চীনের দাবি— নিওকভ ‘বিপজ্জনক’ হতে পারে, ‘হু’ বলছে গবেষণা প্রয়োজন
২৯ জানুয়ারি ২০২২ ১৩:৩৬
ঢাকা: করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্টের সন্ধান পাওয়ার দাবি করেছেন চীনের বিজ্ঞানীরা। যাকে ‘নিওকভ’ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। এটি মানবদেহে কোনোভাবে সংক্রমিত হলে তা করোনার আগের ভ্যারিয়েন্টগুলোর তুলনায় সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার বাড়াবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন চীনের বিজ্ঞানীরা। খবর দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট।
তবে বিশ্বস্বাস্থ্য (ডব্লিউএইচও) শুক্রবার (২৮ জানুয়ারি) বলেছে— ভাইরাসটি নিয়ে এখনই আতঙ্কের কিছু নেই। করোনাভাইরাসের নতুন রূপটি আদৌ কতটা প্রাণঘাতী, তা নিয়ে আরও বিস্তর গবেষণার প্রয়োজন।
পাশাপাশি, ‘হু’-র তরফে রাশিয়ার সংবাদ সংস্থা ‘তাস’-কে বলা হয়েছে, ‘নতুন ভাইরাসের গতিবিধি সম্পর্কে আমরা সচেতন। তবে গবেষণায় শনাক্ত হওয়া ভাইরাসটি মানুষের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কি না তা নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন।’
সম্প্রতি চীনের উহানের তিন চিকিৎসা-বিজ্ঞানী দক্ষিণ আফ্রিকার বাদুড়ের দেহে করোনাভাইরাসের নতুন রূপ নিওকভের সন্ধান পান। তাদের দাবি— মানুষের শ্বাসযন্ত্রকে গুরুতরভাবে প্রভাবিত করতে পারে সদ্য আবিষ্কৃত এই ভাইরাস। এর মারণক্ষমতাও করোনাভাইরাসের ডেল্টা বা অন্য রূপের তুলনায় তুলনামূলক ভাবে বেশি। প্রতি তিন সংক্রমিতের একজনের মৃত্যু হতে পারে নিওকভে।
হু-এর দাবি— ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই মানুষের দেহে সংক্রমণ সৃষ্টিকারী ভাইরাসের উৎস বন্যপ্রাণী। কিন্তু বন্যপ্রাণীর দেহে উপস্থিত সব ভাইরাসই মানুষের পক্ষে বিপজ্জনক নয়।
চীনের বিজ্ঞানীরা বলছেন— এই ‘নিওকভ’ ভ্যারিয়েন্টটির বিস্তার প্রক্রিয়া যতটা জটিল তা মানবদেহে সংক্রমণের সম্ভাবনার বিষয়টি কম উদ্বেগজনক। তবে ভাইরাসটির বিষয়ে এখনই অধিক সচেতনা অবলম্বন করা উচিত বলে বিজ্ঞানীদের অভিমত।
বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা হিসেবে বলছেন, এই ভাইরাসটি আগে বাদুড়ের মধ্যে যা পরবর্তী সময়ে উটের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। বাদুড় থেকে ভাইরাস উটের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারলেও মানবদেহে এখন পর্যন্ত সংক্রমণের কোনো রেকর্ড নেই।
চলতি সপ্তাহের শুরুতে বায়োআরকাইভ (BioRxiv) জার্নালে এই গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেন চীনের গবেষকরা। তবে এটির অধিক পর্যলোচনা করা হয়নি বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
নিওকভ চলমান কোভিড-১৯ এর ভ্যারিয়েন্ট নয়। যা বিশ্বব্যাপী মহামারি সৃষ্টি করেছে। এটি ভিন্ন ধরনের করোনাভাইরাস। যা মধ্যপ্রাচ্যের শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগ (মার্স-কোভ) থেকে উৎপত্তি হয়েছে।
মার্স-কোভ’র উৎপত্তি সম্পর্কে সম্পূর্ণরূপে জানা সম্ভব হয়নি। তবে এটি আরব অঞ্চলের উট থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ঘটিয়েছে। এই ধরনের ভাইরাসকে জুনোটিক বলা হয়। যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রাণীদের সংস্পর্শে এলে মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ঘটাতে পারে।
বিশ্ব স্থাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে— মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং দক্ষিণ এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে মার্স-কোভ ভাইরাসটিকে শনাক্ত করা হয়েছে। ২০১২ সাল থেকে মোট ২৭টি দেশে এই ভাইরাস শনাক্ত করা হয়। ওই সময় মার্স-কোভ’এ সংক্রমণে ৮৫৮ জনের মৃত্যু হয়।
সংস্থাটি আরও জানায়, বিভিন্ন ভাইরাস জিনোমের বিশ্লেষণ পর ধারণা করা হয় যে, অনেক আগে বাদুড় থেকে এই ভাইরাসটির সংক্রমণ ছড়াতে পারে। যা পরবর্তীতে কোনো এক সময়ে উটের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছিল।
ডব্লিউএইচও জানায়, মার্স-কোভিড’এ সংক্রামিত রোগীদের মধ্যে ৩৫ শতাংশ মারা গেছে। তবে এটি অতি মূল্যায়ন করা হতে পারে, কারণ ওই পর্যবেক্ষণ পদ্ধতিতে ত্রুটি থাকতে পারে।
এই মার্স-কোভ ভাইরাসের সঙ্গে নিওকভ’র সম্পর্ক রয়েছে, যা বাদুড়ের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়ায়। এই সপ্তাহে প্রকাশিত গবেষণায় উহান-ভিত্তিক বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, যদি বাদুড় থেকে নিওকভ মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ঘটাতে পারে তাহলে তা সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।
তারা আরও বলেন, মানব অ্যান্টিবডি এই বিশেষ ধরনের করোনাভাইরাসকে (নিওকভ) প্রতিরোধ করতে পারবে বলে মনে হয় না, যা ইতোমধ্যে কোভিড-১৯’কে মোকাবিলা করছে। এই ভাইরাসটি মূলত কোভিড-১৯ বা মার্স-কোভ থেকেই সৃষ্টি।
গবেষণা মতে, নিওকভ ভ্যারিয়েন্ট মানব দেহে সংক্রমণ ঘটনোর হুমকি রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। যা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যাবে এটি কতটা সংক্রমক বা কতটা মারাত্মক।
পরীক্ষায় আরও দেখা যায়, নিওকভ ভ্যারিয়েন্ট মানব কোষে সংক্রমণ ঘটানোর ক্ষমতা খুবই দুর্বল।
ওয়ারউইক ইউনিভার্সিটির ভাইরোলজিস্ট বিভাগের অধ্যাপক লরেন্স ইয়ং দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট’কে বলেন, ‘উদ্বিগ্ন হওয়ার আগে এটি মানুষের শরীরে কতটা সংক্রমক এবং কতটা দুর্বল করতে পারে এসব তথ্য আরও খতিয়ে দেখতে হবে। প্রাথমিক তথ্যমতে নিওকভ মানব দেহে কোষে সংক্রমণ ঘটাতে অকার্যকর।’
তিনি আরও বলেন, ‘গবেষণাটি আরও দেখায় যে, প্রাণী থেকে (প্রধানত বাদুর) মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে সতর্ক থাকা প্রয়োজন।’
পাশাপাশি মানুষ ও প্রাণীদের মধ্যে সংক্রমিত রোগ নিয়ে আরও অধিক গবেষণার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বলেও উল্লেখ করেন অধ্যাপক লরেন্স ইয়ং।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে বাংলাদেশসহ বিশ্বের একাধিক দেশে ওমিক্রনের প্রাদুর্ভাব চলছে। করোনার এই ভ্যারিয়েন্টটির সংক্রমণ রোধে এরইমধ্যে দেশগুলো বিভিন্ন বিধিনিষেধ জারি করেছে। মহামারিকালে এর আগে করোনার ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সারাবিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। এ পরিস্থিতির মধ্যেই করোনার সদ্য আবিষ্কৃত ভ্যারিয়েন্ট নিওকভ সম্পর্কে সতকর্তা জারি করলেন চীনের বিজ্ঞানীরা।
সারাবাংলা/এনএস/একে