Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভর্তুকির চাপ সামলাতে গ্যাস-বিদ্যুৎ-সারের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব

ঝর্ণা রায়, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১১ জানুয়ারি ২০২২ ১৪:০২

ঢাকা: ভর্তুকির চাপ সামলাতে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারের দাম বাড়ানোর চিন্তা করছে সরকার। গ্যাস ও বিদ্যুতের পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়াতে ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো একটি প্রস্তাব তৈরি করেছে, যা শিগগিরই পাঠানো হবে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে (বিইআরসি)। এসকল প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আন্তজার্তিক বাজারে জ্বালানির দাম ঊর্ধ্বমুখী, বাড়তি রয়েছে তরলীকৃত গ্যাসের দামও। যার চাপ পড়ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়তি রয়েছে সারের দাম।এমন পরিস্থিতিতে মূল্য সমন্বয় করার বিকল্প দেখছে না সরকার।

তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি বাবদ মোট বরাদ্দ রাখা হয় ৪৯ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং শিল্প মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গ্যাস-বিদ্যুৎ-সারের জন্য চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো বলছে, এই তিন খাতে বরাদ্দ দরকার ৭০ হাজার কোটি টাকা। এই ৫৮ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি কোনোভাবে মেটানো সম্ভব নয়। যে কারণে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়াতে চায় সরকার। এজন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো দাম বাড়াতে ইতোমধ্যে প্রস্তাব তৈরি করেছে। শিগগিরই সেটা বিইআরসিতে পাঠানো হবে।

জানা গেছে, জ্বালানি খাতে সরকার ভর্তুকি দেয় ৪ হাজার কোটি টাকা। ইতোমধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয় দুই হাজার কোটি টাকা ছাড় করেছে। কিন্তু এলএনজি আমদানি করতে সরকারের এই মুহূর্তে প্রয়োজন ১৬০০ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট বিভাগ বলছে, জ্বালানি খাতে সরকার যে বরাদ্দ দিচ্ছে তা দিয়ে কোনোভাবেই এই ঘাটতি মেটানো সম্ভব না। সেজন্য গত নভেম্বরে ৯ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা ভর্তুকি চেয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। একদিনে আমদানি করা গ্যাসের দাম বাড়তি, অন্যদিকে এ খাতে ভর্তুকি কম। এই দুই বিষয়কে সামনে রেখেই জ্বালানির দাম বাড়ানোর চিন্তা করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গ্যাসের দাম বাড়লে এর প্রভাব পড়বে বিদ্যুতের ওপর। কারণ দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রায় পুরোটাই জ্বালানি নির্ভর। দেশের ৭০ ভাগ বিদ্যুৎ আসে গ্যাস থেকে। বাকি প্রায় ৩০ ভাগই উৎপাদন হয় তেল থেকে। সামান্য কিছু আসে নবায়নযোগ্য থেকে। জ্বালানির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এই দুই খাতেই পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়াতে চায় সরকার।

সূত্র জানিয়েছে, দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে পাইকারি বিদ্যুৎ কিনে নেয় বাংলাদেশ বিদুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। পিডিবি থেকে সেই বিদ্যুৎ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিসহ মোট ছয়টি কোম্পানির মাধ্যমে বিতরণ করা হয়। আর সেই বিদ্যুৎ সঞ্চালন করে একমাত্র পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। এখন যদি গ্যাসের দাম বেড়ে যায়, তাহলে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বাড়বে।

জানা গেছে, লোকসান ঠেকাতে পিডিবি প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা চেয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে প্রস্তাব করবে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে জানান, তাদের প্রস্তাব তৈরি করা হচ্ছে।

বর্তমান বরাদ্দ দিয়ে ঘাটতি মেটানো সম্ভব নয় উল্লেখ করে ওই কর্মকর্তা বলেন, আমরা বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। শিগগিরই পরবর্তী প্রক্রিয়া অনুযায়ী প্রস্তাব আকারে পাঠানো হবে। যদিও এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা কথা বলেননি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার আমদানি করা গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে। এদিকে গত এক বছরের বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম কয়েকগুন বেড়ে রয়েছে। এই পরিস্থিতি চড়া মূল্যে জ্বালানি আমদানি করে তা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। এটা কোনো সঠিক পরিকল্পনা নয়।

এ প্রসঙ্গে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে ঠেকেছে যে, বাড়তি চাপ জনগণকেই সামলাতে হবে। দেশে দরিদ্রের অংশ কম নয়। তারওপরে দীর্ঘ সময় করোনাভাইরাসের কারণে দরিদ্রের সংখ্যা আরো বেড়েছে।

তিনি বলেন, মানুষ হয়তো লোডশেডিং কয়েক ঘণ্টার জন্য মেনে নেবে, কিন্তু বাড়তি অর্থ দেওয়ার বিষয়টি আসলেই বাড়তি চাপ হয়ে যাবে।

কৃষি মন্ত্রণালয় সুত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থ বছরের বাজেটে কৃষি খাতে ভর্তুকি রাখা হয়েছে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা। এর সিংহভাগই ব্যবহার করা হয় সার আমদানিতে। বিদেশ থেকে কেনা সার সরকার ডিলারের মাধ্যমে কৃষকদের কাছে বিক্রি করা হয়। কিন্তু এবার বিশ্ববাজারে সারের দামও চড়া। যে কারণে এই খাতেও ভর্তুকি বাড়ানো প্রয়োজন।

সূত্র জানিয়েছে, বিষয়টি ইতোমধ্যে অর্থবিভাগকে জানিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সার ব্যবস্থাপনা ও মনিটরিং অধিশাখা। তারা সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি বাড়িয়ে ২২ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন জানিয়ে চিঠি দিয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সার-বিদ্যুৎ-গ্যাসের দাম না বাড়ালে বর্তমানে যে ভর্তুকি এই তিন খাতে রাখা হয়েছে, তার থেকে অন্তত আরও দশ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত দিতে হবে। যা এই মুহুর্তে দেওয়া সম্ভব না। কর্মকর্তারা বলছেন, এই তিন খাতের দাম সমন্বয় করতে পারলে কিছুটা চাপ কমবে।

এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, সরকারের যে ব্যয় রয়েছে সে অনুযায়ী যেহেতু আয় বাড়েনি, সেহেতু আর্থিক চাপ তো রয়েছেই।

তিনি বলেন, সরকার যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ভর্তুকির জন্য রাখে তা কতটা জনগুরুত্বপূর্ণ সেটা বিবেচনা করে রাখা উচিত। এখন সরকার যদি সার, বিদ্যুৎ, গ্যাসের দাম বাড়িয়ে দেয় তাহলে যে বড় সংখ্যক অর্থ সাশ্রয় হবে বিষয়টি তা না। সরকারে ভুর্তুকি খাতগুলোকে সামগ্রিকভাবে পর্যালোচনা করতে হবে।

উল্লেখ্য, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তি থাকায় গত নভেম্বরে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটার প্রতি ১৫ টাকা বাড়িয়ে দেয় সরকার। এই তেলের দাম বাড়ানোর কারনে গণপরিবহনের ভাড়া বাড়াতে হয়েছে ২৭ শতাংশ। প্রভাব পড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যে।

সারাবাংলা/জেআর/এসএসএ

গ্যাস-বিদ্যুৎ-সারের দাম


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর