ঢাকা: রোগীদের সার্বক্ষণিক সেবা নিশ্চিত করার জন্য কাজের গতি বাড়াতে আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজে (ঢামেক) দরপত্র দাখিলের তারিখ নির্ধারণ করা ছিল আজ সোমবার (১০ জানুয়ারি)। পূর্বঘোষিত কর্মসূচি হিসেবে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়ন মিছিল নিয়ে এই নিয়োগের প্রতিবাদ জানায়। এসময় ঢামেক ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা তাদের প্রতিগত করতে গেলে দুই পক্ষের মধ্যে হট্টগোলের তৈরি হয়। উভয় পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনায় হাসপাতালের এক কর্মচারী আহতও হয়েছেন।
এদিকে, দুই পক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় ঢামেক হাসপাতালের নতুন ভবনে থাকা রোগীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। অনেকে লুকানোর চেষ্টা করেন। অনেক রোগী বেড ছেড়ে বিভিন্ন রুমে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করেন।
সোমবার (১০ জানুয়ারী) সকালে ঢামেক ছাত্রলীগ ও হাসপাতালের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের মধ্যে এই ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সকাল সাড়ে ১১টা থেকে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা ধরে দুই পক্ষের মধ্যে এই ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া চলে।
হাসপাতালের সেবা গতিশীল করতে আউটসোর্সিং জনবল নিয়োগের প্রক্রিয়া চালু রয়েছে আগে থেকেই। তবে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়ন বরাবরই এর বিরোধিতা করে আসছে। গতকাল রোববারও (৯ জানুয়ারি) কর্মচারী ইউনিয়নের নেতারা আউটসোর্সিং জনবল নিয়োগের বিরোধিতা করে বিক্ষোভ করেন। আজ সোমবার তারা অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন বলে ঘোষণা দেন গতকাল রোববারই।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, অধ্যক্ষের কক্ষে টেন্ডার জমা দেওয়ার সময় কর্মচারী ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ শুরু করেন। কিছুক্ষণ পর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা স্লোগান দিয়ে কর্মচারীদের ধাওয়া দিয়ে হাসপাতাল প্রবেশ করে। ১০৮ ও ১০৯ নম্বর মহিলা ওয়ার্ডে ঢুকে এক কর্মচারীকে মারধরও করে। কর্মচারীরা ওয়ার্ডের কলাপসিবল গেট বন্ধ করে ছাত্রলীগ নেতাদের অবরুদ্ধ করেন। এ সময় ভেতর ও বাইরে দুই পক্ষ স্লোগান দিতে থাকে। হাসপাতালে হট্টগোলে ওয়ার্ডে ভর্তি রোগী ও তাদের স্বজনদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে।
পরে ঢামেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. টিটো মিঞা ও হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসে পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে আনেন। এসময় হাসপাতালে পুলিশ থাকলেও তাদের কোনো ভূমিকা দেখা যায়নি। পরে অধ্যক্ষের কক্ষে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি আবু সাঈদসহ পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলে আউটসোর্সিং নিয়োগের বিষয়টি সুরাহা করে। চতুর্থ শ্রেণির ১০০ জন কর্মচারীকে আউটসোর্সিং পদ্ধতিতেই নিয়োগ দেওয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।
অভিযোগ রয়েছে, রাজস্ব খাত থেকে হাসপাতালে নিযুক্ত কর্মচারীরা অনেক সময় কাজে ফাঁকি দেন। রাজস্ব থেকে নিয়োগে তাদের বিরুদ্ধে বাণিজ্যেরও অভিযোগ রয়েছে। আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে জনবল নিযুক্ত হলে রাজস্ব খাতের কর্মচারীরা তাদের ওপর প্রভাব খাটাতে পারেন না বলেও তারা আউটসোর্সিং নিয়োগ চান না বলে অভিযোগ হাসপাতালেরই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের।
চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি আবু সাঈদ অবশ্য এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, এসব মিথ্যা কথা। আমরা প্রতিদিন কর্মস্থলে থেকে কাজ করি। ঢামেকে হাজার লোক আসে। তাদের সেবা দেওয়ার বিপরীতে আমাদের জনবল অনেক কম। ফলে কাজে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগই নেই।
নিয়োগে বাধা প্রসঙ্গে আবু সাঈদ বলেন, আমরা শুধু প্রতিবাদ করেছি। একই হাসপাতালে দুই ধরনের কর্মচারী থাকলে সাংঘর্ষিক হয়। যারা আউটসোর্সিংয়ে কাজ করেন, তারা বেশি লাভের আশায় অনৈতিক কাজে ব্যস্ত থাকেন। তখন হাসপাতালে কাজ না করার দায়-দায়িত্ব এসে আমাদের ওপরই পড়ে। তাই আমরা রাজস্ব খাতের শূন্য পদে জনবল নিয়োগ চাই।
এ বিষয়ে ঢামেক শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জাকিউল ইসলাম ফুয়াদ বলেন, জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে কলেজের সামনে তার প্রতিকৃতিতে ফুল দেওয়ার সময় সেখানে অবস্থানরত চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের একটি দল আমাদের ওপর চড়াও হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমাদের আশ্বস্ত করেছে, দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) ডা. আশরাফুল আলম জানান, একটি ভুল বোঝাবুঝির ঘটনা ঘটেছে। হাসপাতাল পরিচালক ও কলেজ অধ্যক্ষসহ অন্যরা ১০৯ নম্বর ওয়ার্ডের সামনে গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেন। একপর্যায়ে হাসপাতাল পরিচালক আজকের এই পরিস্থিতির জন্য কেউ দোষী হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢামেক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. দেবেশ চন্দ্র তালুকদার বলেন, কলেজের সামনে আউটসোর্সিংয়ের প্রতিবাদে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছিলেন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা। এ সময় কলেজের ভেতরে জাতির পিতার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস পালন করছিল ছাত্ররা। তখন তাদের মধ্যে কিছু একটি বিষয় নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়। তার জের ধরেই হাসপাতালে ১০৯ নম্বর ওয়ার্ডের গেট বন্ধ করে দুই পক্ষ অবস্থান নেয়। তখন আমরা সেখানে গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেই। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, আজকের এই পরিস্থিতিতে দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এদিকে, হাসপাতালের বেশ কয়েকজন ঊর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, বর্তমানে ঢামেক হাসপাতালে তিন হাজার চিকিৎসক ও তিন হাজার নার্স কাজ করছেন। এর বিপরীতে হাসপাতালে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী (রাজস্ব) রয়েছেন ৩০০ জন, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী (রাজস্ব) রয়েছেন ৮০০ জন। এছাড়া পাঁচ থেকে ছয়শ জনকে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা কাজ করলে টাকা পান, না করলে পান না।
হাসপাতাল কর্মকর্তারা বলছেন, রাজস্ব খাতে থাকা কর্মচারীরা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করেন না। তারা নানা অজুহাতে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন। সময়মতো তাদের পাওয়া যায় না। রোগীদের সেবা দেওয়ার পরিবর্তে অন্য কাজে ব্যস্ত থাকেন। কেউ কেউ আবার অন্যকে দিয়ে কাজ করান।
কর্মকর্তারা বলেন, এসব কারণেই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় রোগীদের সেবার মান বাড়াতে আউটসোর্সিং পদ্ধতিতে কর্মচারী নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। এই পদ্ধতিতে নিয়োগ পাওয়া কর্মচারীরা কাজ না করলে টাকা পাবেন না। ফলে তাদের মধ্যে ঠিকমতো দায়িত্ব পালনের প্রবণতা বেশি।
কর্মচারী ইউনিয়ন কেন এই নিয়োগের বিরোধিতা করছে— এমন প্রশ্নের উত্তরে ঊর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেন, কর্মচারী ইউনিয়নের প্রতিবাদের মূল কারণ আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে জনবল নিয়োগ হলে তাদের অবস্থান থাকবে না। তারা অন্যদের দিয়ে কাজ করিয়েছেন, সেখানে নতুন কাজের লোক আসবে। ফলে তারা অন্যদের দিয়ে কাজ করিয়ে নিজেরা ফাঁকি দিতে পারবেন না। তাছাড়া রাজস্ব খাত থেকে নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগও রয়েছে। মূলত পছন্দের লোকদের নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ না থাকার কারণেই কর্মচারী ইউনিয়নের নেতারা আন্দোলন করছেন।