ধর্ষণের শিকার তাই বের করে দিল মাদ্রাসা
২১ জানুয়ারি ২০২২ ২৩:২১
রাজশাহী: আট বছরের শিশুটির ভর্তি বাতিল করে তাকে মাদ্রাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। ফেরত দেওয়া হয়েছে ভর্তি ও আবাসিকের জন্য জমা দেওয়া টাকাও। তার অপরাধ সে বছরদুই আগে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। পরে শিশুটিকে একটি স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ বলছে অন্য শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা আপত্তি জানানোয় শিশুটির ভর্তি বাতিল করা হয়েছে। রাজশাহীর নগরীর হড়গ্রাম মুন্সিপাড়া এলাকার এক আবাসিক মাদ্রাসায় এ ঘটনা ঘটেছে।
ভুক্তভোগী শিশুর মা জানান, ১০ দিন আগে নগরীর উম্মাহাতুল মু’মিনীন মহিলা মাদ্রাসায় তার মেয়েকে ভর্তি করা হয়েছিল। বেসরকারি এই মাদ্রাসাটিতে শিক্ষার্থীদের আবাসনের ব্যবস্থা থাকায় তারা ভেবেছিলেন, এখানে ভর্তি করলে তার সন্তান নিরাপদে থাকবে। তবে তিন দিন পরই তাকে মাদ্রাসা থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। ফেরত দেওয়া হয়েছে ভর্তি ও আবাসিকের জন্য জমা দেওয়া টাকাও।
শিশুটির মা বলেন, ‘ভর্তির তিন দিন পর আমার মেয়েকে মাদ্রাসার গেটের বাইরে বের করে গেট লাগিয়ে দেয়। মেয়েটা গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে তখন কাঁদছিল। পরে পরিচালক আমাকে ডাকল। আমাকে বলল- “আপনার মেয়েকে নিয়ে গিয়ে অন্য কোথাও ভর্তি করেন।” আমি বললাম, আমার মেয়ের কোনো সমস্যা? তখন বললেন, “না, দূরে কোথাও ভর্তি করেন।” আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, আপনার মেয়ের সঙ্গে যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটে, তাহলে আপনি কি করবেন? তখন কোন কথা বলছে না সে (মাদ্রাসা পরিচালক)। আমাকে টাকাটা ফেরত দিয়ে মেয়েকে বের করে দিল। আমার মেয়ের কোন সমস্যা দেখাতে পারছে না, খালি বলছে- “দূরে কোথাও ভর্তি করেন”।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদ্রাসাটির পরিচালক মাওলানা মোঃ হাবিবুল্লাহ বলেন, ‘মেয়েটার ব্যাপারে অন্য শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা এসে অভিযোগ করে আমাকে বলেছিল যে, তার সমস্যা আছে। আমি নাকি যাকে তাকে ভর্তি নিয়ে নিচ্ছি। অভিভাবকদের আপত্তি থাকায় এই মেয়েটার ভর্তি বাতিল করতে হয়েছে। টাকাও ফেরত দেওয়া হয়েছে।’
২০২০ সালের ২১ মার্চ প্রতিবেশী এক কিশোরের হাতে ধর্ষণের শিকার হয় শিশুটি। সে এখনও পুরোপুরি সুস্থ নয়। ব্যাথা অনুভবের পাশাপাশি ব্যাপক স্বাস্থ্যহানীও ঘটেছে তার। একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে চিকিৎসা চলছে।
জানা যায়, ভুক্তভোগী শিশুটির বাবা এক সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে প্রতিবন্ধী হওয়ার পর থেকে অটোরিকশা চালান। আর রাজশাহীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে আয়া হিসেবে চাকরি করেন শিশুটির মা। নিজের কোন ভিটেমাটি না থাকায় রেলের জমিতে গড়ে ওঠা বস্তিতে বসবাস করেন।
ঘটনার দিন মা হাসপাতালে ও বাবা অটোরিকশা চালাতে বাইরে থাকাকালীন প্রতিবেশী ওই কিশোর বাড়িতে গিয়ে শিশুটির কাছে দিয়াশলাই চায়। ওই শিশু দিয়াশলাই দিলে কিশোর সেটি নিয়ে চলে যায়। দিয়াশলাইয়ের জন্য ওই শিশুও পিঁছু নেয় তার। তখন বাড়ির পাশের নির্জন স্থানে শিশুটিকে নিয়ে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে ওই কিশোর। ধারণ করা হয় ভিডিও। ঘটনা জানাজানি হলে পুলিশ তাকে আটক করে। জব্দ করা হয় মোবাইল ফোন। অভিযুক্ত কিশোর ধর্ষক এখন জেলে।
শিশুটির মা জানান সেই ঘটনার পর থেকেই সবাই তার মেয়েটাকেই দোষ দিচ্ছেন ও তাদেরকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করছেন। তার সন্তানের সঙ্গে যে অন্যায় ঘটল তার প্রতিকার চেয়ে এ প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ‘মেয়েটাকে নিয়ে আমি ভুক্তভোগী হচ্ছি। মানুষজন শুনলে বলছে, সমাজ নষ্ট হবে। অনেক মানুষ আমাকে এ ধরনের কথা বলেছে। আশপাশের মানুষ আমাকেই বলে আমি নাকি মেয়ে শাসি (শাসন করি) না। ছোট মানুষ কী শাসব? একা পেয়ে তো আমার মেয়েটারই ক্ষতি করা হয়েছে। আমি তো পেটের দায়ে কাজে যাই। আমার স্বামী প্রতিবন্ধী। ওর ইনকামে যদি চলত, তাহলে তো কাজে যেতাম না। চার হাজার টাকা বেতনে কাজ করি।’
‘সমাজের কাছে এত লাঞ্ছনা শুনতে আমার খুবই খারাপ লাগছে। মেয়েটাকে সবাই খারাপ চোখে দেখছে। ছোট সেটাও কেউ বুঝছে না। ওই ঘটনাটাই তুলে ধরছে সবাই। মেয়েটাকে একটা স্কুলে ভর্তি করেছি। ওখানেও যদি কেউ কিছু বলে, আবার যদি বের করে দেয়, এই ভয় পাচ্ছি। এখন আমি একটা সুষ্ঠু বিচার চাই। যে আমার মেয়ের ক্ষতি করেছে তার যেন শাস্তি হয়।’
নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এসএম মাসুদ পারভেজ বলেন, ‘শিশুটার মায়ের দায়ের করা মামলাটা তদন্তাধীন আছে। তদন্ত চলাকালে বেশিকিছু বলব না। তবে প্রাথমিকভাবে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে। এখন ডিএনএ টেস্ট করা হবে। তারপর অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে। ডিএনএ টেস্ট না হওয়ায় অভিযোগপত্র দেওয়া যাচ্ছে না।’
সারাবাংলা/আরএফ/