বগুড়ার নারী ভাইস চেয়ারম্যান-সিজিএ কর্মকর্তা মিলে প্রশ্নফাঁস
২২ জানুয়ারি ২০২২ ১৯:১৯
ঢাকা: সরকারি বিভিন্ন দফতরে নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার নারী ভাইস চেয়ারম্যান মাহবুবা নাসরীন রুপা ও প্রতিরক্ষা মহা হিসাব নিরীক্ষকের কার্যালয়ের অধীন ডিফেন্স ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্টে কর্মরত মাহমুদুল হাসান আজাদ। প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত শুক্রবার ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ যে দশজনকে গ্রেফতার করেছে তাদের মধ্যে আজাদ ও রুপা রয়েছে।
গোয়েন্দা পুলিশের দাবি- মুলত সিজিএ অফিসে কর্মরত আজাদ ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান রুপার পরিকল্পনাতেই প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত এই চক্রটি গড়ে ওঠে। এরা দুজন এই চক্রটিকে নেতৃত্ব দিতেন।
শুক্রবার (২১ জানুয়ারি) এই চক্রের সাত সদস্য ও তিন পরীক্ষার্থীকে গ্রেফতারের পর শনিবার (২২ জানুয়ারি) ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার বলেন, গ্রেফতারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে জানা গেছে চক্রটির একটি গ্রুপ পরীক্ষার আগে থেকে পরীক্ষার্থী সংগ্রহ ও অর্থ হাতিয়ে নেয়। নগদ, রকেট ও বিকাশসহ মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস ও চাকরি পাইয়ে দিতে অর্থ লেনদেন হয়। টার্গেট পরীক্ষার্থী প্রতি ১৪ থেকে ১৬ লাখ টাকার লিখিত চুক্তি হয়। যেহেতু এমসিকিউ পরীক্ষা, তাই এমসিকিউ পরীক্ষায় পাস করার পরই ভাইভা। তাই এমসিকিউ পরীক্ষার আগে কিছু টাকা নিয়ে নেয় চক্রের সদস্যরা। নিয়োগ পাওয়ার পর বাকি টাকা দেওয়ার চুক্তি হয়।
বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মাহবুবা নাসরীন রুপার ভূমিকা সম্পর্কে ডিবি প্রধান বলেন, ‘তার ভূমিকা ছিল মিডিয়ার কাজ করা। একটি গ্রুপ অর্থ সংগ্রহ করেছে। আরেকটি গ্রুপ ডিভাইস সরবরাহ করেছে। মাহবুবা নাসরীন রুপা নিজে পরীক্ষা দিয়েছে সঙ্গে অন্য পরীক্ষার্থীদের কাছে ডিভাইস সরবরাহের কাজ করেছে। গ্রেফতারদের মধ্যে চক্রের শিক্ষার্থী তিনজন, চক্রের সদস্য সাতজন। ১৮ শিক্ষার্থীর সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়েছিল। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত তদন্তে ৯ শিক্ষার্থীর মধ্যে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্রের উত্তর সরবরাহের তথ্য মিলেছে। এ চক্রের সঙ্গে আরও যারা জড়িত রয়েছে, তাদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’
পরীক্ষা বাতিল হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে হাফিজ আক্তার বলেন, কোনো সংস্থাই চায় না পরীক্ষা বিতর্কিত হোক। পরীক্ষা বাতিল হবে কি না তা সংশ্লিষ্ট দফতরই সিদ্ধান্ত নেবে।
গ্রেফতার অন্যান্যরা হলেন নোমান সিদ্দিকী, আল আমিন রনি, নাহিদ হাসান, শহীদ উল্লাহ, তানজির আহমেদ, রাজু আহমেদ, হাসিবুল হাসান ও রাকিবুল হাসান। এ সময় তাদের কাছ থেকে ইয়ার ডিভাইস ছয়টি, মাস্টার কার্ড মোবাইল সিম হোল্ডার ছয়টি, ব্যাংকের চেক পাঁচটি, নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প সাতটি, স্মার্ট ফোন ১০ টি, বাটন মোবাইল ছয়টি, প্রবেশপত্র ১৮টি ও চলমান পরীক্ষার ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র ৩ সেট জব্দ করা হয়।
তিনি বলেন, শুক্রবার সরকারি ব্যাংকের বিভিন্ন পদ ও অডিটর পদে নিয়োগের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে তথ্য পেয়ে গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগের একটি টিম বিশেষ চালিয়ে রাজধানীর মিরপুর, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল ও কাকরাইল এলাকা থেকে গ্রেফতার করে।
গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ডিবি পুলিশ কাকরাইলে অবস্থিত নিউ শাহিন হোটেল থেকে অসাধু উপায়ে অবলম্বনকারী দুইজন পরীক্ষার্থীকে গ্রেফতার করে। তাদের দেওয়া তথ্যমতে— কাফরুল থানাধীন সেনপাড়া পর্বতা এলাকার একটি অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ডিভাইস, প্রশ্নপত্র এবং উত্তর পত্রের খসড়াসহ ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয় । ডিবি পুলিশের অপর দল বিজিপ্রেস উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে অভিযান চালিয়ে পরীক্ষার্থী এবং অন্যতম পরিকল্পনাকারী মাহবুবা নাসরীন রুপাকে টাকা, ডিজিটাল ডিভাইসসহ গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে তার দেওয়া তথ্যমতে অপর আসামিদেরকে গ্রেফতার করা হয়।
প্রতিরক্ষা মহা হিসাব নিরীক্ষক এর কার্যালয়ের অধীন ডিফেন্স ফাইন্যান্স ডিপার্টমেন্টের ৫৫০টি অডিটর পদে নিয়োগের জন্য গতকাল দুপুর ৩ টা থেকে বিকেল সোয়া ৪ টা পর্যন্ত ৭০ নাম্বারের এমসিকিউ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।
ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশের নিকট তথ্য ছিল পূর্বে বিভিন্ন সময় গ্রেফতার হওয়া কতিপয় ব্যক্তি ইলেকট্রনিক ডিভাইস, মোবাইল অ্যাপস এবং ব্যক্তি পরিবর্তন করে পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস, উত্তর/সমাধান সরবরাহসহ অসদুপায় অবলম্বন করতে পারে।
গ্রেফতারকৃত আসামিদের মধ্যে মাহমুদুল হাসান আজাদ, নাহিদ হাসান, আল আমিন সিদ্দিকী ইতোপূর্বেও প্রশ্নপত্র ফাঁস সংক্রান্তে ২০১৩, ২০১৬ এবং ২০১৯ সালে গ্রেফতার হয়েছিল। ওই সময় তারা বরখাস্ত হয়েছিলেন। এরপর জেল থেকে বের হয়ে একই কাজে সম্পৃক্ত হন।
গ্রেফতার আসামীরা অন্যান্য আসামিদের যোগসাজশে বিভিন্ন সোশ্যাল অ্যাপস ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে পরীক্ষা হল থেকে প্রশ্ন ফাঁস করে দেওয়া, বাইরের রুমে ওয়ানস্টপ সমাধান কেন্দ্র বসিয়ে স্মার্ট ওয়াচ, ইয়ার ডিভাইস, মোবাইল এসএমএস এর মাধ্যমে উত্তর সরবরাহ করার কাজ করে থাকে। ইতোপূর্বে গ্রেফতাররা বিভিন্ন ব্যাংক, অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন অধিদফতর, পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতর, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ, সিটি করপোরেশন, বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন, হিসাব নিরীক্ষক কার্যালয়, জ্বালানি অধিদফতর, সমবায় অধিদফতর, খাদ্য অধিদফতর, সাধারণ বীমা করপোরেশনসহ অন্যান্য সংস্থার প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং উত্তরপত্র সরবরাহ করে বিপুল পরিমাণ টাকা বিভিন্ন ব্যাংক এবং বিকাশের মাধ্যমে এবং নগদে হাতিয়ে নিয়েছে বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে।
সারাবাংলা/ইউজে/একে