রাসায়নিক বর্জ্যে তীব্র দূষণ, বুড়িগঙ্গায় প্রাণ-প্রতিবেশ হুমকিতে
১৮ জানুয়ারি ২০২২ ২২:৫৯
ঢাকা: বুড়িগঙ্গা তীরের শ্যামপুরের বাসিন্দা আনিসুর রহমান। প্রায় ১০ বছর ধরে রাজমিস্ত্রির জোগালি হিসেবে কাজ করেন। পাশাপাশি নদীতে জাল ফেলে দু’চারটা মাছও ধরেন। তিনি জানাচ্ছেন, বছর পাঁচেক আগেও টুকটাক মাছ মিলত বুড়িগঙ্গায়। এখন কয়েক ঘণ্টা জাল ফেলে বসে থেকেও খাওয়ার উপযোগী একবেলার মাছও মেলে না।
মঙ্গলবার (১৮ জানুয়ারি) ঢাকার অদূরে শ্যামপুরের ফায়ার ব্রিগেড ঘাটে চার থেকে পাঁচবার জাল ফেলে তিনি পেয়েছেন একটি খয়রা, একটি শিং, একটি টাকি। সঙ্গে ছিল গোটা কয়েক সাকার মাছ, স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে চ্যাঙ্গা-ব্যাঙ্গা। আনিসুর রহমান বলছিলেন এই মাছ তারা খান না। কিন্তু এটিই আজকাল বেশি পাওয়া যায়। অথচ বচর পাঁচেক আগেও জাল ফেললেই উঠত শোল, বোয়াল।
বুড়িগঙ্গার তীরে শ্যামপুরের এই এলাকার নদীর পানি দূষণে রীতিমতো লাল। কারণ— শ্যামপুর, ফায়ার ব্রিগেড ঘাটসহ আশপাশের কয়েকটি ঘাটে কোনো ধরনের পরিশোধন ছাড়াই কেমিক্যাল বর্জ্য এসে মিশছে বুড়িগঙ্গা নদীতে। ফলে পানিতে যে তীব্র দূষণ, সেটিকে মাছসহ নদীর অন্যান্য জলজ প্রাণের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছেন পরিবেশবিদ ও বিজ্ঞানীরা। নদীর পানিই যে শুধু দূষণের শিকার, তা নয়। নদীর দুই তীরেই আবর্জনার স্তূপ। এর মধ্যে প্লাস্টিক বর্জ্যই বেশি।
পরিবেশবিজ্ঞানী আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, সাকার ফিশ মূলত অ্যাকুরিয়ামের ময়লা পরিষ্কারের জন্য চাষ করা হয়। এখন বুড়িগঙ্গার দূষণ এলাকায় এই মাছের আধিক্যই বেশি। কিছু কিছু এলাকার দূষণ এতটাই বেশি যে নদীর তীরে সাকার ফিশ পর্যন্ত মরে পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
মঙ্গলবার (১৮ জানুয়ারি) বুড়িগঙ্গার বুকে ‘শ্যামপুরের ডাইং ইন্ডাস্ট্রি এবং নদী দূষণ’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে অতিথিরা নদী দূষণের ভয়াবহতা তুলে ধরেন। ইউএসএআইডি, এফসিডিও এবং কাউন্টারপার্ট ইন্টারন্যাশনালের সহায়তায় দূষণবিরোধী অ্যাডভোকেসি প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ওয়ায়টার্স কিপার বাংলাদেশ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ এবং স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র ক্যাপস-এর সমন্বয়ে গঠিত কনসোর্টিয়ামের উদ্যোগে এই আয়োজন করা হয়।
আশপাশের বিভিন্ন ডাইং কারখানা থেকে আসা কেমিক্যাল বর্জ্য কীভাবে নদীতে এসে মিশেছে, সেটি সরজমিনে ঘুরে দেখান তারা। নদী বাঁচাতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আবেদনও জানান। দূষণবিরোধী এই সংবাদ সম্মেলনে শ্যামপুর ডাইং ইন্ডাস্ট্রির মাধ্যমে নদী দূষণের কিছু তথ্যও তুলে ধরা হয়।
ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সিনিয়র সদস্য হানিফ সহিদ, বুড়িগঙ্গা নদী মোর্চার অন্যতম সদস্য ও শিশুদের মুক্ত বায়ু সেবন সংস্থার মো. সেলিম, যুব বাপা কর্মসূচির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট রাওমান স্মিতা, যুব বাপা কর্মসূচির সদস্য দেওয়ান নূরতাজ আলম, ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের প্রকল্প সমন্বয়কারী মো. কামরুজ্জামান এবং প্রকল্প পর্যবেক্ষক ও মূল্যায়ন কর্মকর্তা এম এম কবির মামুন।
সংবাদ সম্মেলনের মূল ব্যক্তব্যে অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, শ্যামপুরের দূষণের বাস্তবিক অবস্থা বিচারে ওয়াটারকিপার্স কনসোর্টিয়াম বিভিন্ন ঋতুতে পানিতে প্রাওয়া ৯টি ভিন্ন ভিন্ন রাসায়নিক উপাদান নিয়ে গবেষণা চালায়। পানির রাসায়নিক উপাদান বিশ্লেষণ করে একটি গুণমান সূচক দাঁড় করানো হয়। চারটি ভিন্ন ভিন্ন ইনডেক্সিং পদ্ধতির মধ্য থেকে সবচেয়ে আধুনিক ও উপযোগী পদ্ধতি সিসিএমই ওয়াটার কোয়ালিটি ইনডেক্স ব্যবহার করা হয়। এই সূচকে পানির অবস্থা বিশ্লেষণে পানিকে পাঁচটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। শ্যামপুরের পানির অবস্থান এই সূচকে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, শ্যামপুর ডাইং ইন্ডাস্ট্রির পানিতে পিএইচের মান প্রাক-বর্ষা, বর্ষা ও বর্ষা পরবর্তী মৌসুমে যথাক্রমে ৭.৬, ৬.৭ ও ৮.৫। অর্থাৎ এই এলাকার পানি বর্ষা মৌসুমে অম্লীয় বা অ্যাসিডিক হলেও বর্ষার আগে ও পরে তা ক্ষারীয় হয়ে যায়। এছাড়া এই এলাকার পানিতে অদ্রবীভূত কঠিন পদার্থের পরিমাণ তিন ঋতুতে যথাক্রমে ১০৮, ৫৭ ও ১৯৫। অথচ পানিতে এ ধরনের পদার্থের আদর্শ মান ১০। এই পদার্থগুলো নদীর তলদেশে পাতলা আস্তরণ তৈরি করে, যা জলজ উদ্ভিদের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে।
প্রাক-বর্ষা, বর্ষা ও বর্ষা পরবর্তী সময়ে শ্যামপুরের পানিতে রাসায়নিক অক্সিজেন চাহিদা বা সিওডি’র পরিমাণ পাওয়া গেছে যথাক্রমে ১৯০, ২২৭ ও ২৭৬। এটি আদর্শ মান ৪-এর চেয়ে বহু বহু গুণ বেশি। আবার তিন মৌসুমে জৈবিক অক্সিজেন চাহিদা বা বিওডি’র পরিমাণ পাওয়া গেছে যথাক্রমে ৮৭,৭২ ও ১০৬। এটিও আদর্শ মান ০.২-এর তুলনায় অনেক অনেক বেশি। এর অর্থ হলো, এই এলাকার পানিতে রাসায়নিক ও জৈবিক দুই ধরনের অক্সিজেনেরই ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে।
একই চিত্র পাওয়া গেছে নাইট্রোজেন, তেল ও গ্রিজের পরিমাণ এবং ফেনলের উপস্থিতিতেও। নাইট্রোজেনের পরিমাণ বেশি হওয়ায় স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হয়। পানিতে তেল ও গ্রিজ বেশি হওয়ায় নদীর পানিতে স্বাভাবিক আলো প্রবেশ করতে পারে না এবং পানির উপরিভাগে একটি আস্তরণ তৈরি হয়। অন্যদিকে মাত্রাতিরিক্ত ফেনল শ্যামপুর এলাকায় বুড়িগঙ্গার পানিকে আরও বিষাক্ত এবং পানের সম্পূর্ণ অনুপযোগী করে তুলেছে।
সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে শরীফ জামিল বলেন, বুড়িগঙ্গা আমাদের প্রাণ। বুড়িগঙ্গা ঢাকার প্রাণ। তাই ঢাকাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে বুড়িগঙ্গাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। শ্যামপুরে বুড়িগঙ্গার পানির দূষণ পরীক্ষা করে দেখার দরকার পড়ে না। পানির দিকে তাকালেই বোঝা যায়।
তিনি বলেন, আমরা শ্যামপুর ডাইং কারখানার রাসায়নিক দূষণের প্রতিবাদ করি। কিন্তু আমরা চাই না এই শিল্প বন্ধ হোক। শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে যেন বর্জ্য সরাসরি না ফেলে পরিশোধন করে ফেলা হয়, তার ব্যবস্থা করা হোক। আমরা চাই টেকসই উন্নয়ন। আমরা চাই নদী আবার আগের রূপে ফিরে আসুক।
সংবাদ সম্মেলন থেকে ডাইং কারখানার বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা বন্ধ করা, ডাইং কারখানাগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে বর্জ্য শোধনাগার স্থাপন করা এবং জনস্বাস্থ্য ও জনস্বার্থ রক্ষায় সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও উদ্যোক্তাদের নিয়ে অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে সংহতি বক্তব্য দেন বুড়িগঙ্গা নদী মোর্চার অন্যতম সদস্য মো. সেলিম, বাপা’র সিনিয়র সদস্য হানিফ সহিদ এবং যুব বাপা কর্মসূচির সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট রাওমান স্মিতা।
এর আগে সকালে ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ কনসোর্টিয়াম ও বুড়িগঙ্গা নদী মোর্চার সদস্যরা বিভিন্ন গণমামাধ্যমের কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে দোলেশ্বর গুদারাঘাট থেকে নৌকায় করে বুড়িগঙ্গার বিভিন্ন পয়েন্টে ডাইং শিল্পের মাধ্যমে বুড়িগঙ্গার পানি দূষণের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন।
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর
বুড়িগঙ্গা দূষণ রাসায়নিক বর্জ্য শ্যামপুর ডাইং শ্যামপুরে বুড়িগঙ্গা