এক মাস ধরেই জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ঢাকার বায়ু
২৪ জানুয়ারি ২০২২ ১১:৪১
ঢাকা: এক মাস ধরেই ধুঁকছে ঢাকা। এর কোনো একটি দিনেও এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিআই) অনুযায়ী ঢাকায় বায়ু মান ছিল না স্বাস্থ্যকর পর্যায়ে। শুধু তাই নয়, বাতাসে পিএম২.৫ তথা ২ দশমিক ৫ মাইক্রন বা এর চেয়ে ছোট আকৃতির ক্ষুদ্র কণার উপস্থিতির দিক থেকেও এই এক মাসের পুরোটা সময় ছিল অস্বাস্থ্যকর। দুইটি সূচকেই আট দিন করে চরম অস্বাস্থ্যকর মানেও পৌঁছে গেছে ঢাকার বাতাস।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীতের শুষ্ক এই মৌসুমে এমনিতেই বাতাসে ধুলাবালির প্রকোপ বেশি থাকে। কিন্তু বায়ু মানের গত এক মাসের পরিস্থিতি রাজধানীবাসীর জন্য ভয়াবহ স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে শ্বসনতন্ত্রের বিভিন্ন রোগের প্রকোপ যেমন বেড়ে গেছে, তেমনি এই অস্বাস্থ্যকর বায়ু মানের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যঝুঁকিও রয়েছে।
বৈশ্বিক বায়ু মান পর্যবেক্ষক সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান একিউএয়ার বিশ্বের বড় বড় সব শহরের বায়ুমানের অবস্থা তুলে ধরে। প্রতিষ্ঠানটির একিউআই ইনডেক্স বলছে, গত ২৫ ডিসেম্বর থেকে ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত ৩০ দিনের মধ্যে আট দিনে বায়ু মান ছিল চরম অস্বাস্থ্যকর (একিউআই ২০০ থেকে বেশি)। বাকি ২২ দিনেও বায়ু মান ছিল অস্বাস্থ্যকর (একিউআই ১৫০ থেকে ২০০)। তবে এর মধ্যেও একাধিক দিন একিউআইয়ের মান ছিল ১৯০-এর বেশি, অর্থাৎ চরম অস্বাস্থ্যকরের কাছাকাছি। এর মধ্যে গত ১৮ জানুয়ারি থেকে বায়ু ঢাকার মান টানা চরম অস্বাস্থ্যকর অবস্থায় আছে। ২২ জানুয়ারি এই সূচক ২৭৯-তে পৌঁছায়, যা রীতিমতো বিপর্যয়কর পরিস্থিতির (একিউআই ৩০০ থেকে বেশি) দিকে ধাবিত করছে ঢাকাকে।
এদিকে, পিএম২.৫ হলো ২ দশমিক ৫০ মাইক্রনের চেয়ে ছোট যেসব বস্তুকণা যেগুলো ফুসফুস পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে। ফলে এসব ক্ষুদ্র কণা ফুসফুস তথা শ্বসনতন্ত্রের বিভিন্ন রোগের জন্য দায়ী। একিউএয়ারের তথ্য বলছে, বাতাসে এই পিএম ২.৫-এর উপস্থিতির দিক থেকেও এই এক মাসের কোনো একটি দিনও স্বাস্থ্যকর অবস্থায় ছিল না ঢাকার বাতাস। একিউএয়ারের তথ্য বলছে, এই ৩০ দিনের মধ্যে আট দিনই বাতাসে পিএম২.৫-এর উপস্থিতির মাত্রা ছিল চরম অস্বাস্থ্যকর। বাকি ২২ দিনেও বাতাসে এসব ধূলিকণার উপস্থিতি ছিল অস্বাস্থ্যকর মাত্রায়। সবশেষ ১৮ জানুয়ারি থেকে টানা ছয় দিন ঢাকার বায়ুতে পিএম২.৫ রয়েছে চরম অস্বাস্থ্যকর অবস্থায়। গত ২২ জানুয়ারি এর মাত্রা সর্বোচ্চ ১৯২.৭-তে পৌঁছায়।
আরও পড়ুন- বায়ু দূষণে টানা শীর্ষে ঢাকা
ঢাকার বায়ুমানের এই পরিস্থিতি নিয়ে স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপসের) প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, শীতের শুষ্ক মৌসুমে বায়ু দূষণ এমনিতেই বেড়ে যায়। এসময় বিশেষ করে সন্ধ্যার পর বাতাসে আর্দ্রতা বেড়ে গেলে এসময়ে সৃষ্ট অতিরিক্ত ধুলাবালি ওজনে ভারী হওয়ায় ওপরে না উঠে নিচে নেমে আসে। ধুলাবালি বায়ুমণ্ডলের নিচের দিকে অবস্থান করায় বায়ু দূষণের পরিমাণ বেশি দেখা যায়। অন্য মৌসুমে আর্দ্রতা কম থাকায় ধুলাবালি ওপরের দিকে থাকে, ফলে বায়ু দূষণ কম দেখা যায়।
তিনি আরও বলেন, আবার দীর্ঘদিন ধরে বৃষ্টি না থাকার কারণে শুষ্কতা বেড়ে গেলে রাস্তা ও মাটির ধুলাবালি ওপরে উঠে গাছসহ অন্যান্য পৃষ্ঠতলে জমা হয়। আগের দিনের গাছের পাতার ধুলাবালির সঙ্গে প্রতদিন রাস্তা বা মাটি থেকে নতুন করে ধুলা যুক্ত হয়ে দূষণের পরিমাণ বাড়ায়।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ু দূষণ মূলত চার ধরনের— ধূলিদূষণ; গ্যাসীয় পদার্থের দূষণ; সীসা, পারদ, ক্যাডমিয়াম, নিকেলের মতো ভারী পদার্থের দূষণ; এবং অণুজীব বা মাইক্রোবিলিয়াল দূষণ। এর মধ্যে মাটির টুকরোর সঙ্গে টায়ার, প্লাস্টিক, সিনথেটিক, ফুলের রেণু, কিছু পোড়ানোর ফলে উৎপন্ন কার্বনগুলো মূলত ধূলিকণার অংশ। গ্যাসীয় পদার্থের মধ্যে রয়েছে কার্বন মনো অক্সাইডের মতো ক্ষতিকর গ্যাস। এগুলোর পাশাপাশি হেভি মেটাল বা ভারী ধাতবের দূষণও বাড়ছে ঢাকাসহ সারাদেশের বাতাসেই।
ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, আমাদের সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় ঢাকা ও খুলনা অঞ্চলের বাতাসে সীসার পরিমাণ বেশি পাওয়া গেছে। স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে এই পরিমাণ সাত থেকে আট গুণ বেশি। বিশেষ করে ঢাকার মাটিতে এই সীসার পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। এসব দূষণের ফলে শুষ্ক মৌসুমে রোগব্যাধি বেড়ে যায় বলে জানান এই পরিবেশবিজ্ঞানী।
তিনি বলেন, বর্তমানে বিভিন্ন ফুসফুসের ব্যাধি নিয়ে চিকিৎসকের কাছে রোগীর ভিজিটের পরিমাণ বেড়েছে। ইনহেলার ও অক্সিজেন ব্যবহারের পরিমাণ বেড়েছে, যার অন্যতম কারণ বায়ুদূষণ। আমরা দেখতে পেয়েছি— বায়ু দূষণ বাড়লে এসব রোগের প্রকোপ বাড়ে, বায়ু দূষণ কমলে এসব রোগের প্রকোপও কমে। বিশেষ করে বর্ষাকালে ফুসফুস তথা শ্বসনতন্ত্রের রোগ কমের যায়।
বায়ু দূষণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব তুলে ধরে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, বায়ু দূষণ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ— দুইভাবেই আমাদের ক্ষতি করে। প্রথমত, সরাসরি ফুসফুস আক্রান্ত হওয়ায় শ্বসনতন্ত্রের নানাবিধ সংক্রামক ব্যাধি হয়। বায়ুতে থাকা নানা মাত্রার পার্টিকেল বা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা রক্তে মিশে যাওয়ায় ফুসফুসের ক্যানসারের ঝুঁকি থাকে। আবার লিভার, কিডনি ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কমে যায় এসব অঙ্গের কার্যক্ষমতা।
পরোক্ষ ক্ষতিকর প্রভাব তুলে ধরে ডা. লেনিন বলেন, গাছের পাতায় ধুলা জমে থাকায় সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে গাছের অক্সিজেন উৎপাদনের সক্ষমতা কমে। দূষিত পদার্থ বায়ু থেকে জলে মিশে জনজীবনে প্রভাব ফেলে। দূষণ বাতাস থেকে পানির মাধ্যমে জলজ প্রাণি ও উদ্ভিদের সঙ্গে যেমন মেশে, তেমনি মিশে যায় ফসলেও। আবার মাটিতেও দূষণ উপাদান মিশে মাটি দূষণ করে। এভাবে পানি ও মাটির মাধ্যমে খাবারে মিশে যায় ক্ষতিকর দ্রব্য। এসব খাদ্য গ্রহণের ফলে দূষণ উপাদান খাবারের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে।
দূষণের ফলে গড় আয়ুর পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রভাব তুলে ধরে ডা. লেনিন বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে— এভাবে কেবল দূষণের কারণে মানুষের গড় আয়ু সাত বছর কমে যায়। এখন বাংলাদেশিদের গড় আয়ু ৭২ বছর। দূষণ না থাকলে এটি ৭৯ বছরে দাঁড়াত। এছাড়া অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষ। শীতকালের যে কয়েক মাস টানা বায়ু দূষণ থাকে, সেসময় মানুষের মুখে খাওয়ার ওষুধের পাশাপাশি ইনহেলার ও অক্সিজেন কেনার পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে বায় দূষণের কারণে মানুষের চিকিৎসাব্যয় বেড়ে যায়, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিতে প্রভাব ফেলে। ফলে উন্নয়নের সুফল ভোগ করতে পারছে না সাধারণ মানুষ।
বায়ু দূষণের কারণে শ্বসনতন্ত্রসহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক জটিলতার ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার কথা জানালেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) টক্সিকোলজিস্ট ডা. ফজলে রাব্বী চৌধুরী। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, বাতাসে ভারী বস্তুর উপস্থিতির কারণে মানুষের নানারকম স্বাস্থ্যঝুকি দেখা দেয়। দীর্ঘমেয়াদে অর্থাৎ টানা ১০ থেকে ১৫ বছর এরকম দূষিত বায়ুর সংস্পর্শে থাকলে নানারকম রোগব্যধি দেখা দেয়। শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগ যেমন— হাঁপানি, ব্রংকাইটিস, ফাইব্রোসিস (ফুসফুস শক্ত হয়ে যাওয়া) ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। আবার ‘সলিড অর্গ্যান’ যেমন— লিভার, কিডনি, পাকস্থলী ও অন্ত্রের ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
তিনি বলেন, বায়ু দূষণের সরাসরি ক্ষতির মুখে পড়েন গর্ভবতী নারী ও তার গর্ভের সন্তান। গবেষণায় দেখা গেছে— বাতাসে সীসা বা এমন ভারী বস্তুর উপস্থিতির ফলে গর্ভবতী নারী ও গর্ভের সন্তান সরাসরি ক্ষতির সম্মুখীন হয়। গর্ভের শিশুর বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়, গঠনগত সমস্যা দেখা দেয়।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালের নাক-কান-গলা বিশেষজ্ঞ ডা. খন্দকার মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, বায়ু দূষণের সরাসরি শিকার ফুসফুস হলেও এর মাধ্যমে আরও নানারকম রোগব্যধি দেখা দেয়। আমরা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে যে বায়ু গ্রহণ করি তা সবার আগে ফুসফুসে যায়। ফুসফুসে থাকা রক্তনালীর মাধ্যমে অক্সিজেন পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে বাতাসে মিশে থাকা ধুলিকণা ও দূষণ উপাদানও রক্তের মাধ্যমে গোটা শরীরে ছড়িয়ে যায়। আর ভারী বস্তুকণা ফুসফুসের ক্ষতি করে যার মাধ্যমে শ্বসনতন্ত্রের নানা ধরনের রোগ দেখা দেয়। এছাড়াও বায়ু দূষণের ফলে অ্যালার্জিজনিত সমস্যা বেড়ে যায়। যারা এরই মধ্যে এই সমস্যায় ভুগছেন, তাদের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায় এসময়।
ফাইল ছবি
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর
ঢাকার বাতাস পিএম২.৫ ফুসফুসের রোগ বায়ু দূষণ বায়ুমান শ্বসনতন্ত্রের রোগ