Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ভ্যাকসিন ছাড়া খাবার মিলবে না রেস্টুরেন্টে—কতটুকু বাস্তবসম্মত?

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১৫ জানুয়ারি ২০২২ ১০:২১

ঢাকা: দেশে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি রোধে ১১ দফা নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। এরমধ্যেই রয়েছে, রেস্তোরাঁয় বসে খাবার গ্রহণ এবং আবাসিক হোটেলে থাকার জন্য অবশ্যই করোনা ভ্যাকসিন নেওয়ার সনদ দেখানোর নির্দেশনা। তবে বিধিনিষেধ কার্যকরের প্রথম দিনই দেখা গেল, সরকারি এই নির্দেশনা প্রায় উপেক্ষিত সকল আবাসিক হোটেল, রেস্তোরাঁ ও বড় বড় রেস্টুরেন্টে।

সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকরা বলছেন, এখন পর্যন্ত সরকার বা কোনো মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়নি তাদের কাছে। একইসঙ্গে এমন নির্দেশনা বর্তমান প্রেক্ষাপটে মেনে চলা অনেক ক্ষেত্রেই বাস্তবসম্মত না। তবে স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, ধীরে ধীরে সকল স্থানেই এমন নির্দেশনা মেনে চলার জন্য অভ্যাস করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

বৃহস্পতিবার (১৩ জানুয়ারি) থেকে রাজধানীসহ সারাদেশে বিধিনিষেধ কার্যকর করার কথা। তবে এদিন রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সরেজমিনে দেখা যায়, রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন স্থানে যথারীতি বিকিকিনি চললেও সেখানে স্বাস্থ্যবিধি বিষয়টি অনেকটাই উপেক্ষিত ছিল। একইসঙ্গে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী কোভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধী ভ্যাকসিন সনদ দেখানোর বিষয়টিও ছিল উপেক্ষিত।

কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নির্দেশনা মেনে রেস্তোরাঁ চালাতে গেলেও প্রতিটা পদক্ষেপেই নানাভাবে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে তারা। এক্ষেত্রে ভোক্তার সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়ানোসহ নানাভাবে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন মালিক-কর্মচারীরা।

রাজধানী ব্যস্ততম এলাকা মহাখালীর একটি রেস্তোরাঁয় গিয়ে দেখা যায়, গ্রাহকরা কোনো রকম ভ্যাকসিন কার্ড দেখানো ছাড়াই সেখানে স্বাভাবিকভাবেই খাওয়ার অর্ডার দিচ্ছেন। এ সময় হোটেলটিতে কাপাসিয়া থেকে আসা দুইজন ব্যক্তি অর্ডার দিয়ে খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

বিজ্ঞাপন

কথা বলে জানা যায়, তাদের কেউই ভ্যাকসিন গ্রহণ করেননি। এক্ষেত্রে নিবন্ধন করলেও ভ্যাকসিন গ্রহণের জন্য কোনো এসএমএস না পাওয়ার কথা জানান তারা।

হোটেল কর্তৃপক্ষ ভ্যাকসিন কার্ড দেখতে চেয়েছিলেন কিনা জানতে চাইলে তারা জানান, না— ভ্যাকসিন কার্ড দেখতে চাননি।

রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল ভিন্ন বক্তব্য। রেস্তোরাঁর ম্যানেজার জসিম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, সকাল থেকে এখন পর্যন্ত যারাই এখানে খেতে এসেছেন তাদেরকে আমরা ভ্যাকসিন সনদের বিষয়টি জানিয়েছি। কিন্তু গ্রাহক একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে চলে যায়। দুপুর পর্যন্ত কিছু গ্রাহক উল্টো আমাদেরকেই জিজ্ঞেস করেছে আমরা ভ্যাকসিন সনদের বিষয়ে জিজ্ঞেস করার কে? এমন পরিস্থিতিতে আমরা আসলে কী করবো তা জানা নেই। তাই বিকল্প হিসেবে আমরা রেস্তোরাঁর চারপাশেই সরকারের নির্দেশনার বিষয়ে জানিয়ে দিয়েছি।

ওই রেস্তোরাঁর কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের কেউই এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিন গ্রহণ করেননি। এক্ষেত্রে তারা কীভাবে ভ্যাকসিন নেবেন সে বিষয়েও কোনো তথ্য না থাকার কথা জানান।

জসিমউদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, জন্ম নিবন্ধন দিয়ে ভ্যাকসিন নেওয়ার কথা জানিয়েছে। কিন্তু আমার এখানে থাকা অনেকেই সেটা নিয়ে গেলেও তাদের ভ্যাকসিন দেওয়া হয়নি। তারা তো আর স্কুল বা কলেজে পড়ে না আর তাই জন্ম নিবন্ধন দিয়ে হয়তো ভ্যাকসিন দেয়নি। এখন নিজেদের কর্মচারীদেরই যদি আমরা ভ্যাকসিন নেওয়া নিশ্চিত করতে না পারি তবে কারা ভ্যাকসিন নিয়ে এসেছে সেটা কীভাবে বলব?

তিনি বলেন, আমরা যখন ভ্যাকসিন সনদের বিষয়ে জিজ্ঞেস করছি তখন গ্রাহক আমাদের উপরেই উত্তেজিত হচ্ছেন। আবার কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে অনেকেই রেস্তোরা ছেড়ে অন্য খানে চলে যাচ্ছেন। এমন অবস্থায় সরকারের পক্ষ থেকেও কোনো নির্দেশনা আমরা পায় নি। আর তাই আসলে এটা কিভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব তা নিয়ে শঙ্কায় আছি।

রাজধানীর উত্তরার আরেকটি রেস্তোরাঁয় কথা বলে জানা যায় প্রায় একই অবস্থা সেখানেও। রাজধানীর অ্যালিফেন্ট রোডের আরেকটি বড় রেস্তোরাঁয় ব্যবস্থাপকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় প্রায় একই রকমের উত্তর।

শফিকুল ইসলাম নামে একজন রেস্তোরাঁ ব্যবস্থাপক জানান, গত দুই বছরে করোনার কারণে আমাদের অনেকেরই ব্যবসা প্রায় বন্ধ ছিল। এমনকি ঈদের সময়েও কিন্তু তেমন বেচাকেনা ছিল না। গত কিছু মাসে রেস্তোরাঁতে খাওয়ার জন্য গ্রাহকরা আসলেও এখন দেখা যাচ্ছে তাদের ভ্যাকসিন কার্ডের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলেই পাল্টা প্রশ্ন করে বলছে আমরা সেটা দেখার কে? এমন অবস্থায় আমরা কী করতে পারি সেটা আসলে বুঝে উঠতে পারছি না।

তিনি বলেন, সরকার যদি রেস্তোরাঁর সবাইকে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করতে পারতো এবং একই সঙ্গে দেশের মানুষদের ভ্যাকসিন নিশ্চিত করতে পারতো তখন হয়তোবা এমন নির্দেশনা কার্যকর করা সম্ভব হতো। কিন্তু সেটা না করা উল্টো আমাদের ঘাড়ে ভ্যাকসিন কার্ড দেখার দায়িত্ব দেওয়াটা আসলে বাস্তবসম্মত না।

প্রায় একই অবস্থা দেখা যায়, সেগুনবাগিচা, ধানমন্ডি, রামপুরা, বাড্ডা, পল্টন, শাহবাগ থেকে শুরু করে রাজধানীর অভিজাত এলাকা বলে পরিচিত গুলশানের বিভিন্ন রেস্তোরায়ও। এসব রেস্তোরাঁতেও দেখা যায়, অধিকাংশ কর্মচারী ভ্যাকসিন গ্রহণ করেননি।

রামপুরার একটি রেস্তোরার ব্যবস্থাপক প্রশ্ন ছুড়ে বলেন, যেখানে অধিকাংশ স্থানেই এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিন কার্ড দেখানোর প্রয়োজন পড়ে না সেখানে শুধুমাত্র রেস্তোরাতেই কেনো? কারণ আমাদের তো আর বাড়তি জনবলও নেই যে মূল ফটকে দাঁড়িয়ে ভ্যাকসিন কার্ড পরীক্ষা করবে। এমন নির্দেশনা তাই বাস্তবতাবিবর্জিত। আর আপনারা সাংবাদিকরা যখন আমাদের এখানে কি পরিস্থিতি সেটা দেখতে আসছেন তাদের নিজেদেরও এই বিষয়গুলো দেখা প্রয়োজন। গত কয়েকমাসে কখনো কি শুনেছেন কোনো রেস্তোরার কর্মীদের ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্য সরকার কোনো পদক্ষেপ নিয়েছে?

বাংলাদেশ রেস্তেরাঁ মালিক সমিতির প্রথম যুগ্ম মহাসচিব ফিরোজ আলম সুমন সারাবাংলাকে বলেন, সরকারের যে কোনো নির্দেশনা বাস্তবায়নে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। কিন্তু যদি এমন কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয় যা নিয়ে কোনো আলোচনাই করা হয় নি সেটি আসলে কতটুকু বাস্তবায়নযোগ্য তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।

তিনি বলেন, আমরা সরকারের কাছে আমরা আবেদন জানাই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অন্তত যেনো আলোচনাটা করা হয়। এতে করে আমরা কি কি প্রতিবন্ধকতা থাকতে পারে সেটা আলোচনা করতে পারবো। সরকারও তখন আসলে সমস্যাগুলো জানতে পারবে।

তিনি আরও বলেন, রেস্তোরায় খেতে হলে ভ্যাকসিন কার্ড দেখাতে হবে— এটা সরকারের খুবই ভালো একটা সিদ্ধান্ত যা বাস্তবতার প্রেক্ষিতে অবাস্তব। এমন নির্দেশনা দেওয়ার আগে সরকারের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের কারোর সঙ্গেই এখন পর্যন্ত বসেন নি। এ নির্দেশনা কিভাবে বাস্তবায়ন করা যাবে তা নিয়েও আলোচনা করে নি। আমরা যে অন্যদের সুরক্ষা দেবো তারা তো নিজেরাও সুরক্ষিত না। রেস্তোরার যে শ্রমিকরা কাজ করছে তাদের ভ্যাকসিন দেওয়ার বিষয়টিও তো নিশ্চিত করতে হবে।

ফিরোজ আলম সুমন বলেন, আমরা কিন্তু গত বছর থেকেই বলছি করোনা যোদ্ধা হিসেবে আমাদের সকল কর্মচারীদের ভ্যাকসিনেশন যেনো নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু সেটা না করায় যেহেতু আমরা নিজেরাই সুরক্ষিত না তাই আমরা অন্যদের কিভাবে সুরক্ষা দেবো? আর এখন পর্যন্ত আমাদের দেশের যেটা নাগরিক অধিকার সেই জাতীয় পরিচয়পত্রও কিন্তু অনেক রেস্তোরা শ্রমিকরা পায় নাই। সব মিলিয়ে আসলে নির্দেশনাটা মেনে চলাটা বাস্তবসম্মত না। আর এক্ষেত্রে বড় প্রশ্ন হচ্ছে শুধুমাত্র রেস্তোরা ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রেই কেনো এমন সিদ্ধান্ত? অন্য সেক্টরে কেনো না?

তিনি বলেন, কেউ একজন ভ্যাকসিন কার্ড নিয়ে আসলো রেস্তোরাঁ। সেটা আসল না নকল তা কী সবাই বুঝবে। আমাদের কী রাষ্ট্র এমন কোনো ক্ষমতা দিয়েছে যেখানে আমরা একজন নাগরিককে জিজ্ঞেস করতে পারি তার ভ্যাকসিন কার্ড দেখানোর জন্য? সবাই কী বারকোড বুঝবে?

তিনি আরও বলেন, গত দুই বছরের রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীদের অবস্থা অনেক খারাপ। অনেকেই দেখা গেছে তার মূলধন হারিয়ে ফেলে শ্রমিকদের বেতন দিতে পারছে না। অনেকেই দেখা গেছে পারিবারিক সমর্থন নিয়ে জায়গা জমি বা গয়নাগাটি বিক্রি করে এই ব্যবসা করতে আসছে। এমন অবস্থায় কোনো রকমের টিকে আছে। তার পরেও যদি এই সেক্টরে এভাবে বাস্তবতা বিবর্জিত নিয়ম করা হয় তবে সেটা আসলে এই শিল্পকে ধ্বংস করে দিবে। অথচ গার্মেন্টস বা রেমিটেন্স খাতের পরে এই রেস্তোরাঁ খাতের আয় কিন্তু সরকারের একটা বিশাল লাভের অংশ।

ফিরোজ আলম বলেন, আমরা আশা করছি খুব দ্রুতই আমাদের সঙ্গে সরকারের নীতি নির্ধারক পর্যায়ে যারা আছেন তারা বসবেন। একইসঙ্গে আমাদের রেস্তোরাগুলোতে যারা কাজ করছে তাদের ভ্যাকসিনের বিষয়টি নিশ্চিত করা হতে পারে। কারণ দেখা যাবে দুই থেকে তিন শতাংশ বড় কিছু রেস্তোরা বাদে রাজধানীসহ সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে শ্রমজীবী মানুষরাই বসে খাওয়া–দাওয়া করেন। এখন তাদের সবার ভ্যাকসিন কার্ড দেখে খাওয়া সরবরাহ করা আসলে কতটুকু বাস্তবসম্মত।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর সারাবাংলাকে বলেন, যেভাবে দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ বাড়ছে তাতে আসলে সরকারের পক্ষ থেকে সকল নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। হ্যাঁ, সকল ক্ষেত্রেই শুরুর দিকে কিছু সমস্যা হতে পারে। তবে সেগুলো ধীরে ধীরে কাটিয়ে নিয়ে বাস্তবায়ন করাটাও সম্ভব হতে পারে। এক্ষেত্রে যারা ভ্যাকসিন নিচ্ছে তারা যদি সনদ তুলে নিজের কাছেই রাখেন তবে সেটা যেকোনো স্থানেই দেখাতে পারেন। আর আমরা কিন্তু সবাইকেই ভ্যাকসিন দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে তা সবাইকে নিয়েই আমাদের বাস্তবায়ন করতে হবে। চ্যালেঞ্জিং হলেও সেটিকে মোকাবিলা করে আমাদের সফল হতে হবে। কারণ সবারই লক্ষ্যমাত্রা একটা আর তা হলো কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করে দেশের সবাইকে নিরাপদে রাখা।

সারাবাংলা/এসবি/এএম

করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতি রেস্তোরাঁ হোটেল

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর