কক্সবাজার সদর হাসপাতাল— ভোগান্তির আরেক নাম ডায়রিয়া ওয়ার্ড
১৪ জানুয়ারি ২০২২ ১০:৩৪
কক্সবাজার: বমি আর পাতলা পায়খানায় কাহিল হয়ে পড়ে ১৬ মাস বয়সী মোহাম্মদ ফারুক। নানী হাসিনা আক্তার তাকে নিয়ে আসেন কক্সবাজার সদর হাসপাতালে। নেওয়া হয় তৃতীয় তলার শিশু ওয়ার্ডে। শিশুটির শরীরে স্যালাইনসহ অন্যান্য তরল ওষুধ দিতে ক্যানোলা পরাতে আসেন একজন নার্স। ধমনী শনাক্ত করতে না পারায় বারবার শিশুটির হাতে সুঁচ ফোটাচ্ছিলেন তিনি। এমনিতেই অসুস্থ শিশুটি এর ফলে আরও বেশি কান্নাকাটি করছিল।
মোহাম্মদ ফারুকের নানী নুনিয়ারছড়ার বাসিন্দা হাসিনা আক্তার বলেন, ওই নার্স তিন তিন বার ব্যর্থ হওয়ার পর শিশুটির বাবা দক্ষ কোনো নার্সকে দিয়ে ক্যানোলা পরাতে বললে তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন ওই নার্স। ওয়ার্ড থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। শিশুটির চিকিৎসা না দিয়ে তার বাবার ওপর চড়াও হন। এর মধ্যে অবশ্য অন্য একজন নার্স গিয়ে শিশুটির পায়ে ক্যানোলা পরিয়ে দেন। শিশুটি সেখানে ভর্তি হলেও প্রথম নার্সের মতো অনেক নার্সের কাছ থেকেই বৈরী আচরণের শিকার হতে হয় বলে অভিযোগ হাসিনা আক্তারের।
শহরের বৈদ্যঘোনার আফরোজা খানমের অভিযোগও প্রায় একই। পাঁচ মাস বয়সী শিশুকন্যা জান্নাতুল ফেরদৌসকে হাসপাতালে নিয়ে যান বমি, কাশি আর পাতলা পায়খানায় আক্রান্ত হওয়ার পর। ওই শিশুকেও ক্যানোলা পরানোর চেষ্টা করে দুই বার ব্যর্থ হন একজন নার্স। অন্য একজন এসে এই শিশুটিকে ক্যানোলা পরিয়ে দেন। ওই সময়ও এ নিয়ে কথা বললে আফরোজা খানমের সঙ্গে ব্যাপক দুর্ব্যবহার করেন নার্স।
শহরের নতুন মেডিকেল কলেজ এলাকার উম্মে হাবিবা নামে এক নারী এই দৃশ্য দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তিনি সিন্ধান্তহীনতায় পড়েন ডায়রিয়া আক্তান্ত তার ৪ মাস ১০ দিন বয়সি শিশু সাঈদ বিন শাওনকে এই নার্সদের দিয়ে ক্যানোলা লাগাবেন কিনা। এরই মধ্যে আরেকজন নার্সই তাকে পরার্মশ দেন বাইরের প্রাইভেট হাসপাতাল থেকে ২৫০ অথবা ৩০০ টাকা দিয়ে বাচ্চাকে ক্যানোলা লাগিয়ে আনতে। পরে তিনি তাই করেন।
খবর নিয়ে জানা যায়, শুধু উম্মে হাবিবা নয়, শিশু ওয়ার্ড এবং ডায়রিয়া ওয়ার্ডের অনেক শিশুর ক্যানোলা লাগানো হয় বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতালের দক্ষ নার্সদের মাধ্যমে। এই নিয়ে নার্সদের দক্ষতা এবং হাসপাতালের ব্যবস্থা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠে রোগীর স্বজনদের মাঝে।
হাসপাতালে ভাইয়ের চিকিৎসা নিতে আসা শহরের বাহারছড়ার মোহাম্মদ ইব্রাহিম নামে এক যুবক জানান, জেলাবাসীর সেবা প্রদানে সদর হাসপাতালকে ঢেলে সাজিয়েছে সরকার। পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও এবং আন্তর্জাতির সংস্থাও সহযোগিতা করেছে। এরপরেও এমন অব্যবস্থাপনা মেনে নেওয়া যায় না।
নার্সদের অশুভ আচরণের ব্যাপারে শহরের পেশকার পাড়ার লাকি আক্তার নামে এক গৃহিণী জানান, অনেক নার্সের ব্যবহার ভাল থাকলেও কিছু নার্স এতই খারাপ ব্যবহার করে যা সহ্য করার মত নয়। যদিও সচেতনতামূলক পোস্টারের মাধ্যমে হাসপাতালের বিভিন্ন জায়গায় রোগীদের সঙ্গে ভাল ব্যবহারের কথা প্রচার রয়েছে। এসব নার্সদের দেখাদেখি অনেক আয়াকেও খারাপ ব্যবহার করতে দেখা যায়।
সরেজমিনে গিয়ে আরো দেখা যায়, ডায়রিয়া ওয়ার্ডে কোনো চিকিৎসক নেই। ওই ওয়ার্ডের কারো চিকিৎসা নিতে হলে শিশু ওয়ার্ডে আসতে হয়। এছাড়া সকালে একবার মাত্র চিকিৎসক রাউন্ডে যায়। এর বাইরে খুব জরুরি ছাড়া কোনো চিকিৎসক যায় না। তার মধ্যে নার্সদের অবহেলার অভিযোগের শেষ নেই।
শহরের উত্তর কুতুবদিয়া পাড়ার ১৮ মাসের সন্তান মো. আমান উল্লাহর মা সুমি আক্তারের অভিযোগ, তার সন্তানের স্যালাইন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কমপক্ষে ৬ বার গিয়েছেন নার্সের কাছে। গত শনিবারে যেসকল নার্স দায়িত্বে ছিলেন তারা আসছি আসছি বলে বার বার ফিরিয়ে দিয়েছেন। তিনি বিরক্ত আর অপমানে চিকিৎসা না নিয়ে হাসপাতাল ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন। এমন সময় পাশের ব্যাডের একজনের পরামর্শে শিশু ওয়ার্ডে গিয়ে স্যালাইনের বিষয়টি ঠিক করে আসেন।
মাহমুদা বেগম নামে আরেক রোগীর অভিভাবক জানান, এই নার্সরা ঠিকমত সেবা দেন না। তার শিশুকে দিনে দুই বার নেবুলাইজার দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু নার্সরা একবার দিয়ে আরেকবার দেওয়ার খবর রাখে না। শরীরে স্যালাইন লাগানো অবস্থায় রোগী নিয়ে তাদের কাছে গিয়ে সেবা নিতে হয়।
তালিকা অনুযায়ী বরাদ্দকৃত ২০ শয্যা হলেও ২৮ শয্যার ডায়রিয়া ওয়ার্ডে গত শনিবারে রোগীর সংখ্যা ছিল ৩৯ জন। আর এই ৩৯ জন্য রোগীকে সেবা দিচ্ছিল মাত্র ২ জন নার্স। তাদের মধ্যে একজন অফিস মেনটেইন করছিলেন অন্যজন রোগীদের সেবা দিচ্ছিল।
মঙ্গরবার রাত ৮টার দিকে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে দায়িত্বরত সিনিয়র নার্স মোহাম্মদ বেলাল জানান, ওই রাতে ৪ জন নার্স দায়িত্ব পালন করছে। তালিকা অনুযায়ী বরাদ্দকৃত ২০ শয্যা হলেও ২৮ শয্যার ডায়রিয়া ওয়ার্ডে রোগীর সংখ্যা ছিল ৩৭ জন। এতগুলো রোগীর সেবা দিতে নার্সদের চাপে পড়তে হয়। তিনি স্বীকার করেন ব্যবস্থপনার কারণে গত কয়েকদিন আগে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে নার্সের সংকট ছিল। তবে আজ থেকে সকাল-বিকাল এবং রাতে ভাগাভাগি করে ২০ জন নার্স দায়িত্ব পালন করছে।
ডায়রিয়া ওয়ার্ডে চিকিৎসক থাকে না কেন এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ অবগত। ক্যানোলা দিতে বার বার সুই ফুটাতে হয় কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্তমানে বেশিরভাগ নার্স নতুন।
এসব বিষয়ে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. শাহীন আবদুর রহমান জানান, আগে নার্সের সংকট থাকলেও বর্তমান সময়ে ৪শর কাছাকাছি নার্স দায়িত্ব পালন করছেন। সুতরাং নার্সের সংকট নেই বললেই চলে।
বাইরে থেকে ক্যানোলা লাগানোর ব্যাপারে বলেন, প্রাপ্ত বয়স্তদের তুলনায় শিশুদের নার্ভ (রগ) পাওয়া একটু মুশকিলের হয়ে যায়। সেই ক্ষেত্রে অনেক সময় দুই-একবার চেষ্টা করা হয়। এইটা এমন বড় ব্যাপার না। এই অবস্থা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও রয়েছে। দক্ষদের মাধ্যমে হাসপাতালের বাইরে থেকে ক্যানোলা লাগানো হয়।
ওয়ার্ডে চিকিৎসক না থাকার ব্যাপারে জানান, চিকিৎসক সংকটের কারণে ওয়ার্ডে চিকিৎসক নাই। তাই বলে চিকিৎসা বন্ধ নেই। তবে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের একটি প্রজেক্ট বাস্তবায়ন হলে চিকিৎসদের ঘাটতি পূর্ণ হবে। আর তা দ্রুত সময়ের মধ্যে হবে।
নার্সদের অশুভ আচরনের ব্যাপারে বলেন, বিষয়টি আসলে ব্যক্তিগত শিক্ষা। তবে প্রত্যেক মিটিং এবং ট্রেনিংয়ে এ বিষয়ে বার বার তাগাদা দেওয়া হয়। সবাই যে এমন করে তা নয়। এছাড়া রোগীর চাপ সামাল দিতে গিয়ে অনেক সময় ভুল হয়ে থাকে। তবে এই ক্ষেত্রে রোগীর সঙ্গে আসা স্বজনদেরও সহযোগিতা দরকার।
সারাবাংলা/এসএসএ