Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রাজীব বাড়ি যেতে চেয়েছিলেন


১০ এপ্রিল ২০১৮ ২৩:৩৩

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

ঢাকা: গতকাল রাত ৯টার দিকে আমি আর আমার বোন ওকে ফলের জুস খাইয়েছিলাম। খাওয়ানোর সময় জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘বাবা, বাসায় যাবা না?‘-ও ছোট্ট করে বলেছিল ‘যাবো।’ যে ছেলেটা বাসায় ফিরবে জানিয়েছিল, সে এখন লাইফ সার্পোটে। চিকিৎসকরা আমাদের জানিয়েছেন, ওর অবস্থা সংকটাপন্ন। আমাদেরকে যে কোনো সংবাদের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতও থাকতে বলেছেন তারা।

জাহিদুল ইসলাম যখন কথাগুলো বলছিলেন, তখন চোখ ছলছল করছিল। গায়ে তখনও আইসিইউতে ঢোকার পোশাক, মাথায় ক্যাপ। জাহিদুল বলেন, ছেলেটার অবস্থা এত খারাপ হয়ে গেল চোখের সামনে- আপনারা সবাই দোয়া করবেন বাপ-মা হারা এই ছেলেটার জন্য। ওর যদি কিছু হয়, তাহলে ওর ছোট দুই ভাই কোথায় যাবে? বাবা-মা নেই, ভাইটা ছিল, সেও যদি না থাকে তাহলে ওরা কোথায় যাবে।

জাহিদুল ইসলাম রাজীবের মামা। দুই বাসের চাপায় হাত হারানো রাজীবের মামা তিনি। বাবা-মা মারা যাবার পর এই মামা এবং খালাদের কাছেই বড় হয়েছেন রাজীব।

মঙ্গলবার (১০ এপ্রিল) রাজীবের অবস্থা সংকটাপন্ন বলে জানান চিকিৎসকরা। হঠাৎ করেই ডান হাত হারানো এই ছেলেটার অবস্থা খারাপ হওয়াতে উদ্বিগ্ন চিকিৎসকরা। এমনকি সাংবাদিকদের সামনে রাজীবের বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে নিজেও আবেগাপ্লুত হয়ে যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থোপেডিকস বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. শামসুজ্জামান শাহীন। চোখের পানি লুকাতে হাত দিয়ে চোখ ঢেকে মাথা নিচু করে ফেলেন তিনি।

অধ্যাপক ডা. শামসুজ্জামান বলেন, একজন সাধারণ মানুষের মানুষের গ্লাসগো কমা স্কেল (জিসিএস) ১৪ থেকে ১৫ থাকে। আর যখন সে স্কেল ৮ এ নেমে আসে তখন তারা রোগীকে সংকটাপন্ন বলা হয়। আর রাজীবের জিসিএস স্কেল এখন তিন প্লাস। যখন জিসিএস তিন এর নিচে চলে যায় তখন মানুষটি আর বেঁচে থাকে না। এ অবস্থায় আমরা রাজীবের জন্য মিরাকল কিছুর অপেক্ষা করছি।

বিজ্ঞাপন

মানুষের সজ্ঞানতার মাত্রা বোঝানোর জন্য মেডিকেল পদ্ধতিকে বলা হয় গ্লাসগো কমা স্কেল (জিসিএস)।

গতকাল সোমবারও রাজীবের একটি সিটিস্ক্যান করা হয়েছিল এবং সে পরীক্ষার ফলাফল ভালো ছিল। কিন্তু আজ মঙ্গলবার সকালে করা সিটিস্ক্যানের ফলাফল আসে যে নিয়া তারা উদ্বিগ্ন বলেও জানান ডা. শামসুজ্জামান।

রাজীবের সঙ্গে তিনি নিজেই গত পরশু কথা বলেছেন, তাকে উৎসাহ দিয়েছেন, উদ্বুদ্ধ করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের সহযোগিতা করার জন্য বলেছিলাম। বলেছিলাম, ‘তুমি কথা বলো, আমাদের সহযোগিতা করো। তোমার হাত প্রতিস্থাপন করা হবে, আমরা টাকা ম্যানেজ করছি, ব্যবস্থা হয়ে যাবে বলে আশা করি।’

অথচ গতকাল ভোররাতে রাজীবের অবস্থা খারাপ হয়। তাকে লাইফ সার্পোটে নেওয়া হয়।

এদিকে, রাজীবকে দেখতে এসে রাজীবের অবস্থা সংকটাপন্ন বলে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরো সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়াও।

অপরদিকে রাজীবের মামা, জাহিদুল ইসলাম এ প্রতিবেদককে বলেন, রাজীব নিজে থেকে কথা বলতো না। আমরা যখন ওর সঙ্গে গিয়ে কথা বলতাম আমাদেরকে উল্টো করে সে মুখ ঘুরিয়ে থাকতো। নিজে থেকে কোনও কথা বলতো না, আমরা যা প্রশ্ন করতাম তার উত্তর দিতো।

গতকাল নয়টার দিকে রাজীবের মেজ ভাই মেহেদী হাসানকে তখন আইসিইউতে থাকা রাজীবের কাছে নিয়ে গেলেও আগলে রাখা ভাইকেও সে চিনতে পারেনি বলেও জানান জাহিদুল। তিনি বলেন, যখন বুঝতে পারছিলাম, ওর স্মৃতি শক্তিতে সমস্যা হচ্ছে, তখন মেহেদীকে নিয়ে সামনে দাঁড় করিয়ে জানতে চাইলাম- এটা ওর কী হয়, ওর নাম কী। উত্তরে কেবল হাসলো, কিন্তু জবাব দিলো না, চিনতে পারলো। আমরা যারা বড় করলাম, সারাজীবন যাদের কাছে রইলো সেই মামা-খালাদেরও চিনতে পারলো না ছেলেটা-বলে কাঁদেন জাহিদুল।

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, আমরা কত কথা বলি, তাকে কথা বলানোর চেষ্টা করি- কিন্তু সে কিছু বলে না, কেবল তাকিয়ে থাকে আর চোখ দিয়ে পানি পরে।

রাজীবকে রাতে ফলের জুস খাওয়ানোর পর আইসিইউর সামনেই ফ্লোরেই মাদুর পেতে ঘুমান মামা জাহিদুল, খালা জাহানারা বেগম। তাদের দিন-রাত কাটে এই ফ্লোরেই। জাহিদুল বলেন, আমাদের কোনও দিন-রাত নেই। নিজেদের কোনও পরিবার নেই-আমরা এখানেই সংসার পেতেছি। আপনারা দোয়া করবেন, আমাদের বড় ছেলেকে নিয়ে যেন আসল সংসারে ফিরতে পারি। রাজীবের ছোট দুই ভাই যেন তাদের অভিভাবককে ফেরত পায়।

সারাবাংলা/জেএ/এমআইএস/এটি

রাজীব সড়ক দুর্ঘটনা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর