Saturday 28 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘ভুলে’ নেত্রনালীর বদলে চোখের ছানি অস্ত্রোপচার

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১০ জানুয়ারি ২০২২ ১৫:৩৫

ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রাম ব্যুরো: নেত্রনালী অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে এক পোশাক কর্মীর চোখের ছানি অপারেশন করে কৃত্রিম ল্যান্স লাগিয়ে দিয়েছেন এক চিকিৎসক। এর ফলে ওই তরুণী এখন দুই চোখের দৃষ্টিশক্তি হারানোর শঙ্কায় পড়েছেন।

চট্টগ্রাম নগরীর খুলশী থানার জাকির হোসেন সড়কে লায়ন্স চক্ষু হাসপাতালে গত শনিবার (৮ জানুয়ারি) এ ঘটনা ঘটেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, একই নামে দুই রোগী থাকায় ভুল হয়েছে, ইচ্ছাকৃতভাবে চোখের ছানি অপারেশন করা হয়নি।

বিজ্ঞাপন

‘ভুল চিকিৎসার’ শিকার ১৮ বছর বয়সী হালিমা চট্টগ্রাম নগরীতে একটি সোয়েটার কারখানায় কর্মরত আছেন। বাসা নগরীর দেওয়ানহাট এলাকায়। বাড়ি চাঁদপুর জেলায়।

হালিমার ভাই আবুল হোসেন আকাশ বাদি হয়ে রোববার (৯ জানুয়ারি) নগরীর খুলশী থানায় চিকিৎসক মিজানুল হকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন। মামলায় অভিযুক্ত চিকিৎসক মিজানুল হক ছাড়াও অজ্ঞাতনামা ৩-৪ জন ডাক্তার-নার্সকে আসামি করা হয়েছে। মিজানুল হক লায়ন্স চক্ষু হাসপাতালে চাকরির পাশাপাশি নগরীর বন্দরটিলায় ব্যক্তিগত চেম্বারে রোগীদের চিকিৎসা দেন বলে জানা গেছে।

আবুল হোসেন আকাশ সারাবাংলাকে জানান, মাসখানেক আগে হালিমা পড়ে গিয়ে নাকে ব্যাথা পান। এতে তার নেত্রনালীতে সমস্যা হয়। গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর নেত্রনালীর সমস্যা নিয়ে তিনি লায়ন্স চক্ষু হাসপাতালের চিকিৎসক ফারহানা আফরোজের শরণাপন্ন হন। প্রাথমিক চিকিৎসার পর ডাক্তার তাকে নেত্রনালী অস্ত্রোপচার করতে হবে জানিয়ে চিকিৎসক মিজানুল হকের কাছে পাঠান।

মিজানুল হক পরীক্ষানিরীক্ষার পর ৮ জানুয়ারি অস্ত্রোপচারের সময় এবং ছয় হাজার টাকা খরচ নির্ধারণ করে দেন। যথারীতি গত শনিবার (৮ জানুয়ারি) হালিমা হাসপাতালে ভর্তি হন। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে হাসপাতালের তৃতীয় তলায় অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়। অস্ত্রোপচার শেষে বেরিয়ে চিকিৎসক মিজানুল হক হালিমার মাকে ১৫ হাজার টাকা অপারেশনের বিল জমা দিতে বলেন।

বিজ্ঞাপন

আবুল হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ সময় আমার মা আগে ছয় হাজার টাকা নির্ধারণ হওয়ার কথা জানালে মিজানুল বলেন- আপনার মেয়ের চোখে ল্যান্স লাগানো হয়েছে, এর দাম ১৫ হাজার টাকা। আমার মা প্রতিবাদ করলে ডাক্তার ভুল হয়েছে বুঝতে পেরে সেখান থেকে সরে যান। পরে একজন নার্স আমার বোনকে গিয়ে বলেন, আপনার জন্য তিন হাজার টাকা ছাড় দেওয়া হয়েছে। ততক্ষণে আমার বোনের চোখে জ্বালা শুরু হয়ে যায়। খবর পেয়ে আমি হাসপাতালে ডাক্তার মিজানুল হকের কাছে গিয়ে নেত্রনালীর বদলে চোখের ছানি কেন অপাারেশন করা হল জানতে চাই। তিনি আমাকে পাত্তাই দেননি। আরও কয়েকজন সিনিয়র ডাক্তার ও অফিসারের কাছে যাই। ওনারা আমাকে বের করে দেন।’

‘আমি যখন সাংবাদিক এবং পুলিশ ডাকার কথা বলে হইচই শুরু করি, তখন মিজানুল দ্রুত হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যায়। আমি খুলশী থানায় গিয়ে মৌখিক অভিযোগ করে আবার হাসপাতালে আসি। তখন কয়েকজন সিনিয়র ডাক্তার আমাকে ডেকে বলেন যে, হালিমা নামে দু’জন রোগী ভর্তি থাকায় ভুল হয়েছে। আমার বোনকে সুস্থ করে তোলার যাবতীয় দায়িত্ব নেওয়ার কথা ওনারা জানিয়েছেন। এতে আমাদের কোনো খরচও দিতে হবে না বলে জানিয়েছেন। কিন্তু আমি ডাক্তারের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। তার বিচার হতে হবে। আমার বোনের চোখ যদি নষ্ট হয়ে যায়, এর দায় কে নেবে? ডাক্তারদের নিতে হবে’- বলেন আবুল হোসেন।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য অভিযুক্ত চিকিৎসক মিজানুল হকের মোবাইলে কল করেও তাকে পাওয়া যায়নি। সহকারী পরিচয় দিয়ে একজন কল গ্রহণ করে ‘মিজানুল হক বাইরে আছেন’ বলে জানান।

তবে এই ‘ভুল চিকিৎসা’ নিয়ে লায়ন্স চক্ষু হাসপাতালসহ চক্ষুরোগ বিষয়ের চিকিৎসকদের সংগঠনে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। গত দুইদিন ধরে চিকিৎসকদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে বলে জানা গেছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চক্ষুরোগ বিষয়ের এক চিকিৎসক সারাবাংলাকে বলেন, ‘চোখের চিকিৎসা খুবই সেনসিটিভ। কারও নেত্রনালীতে যদি সমস্যা থাকে, সেটির চিকিৎসা না করে কোনোভাবেই চোখের ছানি অপারেশন করা যাবে না। এতে সংক্রমণ হয়ে চোখ নষ্ট হয়ে যাবার আশঙ্কা থাকে। মিজানুল হক যে ভুল করেছেন সেটি শুধু ভুল নয়, অপরাধ। কারণ, অপারেশনের নিয়মই হচ্ছে ডাক্তার অপারেশন টেবিলে রোগীর নাম-ঠিকানা নিজে জিজ্ঞেস করে রোগের হিস্ট্রি দেখে নিশ্চিত হয়ে তারপর অপারেশন শুরু করবেন। এই ভুল কোনোভাবেই ক্ষমাযোগ্য নয়। এছাড়া চট্টগ্রামে চক্ষুরোগের চিকিৎসার ক্ষেত্রে লায়ন্স চক্ষু হাসপাতালের সুনাম আছে। এই ঘটনার কারণে হাসপাতালটির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে।’

জানতে চাইলে লায়ন্স চক্ষু হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সেক্রেটারি ডা. দেবাশীষ দত্ত সারাবাংলাকে বলেন, ‘একটা ভুল হয়ে গেছে, এটা অস্বীকার করতে পারব না। তবে ভুলটা ইচ্ছাকৃত নয়। হালিমা নামে দু’জন রোগী ছিলেন। একজনের নেত্রনালীতে সমস্যা, আরেকজন চোখের ছানি অপারেশনের জন্য গিয়েছিলেন। ভুল করে নেত্রনালীর জায়গায় চোখের ছানি অপারেশন করা হয়েছে। তবে আমরা বিষয়টি জানতে পেরে সিনিয়র কনসালটেন্ট দিয়ে রোগীকে সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানে রেখেছি। আমি নিজেও গিয়ে দেখেছি। এখন খুব বেশি সমস্যা নেই। রোগীর যাতে কোনো ধরনের সমস্যা না হয়, সেই ব্যবস্থা আমরা করেছি।’

অভিযুক্ত চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা ব্যবস্থাপনা কমিটি বসে তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের একাডেমিক পরিচালক দেশের বাইরে আছেন। ওনার সঙ্গে কথা বলে সিনিয়রদের দিয়ে একটি তদন্ত কমিটি করব। আমাদের ভুল কোথায়, ভবিষ্যতে আর যাতে ভুল না হয় সেজন্য কি পদক্ষেপ নেওয়া যায়- এসব বিষয় তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।’

জানতে চাইলে নগরীর খুলশী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সন্তোষ কুমার চাকমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘নেত্রনালীর বদলে চোখের ছানি অপারেশনের অভিযোগ এনে একজন ডাক্তারের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ৩-৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। ভুল চিকিৎসার শিকার রোগীর ভাই মামলা করেছেন। আমরা অভিযুক্তদের গ্রেফতারের চেষ্টা করছি।’

সারাবাংলা/আরডি/এনএস

চট্টগ্রাম চোখের ছানি অস্ত্রোপচার টপ নিউজ নেত্রনালী অস্ত্রোপচার লায়ন্স চক্ষু হাসপাতাল

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর