Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রথমবার টানা ৭ দিন সংক্রমণের হার ৩১ শতাংশের বেশি

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
২৯ জানুয়ারি ২০২২ ২০:২৬

ঢাকা: দুই বছর দুই ঢেউয়ের পর এবার দেশে চলছে করোনাভাইরাসের তৃতীয় ঢেউ। ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের প্রভাবেই ক্রমবর্ধমান প্রবণতা দেখা যাচ্ছে সংক্রমণে। তবে আগের দুইবারের তুলনায় এবারে অনেক দ্রুতই সংক্রমণ শনাক্তের হার রেকর্ডের দিকে ধাবিত হচ্ছে। কয়েকদিনের করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, গত ২৪ ঘণ্টাসহ সবশেষ সাত দিনেই নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল ৩১ শতাংশের বেশি। এমন ঘটনা দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর থেকে আর কখনো ঘটেনি।

বিজ্ঞাপন

এমন প্রবণতা আরও কত দিন অব্যাহত থাকতে পারে, সে বিষয়েও কিছু বলতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা। তবে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির নিয়ে সতর্ক থাকার পাশাপাশি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের মৌলিক বিষয় তথা মাস্ক পরা, স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের দিকে নজর দিতে বলছেন তারা। একইসঙ্গে আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতের তাগিদও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা দিচ্ছেন।

শনিবার (২৯ জানুয়ারি) স্বাস্থ্য অধিদফতরের কোভিড-১৯ সংক্রান্ত নিয়মিত বিজ্ঞপ্তিতে গত ২৪ ঘণ্টার করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ৩৩ হাজার ৩৭৩টি নমুনা পরীক্ষা করে ১০ হাজার ৩৭৮টি নমুনায় পাওয়া গেছে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি। নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণের হার ৩১ দশমিক ১০ শতাংশ।

আগের ছয় দিনও সংক্রমণের হার ৩১%-এর বেশি

আগের কয়েকদিনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, ২৮ জানুয়ারি দেশে ৪৬ হাজার ২৬৮টি নমুনা পরীক্ষা করে ১৫ হাজার ৪৪০ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এদিন সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল ৩৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ।

এর আগে ২৭ জানুয়ারি দেশে ৪৯ হাজার ৪২৫টি নমুনা পরীক্ষা করে ১৫ হাজার ৮০৭ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এদিন সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল ৩১ দশমিক ৯৮২ শতাংশ।

২৬ জানুয়ারি ৪৯ হাজার ৭৩টি নমুনা পরীক্ষা করে সংক্রমণ পাওয়া যায় ১৫ হাজার ৫২৭টিতে। এদিন সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল ৩১ দশমিক ৬৪ শতাংশ।

এর আগের দিন ২৫ জানুয়ারি ৪৯ হাজার ৪৯২টি নমুনা পরীক্ষায় ১৬ হাজার ৩৩ জনের শরীরে করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়। সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল ৩২ দশমিক ৪০ শতাংশ।

২৪ জানুয়ারি নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল ৩২ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এদিন ৪৫ হাজার ৮০৭টি নমুনা পরীক্ষা করে ১৪ হাজার ৮২৮টিতে সংক্রমণ শনাক্ত হয়।

বিজ্ঞাপন

অন্যদিকে, ২৩ জানুয়ারি দেশে ৩৪ হাজার ৮৫৪টি নমুনা পরীক্ষা করে ১০ হাজার ৯০৬টি নমুনায় করোনাভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত হয়। এদিন নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল ৩১ দশমিক ২৯ শতাংশ।

প্রথম ঢেউয়ে সংক্রমণের হারের চালচিত্র

২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথমবারের মতো করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এপ্রিলেই বাড়তে থাকে সংক্রমণ। মে মাসে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি নতুন মাত্রা পায়। ওই সময় শুরুর দিকে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণের হার ১০ শতাংশের কাছাকাছি উঠলেও ২৫ মে প্রথমবারের মতো ২০ শতাংশ অতিক্রম করে এই হার।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ওই ২৫ জুন থেকে শুরু করে ২০ আগস্ট পর্যন্ত টানা ৮৮ দিন সংক্রমণের উচ্চ গতি অব্যাহত ছিল। এই ৮৮ দিনের মধ্যে মাঝে মাঝে সংক্রমণের হার ২০ শতাংশের নিচে নেমে এলেও প্রায় পুরোটা সময়েই সংক্রমণের হার ছিল ২০ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে সর্বোচ্চ সংক্রমণ পৌঁছে ২০২০ সালের ১২ জুলাই। ওই দিন ৮ হাজার ৬৮টি নমুনা পরীক্ষায় সংক্রমণ শনাক্ত হয় ২ হাজার ৬৬৬ জনের শরীরে। নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ছিল ৩৩ দশমিক ০৪ শতাংশ।

দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমণের হারের চালচিত্র

২০২০ সালের পর ২০২১ সালে আবার করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি শুরু হয়। এ বছর বিভিন্ন ভ্যারিয়েন্টের প্রভাবে মে থেকেই বাড়তে থাকে সংক্রমণ। বলা যায়, জুনে গিয়ে শুরু হয় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। সেই ঢেউ চলে একেবারে আগস্ট মাস পর্যন্ত।

তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২১ সালের ২৩ জুন আবার নতুন করে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণের হার পেরিয়ে যায় ২০ শতাংশের সীমা। এবারে সংক্রমণের এই হার অব্যাহত থাকে পরবর্তী ৬৬ দিন, একেবারে ১৬ আগস্ট পর্যন্ত। এর মধ্যে মাঝে মাঝে দুয়েকদিন সংক্রমণের হার ২০ শতাংশের নিচে নামলেও সংক্রমণের হার ২০ শতাংশের বেশিই ছিল এই ৬৬ দিন।

এর মধ্যে সংক্রমণের হার সর্বোচ্চে পৌঁছায় ২০২১ সালের ২৪ জুলাই। এদিন ২০ হাজার ৮২৭টি নমুনা পরীক্ষা করে ৬ হাজার ৭৮০ জনের শরীরে করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়। নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণের হার ছিল ৩২ দশমিক ৫৫ শতাংশ।

টানা ৭ দিন সংক্রমণের হার ৩১ শতাংশের বেশি

করোনার তিনটি ঢেউয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিন বারই সর্বোচ্চ সংক্রমণের সময় নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণ শনাক্তের হার ৩০ শতাংশ অতিক্রম করেছে। ৩১ এবং ৩২ শতাংশ অতিক্রমের নজিরও রয়েছে। তবে কোনোবারই সংক্রমণের হার টানা পাঁচ দিন ৩১ শতাংশের বেশি ছিল না।

এর মধ্যে করোনার প্রথম ঢেউয়ে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণের ৩০ শতাংশ অতিক্রম করেছে মাত্র দুই দিন। ২০২০ সালের ১২ জুলাই এই হার ছিল ৩৩ দশমিক ০৪ শতাংশ। আর ওই বছরেরই ৩ আগস্ট সংক্রমণের হার ছিল ৩১ দশমিক ৯১ শতাংশ।

করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি তুলনামূলকভাবে কম দিন ছিল। তবে সংক্রমণের হার প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় ছিল অনেক বেশি। এবারে ১৪ দিন সংক্রমণের হার পাওয়া গেছে ৩০ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে আট দিন সংক্রমণের হার ছিল ৩১ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে ২০২১ সালের ৬ থেকে ১০ জুলাই— এই পাঁচ দিনের প্রতিদিনই সংক্রমণের হার ছিল ৩০ শতাংশের বেশি। ৬, ৭ ও ৮ জুলাই সংক্রমণের হার ছিল ৩১ শতাংশের বেশি।

এর ক’দিন পরেই ২১ থেকে ২৫ জুলাই— এই পাঁচ দিনও সংক্রমণের হার টানা ৩০ শতাংশের বেশি ছিল। এর মধ্যেও আবার ২২, ২৩ ও ২৪ জুলাই সংক্রমণের হার ছিল ৩১ শতাংশের বেশি। তবে টানা পাঁচ দিন ৩১ শতাংশের বেশি সংক্রমণের হার এবারে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ে এসেই প্রথম দেখা গেল।

১৭ জানুয়ারি থেকে সংক্রমণ চরম ঊর্ধ্বমুখী

গেল ডিসেম্বরে করোনার দৈনিক সংক্রমণ নেমে এসেছিল দুইশ’র ঘরে। নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণের হারও নেমে এসেছিল ১ শতাংশের ঘরে। তবে নতুন বছরের শুরু থেকেই সংক্রমণের গতি ঊর্ধ্বমুখী। গত ৬ জানুয়ারি আবারও এক দিনে সংক্রমণ ছাড়ায় ১ হাজারের ঘর। ৭ জানুয়ারি নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণের হার ছাড়ায় ৫ শতাংশ। এরপর দ্রুতই সংক্রমণ আর শনাক্তের হার বাড়তে থাকে।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১২ জানুয়ারি নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণের হার ছিল ১১ দশমিক ৬৮ শতাংশ। গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বরের পর এই প্রথম সংক্রমণের হার ১০ শতাংশ ছাড়ায়। এরপর গত ১৭ জানুয়ারি সংক্রমণের এই হার পেরিয়ে যায় ২০ শতাংশ। এরপর টানা ১১ দিন ধরেই সংক্রমণের হার ২০ শতাংশের ওপরে রয়েছে।

স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ ও চিকিৎসা নিশ্চিত করতেই হবে

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের কারণেই মূলত সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা। বিশ্বব্যাপী ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট যেভাবে সংক্রমণ বাড়িয়েছে, একই ধরনের প্রবণতা বাংলাদেশেও দেখা যাচ্ছে। কারণ স্বাস্থ্য অধিদফতরের ঘোষণাই বলছে, দেশে এই ভ্যারিয়েন্টের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন এরই মধ্যে ঘটে গেছে। এ বছর করোনাভাইরাসের যেসব নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে, তার সিংহভাগেও মিলেছে এই ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি।

ওমিক্রনের প্রভাবে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি কত দিন থাকবে, সে বিষয়ে অবশ্য এখনই কিছু বলতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরা। তবে প্রভাব যাই থাকুক, স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের পাশাপাশি আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার দিকে সরকারকে মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন তারা। বলছেন, সংকটের এই সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত না নিতে পারলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের একেবারেই বাইরে চলে যাবে, যার জন্য ভুগতে হবে দীর্ঘ সময়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে কি না কিংবা কবে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাবে— এসব বিষয়ে বলার মতো যথেষ্ট তথ্য এখনো কারও কাছেই নেই। আমাদের দেশেও এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতি আরও কমপক্ষে দুই থেকে তিন সপ্তাহ চলতে পারে। সবাই গুরুত্ব দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করলে এরপর হয়তো সপ্তাহখানেক স্থিতাবস্থা থাকবে। তারপর সংক্রমণ নিম্নমুখী হতে পারে।’

তবে স্বাস্থ্যবিধি বা বিধিনিষেধ নিয়ে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে অসন্তুষ্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল। তিনি বলেন, ‘সরকার বিধিনিষেধ দিয়েছে। কিন্তু সেগুলো কার্যকর করতে প্রশাসন কী করছে? সরকার নির্দেশনা দিলেও প্রশাসনের তেমন তৎপরতা দেখছি না। স্বাস্থ্যবিধি মানানোর দায়িত্ব সরকারের একার নয়, এর সঙ্গে জনগণকে সম্পৃক্ত করা জরুরি। সেটিই হচ্ছে না। সেটি করার পাশাপাশি হাসপাতালে রোগীদের অক্সিজেনপ্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে দৈনিক নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা এক লাখ হলে ভালো হতো। বাড়তি জনবল নিয়োগ দিয়ে হলেও এই কার্যক্রম গতিশীল করতে হবে।’

ওমিক্রনের প্রভাবে সারাবিশ্বেই করোনা সংক্রমণের সব রেকর্ড ভেঙে গেছে জানিয়ে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, বাংলাদেশেও দুয়েকদিনের মধ্যে হয়তো সংক্রমণের আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। ৫০ হাজার নমুনা পরীক্ষায় সেখানে ১৫ হাজারের বেশি শনাক্ত হচ্ছে, ১ লাখ নমুনা পরীক্ষা হলে তো এই সংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়ে যাবে।

তবে সংক্রমণের সংখ্যায় মনোযোগ না দিয়ে সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এবং আক্রান্তদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার দিকে মনোযোগী হতে আহ্বান জানালেন ডা. মুশতাক। তিনি বলেন, ‘যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। চিকিৎসা সুবিধা বাড়াতে হবে। পরীক্ষা করার সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। করোনা আক্রান্তদের ফলোআপের আওতায় আনতে হবে। সুনির্দিষ্টভাবে আইসোলেশন সেন্টার করতে হবে। এসব না করতে পারলে সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি কোথায় গিয়ে থামবে, বলা মুশকিল।’

সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম

৩১ শতাশের বেশি ওমিক্রন শনাক্ত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর