে যাচ্ছি। অবকাঠামো বা ফ্যাসিলিটি এখনো কম আছে। তাছাড়া উন্নত দেশগুলোতে সবাই উচ্চশিক্ষায় আসেও না। দেখা যায়, ইন্টারমিডিয়েট পাসের পর একটি ডিপ্লোমা করে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে। তাছাড়া এখন বিশ্বব্যাপী গবেষণা খাতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সেভাবে মানসম্মত গবেষণার উপযোগী আকার রেখেই শিক্ষার্থী সংখ্যা নির্ধারণ করা হবে। এক হাজার শিক্ষার্থী কম ভর্তি করার বিষয়ে প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা আরও আলাপ-আলোচনা করব।
ফারসি ভাষা ও সাহিত্য, উর্দু, সংস্কৃত ও পালি— বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালের সঙ্গী এই চার বিভাগে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ১৮শ। শিক্ষকসহ কর্মকর্তা-কর্মচারী ৫০ জনেরও বেশি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই বিভাগগুলো প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে— সাবেক ঢাবি উপউপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নাসরিন আহমেদও এমন প্রশ্ন তুলেছিলেন। এসব বিভাগ নিয়ে একই ধরনের পর্যবেক্ষণের কথা জানালেন বর্তমান উপউপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামালও। এর বিপরীতে আবার কিছু কিছু বিভাগে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন হলেও অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে সেটি সম্ভব হচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি।
অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বলেন, ‘বৈশ্বিক চাহিদা (গ্লোবাল নিড) ফুরিয়ে গেছে— এমন অনেকগুলো বিভাগ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আছে। এগুলোতে প্রতিবছর অনেক শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়। পাস করার পর অনেকেই চাকরি না পেয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। উচ্চ শিক্ষা মানেই তো মানবসম্পদ উন্নয়ন করা, মানবসম্পদ নষ্ট করা নয়। উর্দু-ফার্সি-সংস্কৃত-পালি ছাড়াও এরকম অনেক বিভাগ আছে। এই বিভাগগুলোর যে প্রয়োজনীয়তা একেবারে ফুরিয়ে গেছে বলা না গেলেও শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয় অনেক বেশি। অথচ ফার্মেসি বা কম্পিউটার সায়েন্সের মতো বিভাগগুলোতে শিক্ষার্থী বাড়ানো প্রয়োজন। কিন্তু অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে চাইলেও সেসব বিভাগে শিক্ষার্থী বাড়াতে পারছি না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন কমানোর আলোচনায় যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে সেটি হলো— গত এক থেকে দেড় দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত সম্প্রসারণ হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়কে ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে মাস্টারপ্ল্যান। এর আওতায় আরও বেশি অবকাঠামোগত উন্নয়নের পরিকল্পনা রযেছে। যেখানে অবকাঠামোগত সক্ষমতা বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলমান, সেখানে আসন সংখ্যা কমানোর সিদ্ধান্ত কেন?— এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ড. মাকসুদ কামাল বলেন, মাস্টারপ্ল্যানের পরিকল্পনাও নতুন এই সিদ্ধান্তের কথা মাথায় রেখেই করা হয়েছে।
তিনি বলেন, মূল বিষয়টি হলো প্রয়োজনভিত্তিক শিক্ষা। এগুলো বিবেচনা করেই মাস্টারপ্ল্যান নেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে আমাদের যে অবকাঠামো হবে, সেই অবকাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই এক হাজার করে কম শিক্ষার্থী ভর্তি করানোর কথা ভাবা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়কে ধীরে ধীরে মানসম্মত জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। শিক্ষার্থীরা এখানে পড়তে আসার পর যে এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিজ সুবিধা পাওয়ার কথা, সেগুলো ঠিকঠাক পাচ্ছে না। সবকিছু বিবেচনায় রেখেই এই সিদ্ধান্ত।
বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩টি অনুষদের অধীনে বিভাগের সংখ্যা ৮৩টি। রয়েছে আরও ১৩টি বিশেষায়িত অনুষদ। এসব বিভাগ ও অনুষদে প্রতিবছর সাত হাজারের কিছু বেশি ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। মাস্টারপ্ল্যানে শিক্ষার্থী কমানোর বিবেচনা থাকলে গত এক-দেড় দশকে তাহলে বছর বছর কেন বিভিন্ন বিভাগে আসন বেড়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে ড. মাকসুদ কামাল বলছেন, বছর বছর শিক্ষার্থী বাড়ানোর এই সিদ্ধান্তটি সঠিক ছিল না বলেই মনে করেন তিনি। এর ফলে ‘সন্তোষজনক শিক্ষা’ দেওয়া সম্ভব হয়নি বলেও মত তার।
তিনি বলেন, শিক্ষার্থী ঠিকই ভর্তি করানো হয়েছে। কিন্তু ‘অপটিমাম লেভেলে’র এডুকেশন তো দেওয়া যায়নি। বছর বছর শিক্ষার্থী বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত ছিল, সেগুলো সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল না। শিক্ষার্থীরা যদি ঠিকঠাক বসতে না পারে, ক্লাসরুমে যদি মাইক ব্যবহার করতে হয়, তাহলে তো শিক্ষকের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের ঠিকঠাক ইন্টার্যাকশন হয় না। ফলে সেই শিক্ষা পরিপূর্ণও হয় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এখনো গবেষণাধর্মী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলা যায়নি— এমন অভিযোগ সবারই। সে অভিযোগের সঙ্গে একমত অধ্যাপক ড. মাকসুদ কামাল এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আর সে কারণেই এখন বিশ্ববিদ্যালয়কে গবেষণামুখী করে তোলার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আমরা এখনো গবেষণাধর্মী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তুলতে পারিনি। একে আমরা ডিগ্রি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবেই দেখছি। গবেষণার দিকে আমাদের দৃষ্টি কম ছিল। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা যেন গবেষণার দিকে দৃষ্টিপাত করতে পারে, সে দিকটিও বিবেচনা করতে হবে।
গবেষণার সুযোগের সঙ্গে শ্রেণিকক্ষের শিক্ষার্থী সংখ্যাও ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলেই মনে করছে ঢাবি কর্তৃপক্ষ। শিক্ষার্থী সংখ্যা কমলে অর্থাৎ শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাত উন্নত হলে শিক্ষার্থীদের গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি শিক্ষকরা গবেষণায় বেশি মনোযোগী হতে পারবেন মনে করছে তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের আসনসংখ্যা কমানোর পেছনে এটিকেও একটি বড় বিবেচনা হিসেবে উল্লেখ করছেন উপউপাচার্য অধ্যাপক মাকসুদ কামাল।
তিনি বলেন, কোন দেশে কতটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে— এটি নয়, বরং কোন দেশে কতটি মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, সেটিই এখনকার বড় বিবেচ্য বিষয়। আমাদের শিক্ষার্থী-শিক্ষক অনুপাত এখনো প্রায় ২০:১। অর্থাৎ, প্রতি ২০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে রয়েছেন এক জন শিক্ষক। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতেও এই অনুপাত সম্ভবত ১৫:১। শিক্ষার্থী-শিক্ষকের এই অনুপাত কমিয়ে গবেষণা বাড়ানো ও গবেষণা তদারকির কথা চিন্তা করলেও কিন্তু আমাদের শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমানোর সিদ্ধান্তই নিতে হবে। কারণ শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় আমাদের কোনো কোনো বিভাগে দুইটি বা তিনটি পর্যন্ত সেকশন আছে। এত শিক্ষার্থীকে পড়িয়ে আর গবেষণায় মনোযোগ দেওয়া সম্ভব? সারাদিনের ১০-১২ ঘণ্টা পাঠদান, খাতা দেখা, প্রশ্ন করার কাজে ব্যয় করলে গবেষণায় সময় দেবেন কখন? তাছাড়া এখন গবেষণা খাতে বরাদ্দও বেশি আসছে। ফলে আমরা গবেষণাকে প্রাধান্য দিতে চাই। বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ ঘিরেও এই লক্ষ্যের কথাই আমরা জানিয়েছি।
দেশে উচ্চ শিক্ষা নেওয়ার উপযোগী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে অধ্যাপক মাকসুদ কামাল বলেন, একসময় দেশে মাত্র ছয়-সাতটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। এখন তো অনেক বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, প্রায় ৫০টির মতো বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে গেছে। উচ্চ শিক্ষার সুযোগ এখন বেড়ে গেছে। একসময় যখন উচ্চ শিক্ষার সুযোগ কম ছিল, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই দায়িত্বটি নিয়েছিল। এখন অন্যদেরও সেই দায়িত্ব নিতে হবে।
এদিকে, ২০১৭ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর সরকারি সাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান— ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। এই কলেজগুলোতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা আড়াই লাখের বেশি। অধিভুক্ত করার পর থেকেই সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা ঢাবির নানা অব্যবস্থাপনার কথা জানিয়ে আসছেন। সময়ে সময়ে আন্দোলনেও নেমেছেন তারা।
সাত কলেজের প্রায় আড়াই লাখ শিক্ষার্থীর দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে নিজেদের আসনসংখ্যা কমানোর সিদ্ধান্ত কেন— এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ড. মাকসুদ কামাল বলেন, সাত কলেজকে অপরিকল্পিতভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে নেওয়া হয়। যারা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ভর্তি হয়েছে, পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয়-তৃতীয় বর্ষ পাশ করেছে, হুট করে মাঝপথে তাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আনার কোনো কারণ ছিল না। এসব কারণে কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়েছিল। এখন পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে আসছে। তাই সাত কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়টি এক নয়।
সারাবাংলা/আরআইআর/টিআর
আসন কমানোর সিদ্ধান্ত উপউপাচার্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঢাবি ঢাবি প্রশাসন