পাহাড় কেটে ‘মরুভূমি’, নির্বিকার প্রশাসন!
৩০ জানুয়ারি ২০২২ ০৮:৪০
রাঙ্গামাটি: পিচঢালা সড়কের পাশেই উঁচু সুবিশাল পাহাড়। আগে যেখানে ছিল বিভিন্ন প্রজাতির গাছে পরিপূর্ণ সবুজের সমারহ। কিন্তু এখন পুরো পাহাড়ের অর্ধেকেরও বেশি খাড়াভাবে কেটে সমান করার ফলে তৈরি হয়েছে ‘মরুভূমি’। এভাবেই হরেক রকমের কায়দায় চলছে পাহাড় ধ্বংস। বিগত দুইমাস প্রতিনিয়ত পরিবেশের ওপর এই ভয়াবহ আগ্রাসন চললেও নেই কারও মাথাব্যাথা। পরিবেশ সুরক্ষায় পাহাড় কাটায় নিষেধাজ্ঞা থাকলেও পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটিতে এভাবে আইনের তোয়াক্কা না করে নির্বিচারে পাহাড় কাটা চলছে। রাঙ্গামাটি পৌর এলাকার ৬ নম্বর ওয়ার্ড সাধনাপুর এলাকায় গত দুইমাস ধরে প্রায় ২০ একর পাহাড় এভাবেই কেটে সাবাড় করা হচ্ছে। খাড়াভাবে পাহাড় কাটায় ব্যবহার করা হচ্ছে এক্সকেভেটর।
রাঙ্গামাটি জেলা শহরের আসামবস্তি-ভেদভেদী সড়কের লুম্বিনী বিহার এলাকায় সাধনাপুরে বিশালাকৃতির বেশ কয়েকটি পাহাড় কেটে ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। সরেজমিনে দেখা গেছে, পিচঢালা রাস্তার পাশের বড় একটি উঁচু পাহাড় ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেল বা খাড়াভাবে অর্ধেকের বেশি অংশ কাটা শেষ হয়েছে। পুরো পাহাড়ের গায়ে রয়েছে এক্সকেভেটর দিয়ে কাটার চিহ্ন। রাস্তার পাশের এই পাহাড়টির পেছনের দিকের আরও বেশ কয়েকটি পাহাড়ও কাটা চলছে। পাহাড় কাটার পর পরিত্যক্ত মাটি সরানো হচ্ছে ভারী ট্রাকের মাধ্যমে। তাই ট্রাক চলাচলের জন্য তৈরি করা হয়েছে রাস্তা। এই রাস্তা দিয়েই পাহাড়ের মাটি ট্রাকে করে অন্যত্র সরিয়ে ফেলা হচ্ছে।
ট্রাক চলাচলকারী এই পথ ধরে সামনে এগুতেই চোখের সামনে পড়ল ভয়াবহ দৃশ্য! প্রথম দিকের উঁচু পাহাড় পিছনের বিশালাকৃতির বেশকয়েকটি পাহাড় কেটে সমান করা হয়েছে। যেখানে একটি এক্সকেভেটরও রয়েছে। তবে ঘটনাস্থলে কাউকে পাওয়া যায়নি। পুরো ধবংসযজ্ঞ স্থানের আয়তন প্রায় ২০ একর হতে পারে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। যার মালিক স্থানীয় প্রভাবশালী মোহন চান দেওয়ান। তবে পাহাড় কাটার সঙ্গে আরও বেশকয়েকজন জড়িত থাকার কথা জানা গেলেও তাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সমতল করা জায়গায় একসঙ্গে বেশকিছু খুঁটিও দেখা গেছে। কয়েকটি স্থানে একই খুঁটি স্থাপন করা হয়েছে। আবার পিচঢালা সড়কটির বিপরীত দিকে আরেকটি পাহাড় কেটে সমতল করা হচ্ছে। এতে করে পাহাড়টির উপর দিয়ে তৈরি সড়কটিও ঝুঁকিতে পড়েছে। এই পাহাড়ের মালিক হিসেবে রনেল দেওয়ানের নাম জানা গেছে।
এদিকে, পাহাড় কাটার পর পরিত্যক্ত মাটিগুলো ট্রাকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। প্রতিনিয়ত মাটিভর্তি ট্রাক যাতায়াতের কারণে এলাকার সরু সড়কটিও উঁচু-নিচু খানাখন্দ সৃষ্টি হয়েছে। ধুলোয় ধূসর হয়ে পড়েছে সড়কটি। যে কারণে স্থানীয়রাও পড়ছেন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। সরেজমিনে গিয়ে পাহাড় কাটার বিষয়ে স্থানীয় কয়েকজনের কাছে জানতে চাওয়া হলেও তারা এ ব্যাপারে কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করেছেন। স্থানীয় এক ব্যক্তি সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে জানালেন, যারা পাহাড় কাটছেন তারা সবাই এলাকার প্রভাবশালী মানুষ। সবকিছু ম্যানেজ করেই তারা পাহাড় কাটছেন। স্থানীয়রা এভাবে পাহাড় কাটার পক্ষে না থাকলেও প্রতিবাদ করার মতো অবস্থা কারও নেই।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক সাধনাপুর এলাকার এক বাসিন্দা সারাবাংলাকে জানান, গত দুই মাস ধরে পাহাড়গুলো এক্সকেভেটর দিয়ে খাড়াভাবে কাটা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত বড় বড় বেশকয়েকটি পাহাড় কেটে সমান করা হয়েছে। আরও কয়েকটি কাটার কাজ চলছে। বড় পাহাড়গুলোর ভূমির মালিক মোহন চান দেওয়ান। তবে পাহাড় কাটার সঙ্গে আরও বেশ কয়েকজন থাকতে পারেন। শুনেছি পাহাড়গুলো ব্যবহার হচ্ছে না বিধায় সমতল করা হচ্ছে। সেখানে আবাসন প্লট তৈরি করা হবে।’
আরেক বাসিন্দা জানান, পাহাড় কাটার কারণে প্রতিনিয়ত এক্সকেভেটরের বিকট শব্দ দূর থেকে শোনা যায়। আবার ট্রাক যাতায়াতের কারণে সরু সড়কটি ধুলোবালিতে পূর্ণ ও উঁচু-নিচু হয়ে যাচ্ছে। প্রতি ট্রাক মাটি বিক্রয় হচ্ছে ৬০০ টাকা দরে।
পাহাড় কাটায় অভিযুক্ত মোহন চান দেওয়ান সারাবাংলাকে বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সবখানেই উঁচু-নিচু পাহাড়। সামান্য বৃষ্টি হলেই পাহাড় কাটতে হয়। নিজেদের জায়গা, সেজন্য অনুমতির বিষয়টি দেখা হয়নি। আর প্রশাসন থেকেও আমাদের কোনো বাধা দেওয়া হয়নি। পতিত পাহাড়টি মূলত কেটে সমান করা হচ্ছে। এখানে বিভিন্ন ফলের চারা রোপন ও খামার করার কথা ভাবছি। তাই পাহাড়ের উপরের অংশ কেটে একটু সমান করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘পাহাড়ের মাটির কিছু অংশ জায়গা সমান করার কাজে আর কিছু মাটি বিক্রি করা হচ্ছে। আমরা মাটির দামও বেশি নিচ্ছি না। মাটিগুলো ভেদভেদী টিভি সেন্টারের ওদিকে নেওয়া হচ্ছে। তবে গত কয়েকদিন ধরে নেওয়া বন্ধ রয়েছে।’
মোহন চাঁনের দাবি কেবল তিনিই নন, সেখানে আরও কয়েকজনের জায়গা রয়েছে। তারা মোহন চাঁন দেওয়ানের আত্মীয়। তবে তিনি আত্মীয়দের পরিচয় দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে আরেকটি পাহাড়ের মালিক রনেল দেওয়ানের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
সংশ্লিষ্ট তথ্য মতে, পাহাড় একটি দেশের প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পাহাড় বনজ সম্পদ, জীবপ্রজাতি এবং খনিজ ও কৃষিজ পণ্যের উৎস। পার্বত্য চট্টগ্রামের বেশির ভাগ পাহাড়ের অনেক গভীর পর্যন্ত বালির আধিক্য রয়েছে। ফলে পাহাড় কাটলে ভূমিধসের বড় ঝুঁকি তৈরি হয়।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলাতে সরকারি-বেসরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন পাহাড় কাটা নিত্য ঘটনায় রূপ নিয়েছে। অবাধে পাহাড় কাটার কারণে ঝুঁকিতে পড়ছে পরিবেশ। বিশেষ প্রয়োজনে পাহাড় কাটার ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদফতরের অনুমতির বিধান থাকলেও কেউ অনুমতির তোয়াক্কা করছেন না। রাজনৈতিক ও বিভিন্ন চাপের কারণে দেখা যায় স্থানীয় প্রশাসনও পাহাড় কাটারোধে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করছে না। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তদারকি না বাড়াতে পারলে ভূ-প্রকৃতি আরো ঝুঁকিতে পড়বে। এছাড়া পাহাড় কাটা বন্ধে স্থানীয়রা সচেতন না হলে কেবল সরকারের নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষে এটা রোধ করা কঠিন।
রাঙ্গামাটির পরিবেশবাদী সংগঠন গ্লোবাল ভিলেজের নির্বাহী পরিচালক ফজলে এলাহী সারাবাংলাকে জানান, পাহাড় কাটার কারণে ভূমিধসের ঝুঁকি থাকে। পাহাড় কাটার বিরূপ প্রভাব কী হতে পারে সেটি রাঙ্গামাটিসহ সারাদেশের মানুষ ২০১৭ সালে দেখেছেন। পাহাড় কেটে অপরিকল্পিতভাবে বসতি গড়ে তোলার কারণে ২০১৭ সালে রাঙ্গামাটিতে শতাধিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। তবুও পার্বত্য এলাকায় পাহাড় কাটা থেমে নেই। কখনো সরকারি, কখনো ব্যক্তি মালিকানাধীন কাজে পাহাড় ধ্বংস চলছে। পরিবেশকে বাঁচাতে স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদফতরে ভূমিকা রাখতে হবে। পাশাপাশি স্থানীয় অধিবাসীদের আরও সচেতনতার প্রয়োজন।’
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ এর ৬(খ) অনুযায়ী পরিবেশ সুরক্ষায় পাহাড় কাটায় স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এই আইনে, কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধা-সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন বা দখলাধীন বা ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় ও টিলা কাটা যাবে না বলে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে অধিদফতরের ছাড়পত্র গ্রহণ করে কোনো পাহাড় বা টিলা কর্তন বা মোচন করা যেতে পারে। পরিবেশ আইনের ধারা ১৫ এর দণ্ডবিধানে বলা আছে, পাহাড় বা টিলা কাটার প্রমাণ পাওয়া গেলে অনধিক এক বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার দণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।
পাহাড় কাটার অনুমতি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাঙ্গামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাঙ্গামাটিতে পাহাড় কাটার কোনো অনুমতি নেই। আমি সদর ইউএনওকে বলে দিচ্ছি। তিনি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করবেন।’
তবে রাঙ্গামাটি সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) নাজমা বিনতে আমিন বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। পাহাড়টি কীভাবে এবং কেন কাটা হচ্ছে আমরা খতিয়ে দেখছি।’
সারাবাংলা/পিটিএম