বায়ু পরিস্থিতি বিপজ্জনক হলেও উদাসীন সরকার
২৬ জানুয়ারি ২০২২ ২২:৪০
ঢাকা: রাজধানী ঢাকার বায়ু দূষণ পরিস্থিতি টানা একমাস ধরেই অস্বাস্থ্যকর। এর মধ্যে টানা কয়েকদিন ধরে চরম অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতিও চলছিল। এর মধ্যে গত মঙ্গলবার (২৬ জানুয়ারি) সব রেকর্ড ভেঙে বিপজ্জনক অবস্থায় পৌঁছে ঢাকার বায়ুমান। বায়ু দূষণ পরিমাপক সংস্থা এইকিউ এয়ারের দূষণ সূচক ৩০০ ছাড়ালেই যেখানে পরিস্থিতকে বিপর্যয়কর ধরা হয়, সেখানে এদিন ঢাকার বায়ুতে এই সূচক ৪৫০ পর্যন্ত উঠে যায়।
বায়ুমান সূচক এত তীব্র মাত্রায় পৌঁছালে যথাসম্ভব সবাইকে ঘরে রাখাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি করার সুপারিশ করে থাকেন পরিবেশবিজ্ঞানীরা। দেশের পরিবেশবিদরাও বলছেন, ঢাকার বায়ু দূষণের এই পরিস্থিতিতে এখনই জরুরি কিছু পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয় নিয়ে চরম উদাসীনতা দেখা যাচ্ছে বলে অভিযোগ তাদের।
একিউআই সূচকে ৩০১ থেকে ৫০০ স্কোরকে বিজ্জনক হিসেবে ধরা হয়। সেখানে মঙ্গলবার ঢাকার বায়ুমান সর্বোচ্চ ৪৫৪ পর্যন্ত উঠে যায়। সন্ধ্যা পর্যন্তও এই মান ছিল ৩০০’র বেশি। সন্ধ্যার পর এই স্কোর আড়াইশকে নেমে আসে, যেটিও চরম ক্ষতিকর। এর আগে অবশ্য ১৮ জানুয়ারি থেকেই টানা বায়ু দূষণের শীর্ষে আছে ঢাকা। আর গত এক মাস ধরেই ঢাকার বায়ুমান অবস্থান করছে অস্বাস্থ্যকর ও চরম অস্বাস্থ্যকর অবস্থায়।
‘পরিস্থিতি বিপজ্জনক, গুরুত্ব নেই সরকারের কাছে’
চলমান পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সারাবাংলাকে বলেন, এমন বায়ু দূষণ পরিস্থিতিতে জরুরি অবস্থা জারি করা উচিত। কিন্তু সরকার চরম অসংবেদনশীল আচরণ করেছে। জনস্বাস্থ্য নিয়ে তারা বিন্দুমাত্র ভাবছে না। উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়ে মেগা প্রজেক্ট বানানো হলেও এসব প্রজেক্টের মাধ্যমে যেভাবে বায়ু দূষণ হচ্ছে, তা নিয়ন্ত্রণে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছ না। পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন করার আহ্বান জানানো হলেও তারা তা মানছে না।
আরও পড়ুন- এক মাস ধরেই জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ঢাকার বায়ু
তিনি বলেন, গত কয়েক বছর ধরেই বায়ু দূষণে বাংলাদেশ এক বা দুই নম্বরে আছে। কিন্তু জনস্বাস্থ্য নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ তো দূরের বিষয়, সরকারের তেমন কোনো উদ্বেগই নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ু দূষণের ফলে ক্যানসারসহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। গড় আয়ু কমেছে ৭ বছর। আর শ্বসনতন্ত্রের রোগে ভোগার কারণে চিকিৎসা ব্যয় সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। এভাবে উন্নয়নের সুফল মানুষ তো ভোগ করতেই পারছে না, উল্টো অসুস্থতা ও চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে কমে যাচ্ছে জীবনমান।
বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল মনে করেন, ঢাকার বায়ু দূষণ পরস্থিতি মানবিক বিপর্যয় তৈরি করেছে। জনগণকে সমস্যা জানিয়ে সতর্ক করার দায়িত্ব সরকারের হলেও তারা জনগণকে দূষণ পরিস্থিতি থেকে বাঁচার জন্য করণীয় বিষয়ে কিছুই জানাচ্ছে না বলে অভিযোগ তার।
শরীফ জামিল বলেন, একটি নগরের বায়ু ক্রমাগত চরম অস্বাস্থ্যকর থাকার পর আজ একিউআই মাত্রা সাড়ে চারশ অতিক্রম করে গেছে। এ অবস্থায় সরকারের তরফ থেকেই নাগরিকদের সচেতন করা উচিত ছিল। হাঁপানি, ব্রংকাইটিসসহ অন্যান্য ফুসফুসের সংক্রমণে আক্রান্ত রোগীদের ঘরে থেকে বের না হওয়ার আহ্বান জানানোর কথা ছিল। কিন্তু আমরা অবাক হয়ে লক্ষ করলাম— সরকারের দিক থেকে সচেতনতা তৈরি তো দূরের কথা, বিষয়টিকে গুরুত্বই দেওয়া হচ্ছে না। একাধিক মন্ত্রণালয় মিলে বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে কাজ করার কথা থাকলেও লক্ষ্যণীয় কোনো উদ্যোগ আমাদের চোখে পড়ছে না।
এদিকে নির্মল বায়ু আইনের খসড়া থাকার পরেও তা অজ্ঞাত কারণে পাস করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করছেন পরিবেশ আন্দলনকর্মীরা। শরীফ জামিল ও সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান মনে করেন, এই আইন পাসের ক্ষেত্রে সদিচ্ছার চরম অভাব দেখা যাচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে পরিবেশ আন্দোলনকর্মীরা এই নিয়ে কথা বললেও সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সেসব কথা পৌঁছাচ্ছে না।
তারা বলছেন, সংসদের ৭০ শতাংশ সদস্যই ব্যবসায়ী। যে কারণে তারা পরিবেশ নিয়ে খুব বেশি ভাবছে বলে মনে হয় না। আবার সরকারের একটি অংশে ভালো শক্তিও আছে, যারা পরিবেশ বাঁচাতে চায়। কোনো কারণে তাদের কাছে পরিবেশ রক্ষার বার্তা পৌঁছাচ্ছে না।
জনগণসহ সরকারের আন্তরিক অংশের কাছে নিজেদের বার্তা পৌঁছাতে না পারার দায়ভার স্বীকার করে শরীফ জামিল বলেন, বায়ু দূষণ নিয়ে জনগণকে সচেতন করতে আরও জোরালোভাবে কাজ করতে চান তারা।
কাঠগড়ায় মেগা প্রজেক্ট
শীতকালীন শুষ্ক মৌসুমে ঢাকার বায়ু দূষণ নিয়মিত বাস্তবতা হলেও ঢাকার মধ্যে একাধিক মেগা প্রজেক্টের খোঁড়াখুঁড়ির ফলে কয়েক বছর ধরে পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা। বাপা সাধারণ সম্পাদক ও বেলার প্রধান নির্বাহী রিজওয়ানা মনে করেন, পরিবেশ রক্ষা করেই উন্নয়ন কার্যক্রম চালানো সম্ভব। কিন্তু সরকারের মধ্যে এ বিষয়ে যথেষ্ট আন্তরিকতা নেই। বরং এত গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য ইস্যুতেও তারা অনেকটাই নির্বিকার।
আরও পড়ুন- বায়ু দূষণে টানা শীর্ষে ঢাকা
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং পরিবেশ অধিদফতরের প্রতিনিধিরাও মনে করেন, মেগা প্রজেক্টের কারণে শীতকালে ঢাকার দূষণ চরম মাত্রায় পৌঁছে। এছাড়াও সাধারণ মানুষের অসচেতনতা তো আছেই।
শরীফ জামিল ও রিজওয়ানা হাসান বলেন, উন্নয়ন কার্যক্রম চলবেই। কিন্তু সবার আগে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশকে গুরুত্ব দিতে হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান বায়ু দূষণের জন্য দায়ী, তাদের জবাবদিহিতার মধ্যে আনতে হবে। ধূলা দূষণ নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে সংশ্লিষ্টদের বাধ্য করতে হবে।
কী করছে ২ সিটি করপোরেশন
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) তরফ থেকে বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রতিদিন পানি ছিটানোর পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে সবাইকে বাইরে বের হলে মাস্ক পরতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে বলে জানালেন সংস্থাটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জোবায়দুর রহমান।
তিনি বলেন, আমরা এক ধরনের জরুরি অবস্থার মধ্যেই আছি। তাই নতুন করে জরুরি অবস্থা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করছি না। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণের জন্য এরই মধ্যে মাস্ক পরার কর্মসূচি চলছে। নগরবাসীকে বিনা পয়সায় মাস্ক দেওয়ার পাশাপাশি কেউ মাস্ক না পরলে জরিমানাও করা হচ্ছে।
চলমান মেগা প্রকল্পগুলোর কারণে যে পরিমাণ ধূলা তৈরি হচ্ছে, তা নিয়ন্ত্রণে প্রতিদিন ১৪টি গাড়ি থেকে পানি ছিটানো হচ্ছে বলে জানাচ্ছে ডিএনসিসি। ছোট-বড় নির্মাণ প্রকল্পের সঙ্গে ধূলা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়মিত বৈঠকও চলছে জানিয়ে এই সিটির স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বলেন, ধূলা নিয়ন্ত্রণ না করায় অনেককে জরিমানাও করা হচ্ছে। সবাই সমানভাবে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করলেই কেবল দূষণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
এদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকায় তেমন দূষণ নেই বলে দাবি এই সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবিরের। তিনি বলেন, ‘পরিবেশ রক্ষার কথা মাথায় রেখেই ডিএসসিসি সব কার্যক্রম পরিচালনা করে।’ জনস্বাস্থ্য রক্ষায় জনগণকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, তারা যেন এখানে-সেখানে আবর্জনা ফেলা বা অন্যান্য দূষণ কার্যক্রম থেকে বিরত থাকেন।
ধূলা দূর করতে পানি ছিটানোর তথ্য জানিয়ে ডিএসসিরি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ সারাবাংলাকে বলেন, সপ্তাহে দুই দিন সাত থেকে আটটি গাড়ির মাধ্যমে শহরের বিভিন্ন এলাকায় পানি ছিটানো হয়। তবে কতখানি পানি ছিটানো হবে, তা নির্ভর করে ওয়াসার ওপর। নিয়মিত স্বল্পমূল্যে পানি সরবরাহের জন্য তাদের সঙ্গে সমন্বয় করার জন্য আলোচনা চলছে বলে জানালেন তিনি।
প্রয়োজন সমন্বিত পদক্ষেপ, আইন
দুই সিটি করপোরেশন পানি ছিটানোর বিষয়টিকে গুরুত্ব দিলেও কেবল এই পদক্ষেপে বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয় বলে মত বেলার প্রধান রিজওয়ানা হাসানের। তিনি বলেন, দূষণের জন্য দায়ী সব পক্ষকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারের সব পক্ষকে আন্তরিকতার সঙ্গে বায়ু দূষণ দূর করতে কাজ করতে হবে। যত দ্রুতসম্ভব এ সংশ্লিষ্ট আইন পাস করতে হবে।
বায়ু দূষণ ঠেকাতে প্রথমে বায়ু দূষণের বিষয়টি স্বীকার করে নেওয়ার আহ্বান জানালেন বাপার সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল। আইন পাসের ওপরও জোর দিচ্ছেন তিনি। বলেন, বায়ু দূষণ ও জনস্বাস্থ্য বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য সরকারকে আগে বিশ্বাস করতে হবে যে বায়ু দূষণ হচ্ছে। আর যত দ্রুতসম্ভব আইন পাস করতে হবে এবং উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকেও পরিবেশবান্ধব করতে হবে।
কী বলছে কর্তৃপক্ষ
বায়ু দূষণের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব কেয়া খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘একযোগে কয়েকটি বড় প্রকল্পের কাজ চলছে। ফলে দূষণ পরিস্থিতি বেড়ে গেছে। উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দূষণও বেড়ে যায়।’
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নানা ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দূষণের জন্য দায়ী ইট ভাটা নিয়ন্ত্রণসহ সচেতনতা বাড়ানোর কাজ চলছি। সম্প্রতি বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকও হয়েছে।’
বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা প্রসঙ্গে এই অতিরিক্ত সচিব বলেন, এটি এখন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে আছে। আগামী শুষ্ক মৌসুমের আগেই আইন আকারে পাস হবে বলে আমরা আশা করছি।
বায়ু মানের অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতি ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকলেও জরুরি স্বাস্থ্য অবস্থা জারির পরিকল্পনা নেই বলেও ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার মতোই অভিমত দিলেন অতিরিক্ত সচিব কেয়া খান। তিনি বলেন, ‘এখনই জরুরি অবস্থা ঘোষণার চিন্তা নেই। তাছাড়া এটি স্বাস্থ্য অধিদফতরের সিদ্ধান্ত।’ এ বিষয়ে কিছু ভাবছেন কি না— সেটি জানার জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালককে কয়েকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর
পরিবেশ আইনজীবী সমিতি পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন বাপা বায়ু দূষণ বায়ুমান মেগা প্রজেক্ট রিজওয়ানা হাসান শরীফ জামিল