ফাঁসি দিবসে সূর্য সেনকে শ্রদ্ধায় স্মরণ, স্মৃতি সংরক্ষণের দাবি
১২ জানুয়ারি ২০২২ ২০:১৩
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ৮৯ তম ফাঁসি দিবসে বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন গভীর শ্রদ্ধায় ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের প্রাণপুরুষ, অগ্নিযুগের বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনকে স্মরণ করেছে। সূর্য সেনের ভাস্কর্যে শ্রদ্ধা জানিয়ে বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিরা চট্টগ্রামে বিপ্লবীদের স্মৃতি সংরক্ষণে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
বুধবার (১২ জানুয়ারি) সকালে নগরীর জে এম সেন হল প্রাঙ্গণে স্থাপিত সূর্য সেনের আবক্ষ ভাস্কর্যে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সংগঠকরা।
শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের পক্ষ থেকে অগ্নিযুগের বিপ্লবী সূর্য সেনের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হয়। এসময় উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের উপ-প্রচার সম্পাদক কাউন্সিলর শহীদুল আলম, উপ-দফতর সম্পাদক কাউন্সিলর জহর লাল হাজারী, কাউন্সিলর পুলক খাস্তগীর ও নুরুল আলম মিয়া এবং সাবেক যুবলীগ নেতা বখতিয়ার ফারুক, নগর যুবলীগের সদস্য কফিল উদ্দিন, এ কে খান তাহের, মোহাম্মদ ইয়াসিন, বিপ্লব চৌধুরী প্রভাত।
এ সময় কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী উপমন্ত্রীর একটি বার্তা পাঠ করেন। এতে উপমন্ত্রী নওফেল বলেন, ‘বৃটিশের বিরুদ্ধে বিপ্লবের অগ্রনায়ক ছিলেন সূর্য সেন। শিক্ষক হিসেবে মানুষের প্রতি প্রবল ভালবাসা এবং চরিত্রের দৃঢ়তার কারণে তিনি তরুণদের আকৃষ্ট করে সংগ্রামের পথে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। দেশপ্রেম আর স্বাধীনতার মন্ত্রে তরুণদের দীক্ষিত করেছিলেন। মৃত্যুর আট দশক পরেও বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে মাস্টারদাকে স্মরণ করে আমরা এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা পাই। তিনি বাঙালির বিপ্লবের ধ্রুবতারা।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে গতবছর প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন শ্রদ্ধা জানালেও এবার চসিকের কেউ শ্রদ্ধা জানাতে যাননি।
মাস্টারদা সূর্য সেনের ফাঁসি দিবসে বিপ্লবীদের স্মৃতি সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছে বঙ্গবন্ধু শিশু কিশোর মেলা চট্টগ্রাম মহানগর শাখা। সূর্য সেনের আবক্ষ মূর্তিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শিবু প্রসাদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে এবং সহ-সভাপতি জাফর আল তানিয়ারের সঞ্চালনায় সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বক্তারা বলেন, ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে যে পথ দেখিয়েছিলেন সূর্যসেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের সাহসী যোদ্ধারা, ইতিহাসে তা অবিস্মরণীয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বিপ্লবীদের স্মৃতিগুলো ক্রমেই মুছে গেছে। কালক্রমে সেগুলো সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বিপ্লবীদের স্মৃতি অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে।
চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি মাহমুদুল করিম, সহ-সভাপতি মনির ইসলাম, জাহিদ হাসান সাইমুন, সাফায়েত হোসেন রাজু, জাহেদ অভি, আমিনুল ইসলাম রাশেদ, আব্বাস উদ্দীন, হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজ ছাত্রলীগ নেতা মায়মুন উদ্দীন মামুন, মোহাম্মদ রুবেল, আরফাতুল ইসলাম মিশন, শুভ দত্ত, যুবরাজ দাশ, মোহাম্মদ নুরুল হাসান, মারুফুল ইসলাম বিজয়, মোস্তাফিজ উদীন মাহিন বক্তব্য দেন।
মাস্টারদা সূর্য সেন, একইসঙ্গে ফাঁসি হওয়া বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদার এবং প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারসহ সকল ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামীর স্মৃতি রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছে বাসদ (মার্কসবাদী)। সকালে সূর্য সেনের আবক্ষ মূর্তিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও লাল সালাম জানানোর পর এক সভায় দলটির নেতারা বলেন, চট্টগ্রামে সূর্য সেন বিপ্লবী অভ্যুত্থান সংঘটিত করেছিলেন, অথচ এখানে সেই ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান ও সূর্য সেনসহ বিপ্লবীদের স্মৃতিজড়িত স্থান সংরক্ষণ ও সেই গৌরবজনক ইতিহাস নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার কোনো রাষ্ট্রীয় আয়োজন নেই। জালালাবাদ পাহাড়, দামপাড়া পুলিশ লাইনের তৎকালীন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগারে অভ্যুত্থানের স্মৃতি সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই। আমরা দাবি জানাই, অবিলম্বে চট্টগ্রামে সূর্য সেন স্মৃতি জাদুঘর স্থাপন এবং প্রীতিলতা, তারকেশ্বর দস্তিদারসহ বিপ্লবীদের স্মৃতি সংরক্ষণে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ নিতে হবে।
বাসদ (মার্কসবাদী) জেলা কমিটির সদস্য সচিব শফিউদ্দিন কবির আবিদ, সদস্য ও চারণ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ইনচার্জ ইন্দ্রানী ভট্টাচার্য সোমা, জাহেদুন নবী কনক, দীপা মজুমদার এ সময় বক্তব্য দেন।
বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদার স্মৃতি পরিষদ স্বাধীনতা সুবর্ণ জয়ন্তীতে বৃটিশবিরোধী বিপ্লবীদের সম্মান না জানানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সকালে সূর্য সেনের আবক্ষ মূর্তিতে পুষ্পস্তবক অর্পণের পর পরিষদের নেতারা বলেন, বিপ্লবীদের সার্থক উত্তরসূরী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে বাঙালি জাতিকে একটি স্বাধীন দেশ দিয়ে গেছেন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী , মুজিববর্ষ পালন করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, বিপ্লবীদের সম্মান প্রর্দশন করা হয়নি। বিপ্লবীদের জন্য কোনো রাষ্ট্রীয় দিবস নেই। পত্রিকায় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কোনো বাণী আসে না।
পরিষদের সভাপতি অঞ্জন কান্তি চৌধুরী, সহ-সভাপতি কৃষ্ণ শেখর দত্ত, সাধারণ সম্পাদক সিঞ্চন ভৌমিক, উপদেষ্টা বিজয় শংকর চৌধুরী, অর্থ সম্পাদক তপন ভট্টাচার্য, নন্দন কিশোর চৌধুরী, জসীমউদ্দিন, রুবেল পাল, সজল দাশ বক্তব্য দেন।
হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ চট্টগ্রাম জেলা ও মহানগর শাখা সূর্য সেনের আবক্ষ মূর্তিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। এ সময় পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতা শ্যামল কুমার পালিত, তাপস হোড়, চন্দন বিশ্বাস, নিতাই প্রসাদ ঘোষ, কাজল চৌধুরীসহ নেতারা ছিলেন। ঐক্য পরিষদের নেতারা বলেন, বিপ্লবীদের স্মৃতি সংরক্ষণে রাষ্ট্রীয় কোনো উদ্যোগ যেমন নেই, তেমনি তাদের ভিটেবাড়িও রক্ষা পাচ্ছে না। কখনও ভূমিদস্যুরা দখল করে নিচ্ছে, আবার অর্পিত সম্পত্তির নামে রাষ্ট্রীয়ভাবে হেফাজতে নিয়ে লিজ দেওয়া হচ্ছে। এভাবে বিপ্লবীদের স্মৃতিচিহ্ন মুছে ফেলা হচ্ছে। অথচ আগামী প্রজন্মের জন্য ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে সেগুলো সংরক্ষণের দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রের।
চট্টগ্রাম জেলা যুব ইউনিয়নের পক্ষ থেকে সাধারণ সম্পাদক উজ্জ্বল শিকদার, সহ সম্পাদক রাশিদুল সামির এবং সাংবাদিক প্রীতম দাশ বিপ্লবী সূর্য সেনের আবক্ষ ভাস্কর্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এছাড়া চট্টগ্রাম বিপ্লবী স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। এ সময় সাংবাদিক প্রদীপ দেওয়ানজি, আলমগীর সবুজ, মিন্টু চৌধুরী, মিঠুন চৌধুরী, সাইদুল ইসলাম, অনুপম শীল এবং রুবেল দাশ প্রিন্স উপস্থিত ছিলেন।
চট্টগ্রামের বীরকন্যা প্রীতিলতা ট্রাস্টের সভাপতি পংকজ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে বিপ্লবী সূর্য সেনের আবক্ষ ভাস্কর্যে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
উল্লেখ্য, সূর্য সেন ১৮৯৪ সালের ২২ মার্চ চট্টগ্রামের রাউজান থানার নোয়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯১৮ সালে শিক্ষাজীবন শেষ করে চট্টগ্রামে এসে গোপনে বিপ্লবী দলে যোগ দেন। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির (বিপ্লবীদের গঠিত সংগঠন) চট্টগ্রাম শাখার সর্বাধিনায়ক মাস্টারদা সূর্য সেন বিপ্লবী বাহিনী নিয়ে বৃটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। বিপ্লবীরা দামপাড়া পুলিশ লাইন্স আক্রমণ করে অস্ত্রাগার থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র লুট করে। মাস্টাররদা সেখানেই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করেন। এরপর তিনি পাহাড়ে আত্মগোপন করেন। সূর্য সেনকে ধরার জন্য ইংরেজ সরকার পুরস্কার ঘোষণা করে।
সরকার ১৯৩০ সালের ২৪ জুলাই চট্টগ্রামের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলার শুরু করে। ১৯৩২ সালের জুন মাসে মাস্টারদা প্রীতিলতা ও কল্পনা দত্তকে ডিনামাইট দিয়ে চট্টগ্রাম কারাগার উড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু সে পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। এই ঘটনায় ১১ জন বিপ্লবী গ্রেফতার হন। ২৪ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবে সফল আক্রমণ চালান, তবে তিনি গুলিবিদ্ধ হন এবং সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
এ ঘটনার পর মাস্টারদা পটিয়ার গৈড়লা গ্রামে আত্মগোপন করেন। কিন্তু ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তিনি ধরা পড়েন। সূর্য সেন, তারকেশ্বর দস্তিদার এবং কল্পনা দত্তের বিশেষ আদালতে বিচার হয়। ১৪ আগস্ট সূর্যসেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারের ফাঁসির রায় হয় এবং কল্পনা দত্তের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়াারি চট্টগ্রাম কারাগারে তাদের ফাঁসি কার্যকর হয়।
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম