নদীকে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ ঘোষণার দাবি
২৯ জানুয়ারি ২০২২ ২০:২৫
ঢাকা: মুক্তিযুদ্ধে নদীর ভূমিকা অত্যন্ত শক্তিশালী। নদী যেমন স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তিকে ধারণ করেছে, তেমনি পাকবাহিনীর পথে বাধা সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এটি নিয়ে স্বাধীনতার ৫০ বছরেও কোনো স্বীকৃতি মেলেনি। এমনকি নদীকে সুপ্রিমকোর্ট জীবিত সত্তা হিসেবে ঘোষণা করলেও নানাভাবে একে ধ্বংস করছি আমরা। তাই নদী বাঁচাতে নদীকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণার আহ্বান জানিয়েছে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি)।
শনিবার (২৯ জানুয়ারি) মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী শতদিনের উৎসব উপলক্ষে ‘মুক্তিযুদ্ধে নদী ও নদীর গান’ শীর্ষক এক প্রদর্শনী, আলোচনা ও সংগীতানুষ্ঠান আয়োজন করে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার, রিভার বাংলা এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।
অনুষ্ঠানে বক্তারা নদীমাতৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নদীপথের গুরুত্ব তুলে ধরে এর স্বীকৃতি দাবি করেন। তারা বলেন, তখন নদী অনেক খরস্রোতা ছিল। পাকবাহিনী শুরুতে বিস্তৃত নৌপথের সুফল পেলেও পরে নদীর সাহায্য নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন করে বাংলাদেশি বাহিনী। তারা যেমন পাকিস্তানি রসদবাহী জাহাজ ডুবিয়ে তাদের বিপদে ফেলে তেমনি ব্রিজ ও কালভার্ট উড়িয়ে তাদের যাতায়াতে সমস্যা সৃষ্টি করে। এদিকে নদীর স্রোতের সাহায্য নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা চলাচল ও যুদ্ধ করলেও পানি ভয় পাওয়া পাকিস্তানীরা দুর্বল হয়ে পড়ে। পাশাপাশি স্থল ও ডিসেম্বরের শুরুর দিকে আকাশ পথে হামলার মাধ্যমে চুড়ান্ত বিজর অর্জিত হয়।
উপস্থিত ছিলেন দুজন বীর মুক্তিযোদ্ধা যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় সেক্টর-১০ এ যুদ্ধ করেছেন। প্রধান অতিথি হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান কবির বীরপ্রতীক আর অতিথি হিসেবে মুক্তিযোদ্ধা ইঞ্জিনিয়ার মোঃ মাহবুবুর রহমান। তারা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণা করেন ও মুক্তিযুদ্ধে নৌযুদ্ধের গুরুত্ব তুলে ধরেন। তারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় স্থল বাহিনীর চেয়েও নৌ বাহিনীর গুরুত্ব কোন অংশে কম নয়। বরং অনেকটা বেশিই বলা যায়। কারণ, শুধু স্থলযুদ্ধে পাকবাহিনীকে দুর্বল করা যাচ্ছিল না। এমনকি যুদ্ধের কথা বহির্বিশ্বে পৌছাচ্ছিল না। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসকে কেন্দ্র করে নৌ পথে অপারেশন জ্যাকপটের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে স্ট্র্যাটেজিগত কারণে একদিন পিছিয়ে ১৫ আগস্ট প্রথম হামলা হয়। একযোগে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্র বন্দর ও চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ ও দায়দকান্দি নৌ বন্দরে হামলার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ঝড়বৃষ্টির কারণে দাউদকান্দিতে ১৬ আগস্ট হামলা হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে নির্দিষ্ট গান বাজানোর মাধ্যমে এই হামলার সিগন্যাল দেওয়া হয়। নৌ কমান্ডোরা ছিলেন সুইসাইড স্কোয়াড। তারা নদীর স্রোতের সাহায্যে পিঠ নিচে দিয়ে শুধুমাত্র নাক ও চোখ ভাসিয়ে সাঁতারের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন যাতে পাকবাহিনী তাদের দূর থেকে দেখতে না পায়। এভাবে সাঁতার কেটে যেয়ে জাহাজের গায়ে তিনটা মাইন লাগিয়ে আসতে হবে। এর কম হলে জাহাজ ডুববে না। এভাবে ঝুকিপূর্ণ অপারেশন করে তারা দুদিনের অপারেশনে ১২৬ টি রসদবাহী জাহাজ ডোবাতে সক্ষম হন। এরপর শুধুমাত্র বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের সংবাদই পৌঁছে না, পাকবাহিনী দুর্বল হতে শুরু করে।
অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য উপস্থাপনকালে আরডিআরসি’র চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ এই মুক্তিযুদ্ধের সময় নদীর ব্যবহার ও ভূমিকা নিয়ে একটি প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন। এসময় তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে নদীর এমন অনন্য ভূমিকা থাকা স্বত্বেও এত বছরে তার স্বীকৃতি মেলেনি। নদী ছাড়া বাংলাদেশের বিজয় অর্জন হত না বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, ভারতীয়দের সাহস হয়নি বাংলাদেশে এসে নৌযুদ্ধ করার। এটি শুধুমাত্র বীর বাঙালিই করতে পেরেছে। ১৫ ও ১৬ আগস্টা অপারেশন জ্যাকপটের মাধ্যমে পাকিস্তানি বাহিনী অনেকটাই দুর্বল হয়ে যায়। এই দুদিন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পাঁচটি সমুদ্র ও নৌ বন্দরে শতাধিক অস্ত্র রসদবাহী বিদেশি জাহাজ ধ্বংস করা হয়। এভাবে বহির্বিশ্বে পাকিস্তানে যুদ্ধের খবর পৌঁছায়। এর আগে পাকিস্তানিরা প্রচার করছিল এখানে সবকিছু স্বাভাবিক আছে। কোন যুদ্ধ নাই।
১৯৭১ সালে সংগঠিত স্বাধীনতা যুদ্ধে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশকে ভূখণ্ডকে ১১ টি যুদ্ধক্ষেত্রে বা সেক্টরে ভাগ করা হয়। এর মধ্যে ১০ নম্বর সেক্টর ছিল নৌ সেক্টর যা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এমএজি ওসমান গনির তত্ত্বাবধানে ছিল।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের শিক্ষা ও প্রকাশনা ম্যানেজার সত্যজিৎ রায় মজুমদারের সঞ্চালনায় এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রিভার বাংলার সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ।
সারাবাংলা/আরএফ
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি) রিভার বাংলা