Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শেষ ৩ মাসের সংক্রমণ ছাড়াল জানুয়ারির ১৬ দিনে

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১৭ জানুয়ারি ২০২২ ০৯:৪০

ফাইল ছবি

ঢাকা: দেশে নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শনাক্তের হার বাড়ছে। ২০২১ সালের শেষ তিন মাসে দেশে ২৯ হাজার ৬২৮ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার তথ্য জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর। তবে চলতি বছরের প্রথম ১৬ দিনেই সেই সংখ্যা অতিক্রম করে গেছে। জানুয়ারির প্রথম ১৬ দিনে দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ৩২ হাজার ১৭২ জনের মাঝে। একইসঙ্গে, দেশে গত চার মাসে সংক্রমণ শনাক্তের হার সাতের নিচে থাকলেও জানুয়ারির ১৬ দিনে এটি ছাড়িয়েছে আট শতাংশ।

বিজ্ঞাপন

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে সংক্রমণের যে ঊর্ধ্বগতি তা নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা বৃদ্ধিসহ চিকিৎসা ব্যবস্থার দিকেও জোর দিতে হবে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রাধান্য থাকলেও বর্তমানে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের প্রভাব বাড়ছে। ওমিক্রনে সংক্রমিতদের মাধ্যমে খুব দ্রুতই করোনা ছড়িয়ে পড়ছে। আর তাই নিম্মবিত্ত ও নিম্ম মধ্যবিত্তদের জন্য আইসোলেশনের ব্যবস্থা করা জরুরি। যেনো উপসর্গ দেখা দিলেই আইসোলেশনে থেকে পরিবারের অন্যান্যদের মধ্যে সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি কমানো যায়।

বিজ্ঞাপন

রোববার (১৬ জানুয়ারি) দেশে ২৯ হাজার ৩০৫টি নমুনা পরীক্ষা করে পাঁচ হাজার ২২২ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। দেশে এখন পর্যন্ত ১১ কোটি ৮৬ লাখ ৪২৫টি নমুনা পরীক্ষা করে ১৬ লাখ ১৭ হাজার ৭১১ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্তের তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এখন পর্যন্ত দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা গেছেন ২৮ হাজার ১৪৪ জন।

সংক্রমণ তথ্য বিশ্লেষণ

গেল বছরের জুন মাস থেকে দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে। জুলাই এবং আগস্টেও একই ধারা অব্যাহত থাকে। তবে এই সংখ্যা কমে আসতে শুরু করে অক্টোবর থেকে। ছয় লাখ ১৮ হাজার ৫৭৯টি নমুনা পরীক্ষা করে অক্টোবর মাসে দেশে ১৩ হাজার ৬২৮ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এ মাসে সংক্রমণ শনাক্তের দৈনিক হার ছিল গড়ে দুই দশমিক ২০ শতাংশ। এ মাসে দেশে ৩৫৮ জন মৃত্যুবরণ করেন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে।

নভেম্বর মাসে দেশে পাঁচ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮১টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এ মাসে ছয় হাজার ৭৪৫ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্তের তথ্য জানানো হয়। এ মাসে সংক্রমণ শনাক্তের দৈনিক হার ছিল এক দশমিক ২৫ শতাংশ। এ মাসে দেশে ১১৩ জন মৃত্যুবরণ করে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে।

ডিসেম্বর মাসে দেশে ছয় লাখ দুই হাজার ৭৩৭ টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মাঝে ৯ হাজার ২৫৫ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্তের তথ্য জানায় স্বাস্থ্য অধিদফতর। এ মাসে দেশে সংক্রমণ শনাক্তের দৈনিক হার ছিল এক দশমিক ৫৪ শতাংশ। এ মাসে দেশে ৯১ জন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা যায়।

তবে জানুয়ারি থেকে দেশে বাড়তে থাকে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা। এই মাসের প্রথম ১৬ দিনে তিন লাখ ৬৯ হাজার ৯৩৭টি নমুনা পরীক্ষা করে ৩২ হাজার ১৭২ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এই ১৬ দিনে দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্তের দৈনিক হার আট দশমিক ৭০ শতাংশ। এই ১৬ দিনে দেশে ৭২ জন কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা গেছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর।

সাপ্তাহিক হিসেবেও দেখা যায় দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্তের হার বেড়েছে। দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্তের ৮৪ তম সপ্তাহে অর্থাৎ ১০ থেকে ১৬ অক্টোবর পর্যন্ত সংক্রমণ শনাক্তের সাপ্তাহিক হার ছিল ২.২৭ শতাংশ। এরপরে ৯৪ তম সপ্তাহ পর্যন্ত এই সাপ্তাহিক হার দুই এর নিচেই থাকে তবে এর পরে দেখা যায় ঊর্ধ্বগতি। ৯৫ তম সপ্তাহ অর্থাৎ ২৫ ডিসেম্বর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে সংক্রমণ শনাক্তের হার দুই দশমিক ২৪ শতাংশ হয়। সর্বশেষ ৮ থেকে ১৪ জানুয়ারি অর্থাৎ ৮-১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশে সংক্রমণ শনাক্তের সাপ্তাহিক হার দাঁড়ায় ১১ দশমিক ১২ শতাংশ।

দৈনিক হিসেবেও বাড়ছে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা। ১ জানুয়ারি ২৪ ঘণ্টায় সংক্রমণের সংখ্যা ছিল ৩৭০ জন যা শতকরা ২ দশমিক ৪ শতাংশ। ১৬ জানুয়ারি এই সংখ্যা এসে ৫ হাজার ৫২২ জনে দাঁড়িয়েছে। সংক্রমণের হার বেড়ে ১৭ দশমিক ৮১ শতাংশ।

স্বাস্থ্যবিধি মানা ও ভ্যাকসিন নেওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি নিশ্চিত করা ও ভ্যাকসিন কার্যক্রমে গতি বাড়ানোর তাগিদ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। নতুবা সংক্রমণের এই দ্রুত ঊর্ধ্বগতি আশঙ্কাজনক এবং অতি দ্রুতই পরিস্থিতি ভয়ংকর পর্যায়ে চলে যেতে পারে বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সংক্রমণের এ সংখ্যা বাড়ার পেছনে অন্যতম কারণ স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে চলাচল ও সামাজিক, রাজনৈতিক বিভিন্ন কর্মসূচিকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে ব্যক্তি পর্যায়ে কেউই স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করছেন না, মাস্ক পরা ও হাত ধোঁয়ার বিষয়েও শিথিল ভাব দেখা যাচ্ছে। এছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচনসহ বিভিন্ন পর্যায়ে নির্বাচন চলছে। ভ্রমণের জন্য বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র ও বাণিজ্য মেলাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে জনসমাগম হচ্ছে। এসব জায়গায় স্বাস্থ্যবিধি ব্যাপকভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে। এসব কারণে সংক্রমণের গতি দ্রুত বাড়ছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) মেডিসিন বিভাগের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, সারাবিশ্বেই বর্তমানে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা বাড়ছে দ্রুত। এমন অবস্থায় আমাদের দেশেও গুরুতর পরিস্থিতির দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, স্বাস্থ্যবিধি না মানার কারণে দেশে যে হারে সংক্রমণ বাড়া শুরু হয়েছে তা আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যেতে পারে। একইসঙ্গে জনসমাগম এড়িয়ে চলার মতন বিষয়গুলি নিয়েও উদাসীনতা দেখা যাচ্ছে। ফলে বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচন হচ্ছে, বাণিজ্য মেলায় জনসমাগম হচ্ছে যেখানে দুরত্ব বজায় রাখার কোনো বিষয়ই নেই। এভাবে চলতে থাকলে কয়েক দিনের মধ্যেই ভয়াবহ বিপর্যয়ে পড়ে যাবো আমরা।

একইসঙ্গে যারা এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিন নেয়নি, তাদের দ্রুত ভ্যাকসিন নিতে হবে বলেও মনে করছেন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও উপদেষ্টা ডা. মোশতাক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, সংক্রমণ যত বাড়তে থাকবে ততই মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যাবে। কারণ আমাদের দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকলে তার মোকাবিলা করা কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে সেটা আরও দেড় থেকে দুই মাস চলতে পারে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের প্রাধান্য থাকলে তা খুব দ্রুতই ওমিক্রনের কারণে স্থিমিত হয়ে যেতে পারে। আর ওমিক্রনের মাধ্যমে দ্রুত গতিতে ছড়াতে পারে। ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের যে চরিত্র তাতে খুব দ্রুত সংক্রমণের রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে। মনে রাখতে হবে আমাদের এখানে প্রতিদিন আক্রান্তের যে সংখ্যা পাওয়া যাচ্ছে সংক্রমণ তার থেকেও বেশি হতে পারে। কারণ অনেকেই টেস্ট করাচ্ছেন না আবার অনেকে সামাজিক কারণে নমুনা পরীক্ষায় ভয় পাচ্ছেন।

তিনি বলেন, যারা নিম্ম আয়ের মানুষ ও নিম্ম মধ্যবিত্ত তাদের অনেকেই কিন্তু নমুনা পরীক্ষা করাতে ভয় পায়। কারণ যদি সংক্রমণ শনাক্ত হয় তবে তাদের ইনকাম বন্ধ হতে পারে। একইসঙ্গে পরিবারের অন্য সদস্যদের মাঝেও সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে। আর তাই তাদের জন্য সম্ভব হলে আলাদাভাবে আইসোলেশনে ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

তিনি আরও বলেন, দেশে এখনও অর্ধেকের বেশি মানুষ ভ্যাকসিন নেয়নি। দ্রুত সবাইকে ভ্যাকসিন নিতে হবে। আমাদের এখন করোনা টেস্ট ফ্রি করে দেওয়া উচিত। পাশাপাশি পাড়া মহল্লায় গিয়ে টেস্ট করানোর ব্যবস্থা করা উচিত। একইসঙ্গে র‍্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টের আওতা বাড়াতে হবে অর্থাৎ মানুষকে জানাতে হবে ও তাদের নাগালে পৌছে দিতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ও মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশে যেমন ওমিক্রন ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট রিপ্লেস করেছে, বাংলাদেশেও হয়তো এক সময় সেটি হয়ে যাবে। আমাদের অনেকেরই একটি ধারণা হয়েছে, বাংলাদেশে এখনো হয়তো ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু ভয়াবহ কিছু নয়। এটি কিন্তু বৈজ্ঞানিকভাবে তথ্য-প্রমাণ দিয়ে একেবারে নিশ্চিত করে বলার সময় আসেনি।

তিনি আরও বলেন, আমাদের ধরে নিতে হবে বাংলাদেশে এখনো মূলত ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট প্রাধান্য বিস্তার করে আছে। তবে ওমিক্রনের সংক্রমণ ঘটেছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে যেমন ওমিক্রন ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট রিপ্লেস করেছে, বাংলাদেশেও হয়তো এক সময় সেটি হয়ে যাবে। মনে রাখতে হবে আমাদের আত্মতুষ্টির কোনো জায়গা নেই। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিকল্প নেই।

ডা. নাজমুল বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, সরকারের দেওয়া বিধি-নিষেধগুলো যার বেলায় যেটি প্রযোজ্য সেটি যদি আমরা মেনে চলি তাহলে সংক্রমণের এখন যে চিত্র আছে, যে ঢেউটি আসছে বলে আমরা আশঙ্কা করছি সেই ঢেউটি গতবারের মতো সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারবো। এখানে আতংক নয়, সচেতনতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

সারাবাংলা/এসবি/একেএম

করোনা সংক্রমণ শনাক্তের হার

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রামে আগুনে পুড়ল ৫ দোকান
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ১২:৩৪

আরো

সম্পর্কিত খবর