Wednesday 11 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চলন্ত গাড়ি থেকে স্ক্র্যাপ ছিনতাইয়ে ‘হাজার শিশু-কিশোর’

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ২০:৪৩

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রাম বন্দর থেকে হালিশহর-পাহাড়তলী হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ড পর্যন্ত এলাকায় গত এক বছরে চলন্ত পরিবহন থেকে লোহার রড তৈরির কাঁচামাল (স্ক্র্যাপ) চুরি-ছিনতাই মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। কারখানামুখী চলন্ত গাড়িতে উঠে পথে পথে স্ক্র্যাপ ফেলে দেয় অপরাধীরা। পরে রাস্তা থেকে সেগুলো কুড়িয়ে আবার বিক্রি করা হয়। নির্বিঘ্নে এ কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করতে তারা পকেটে রাখে ধারালো অস্ত্র। প্রতিরোধ করতে গেলে ঘটছে খুন-খারাবির ঘটনা।

নগর গোয়েন্দা পুলিশ অনুসন্ধানে নেমে তথ্য পেয়েছে— চট্টগ্রাম নগরী থেকে সীতাকুণ্ড পর্যন্ত আটটি স্পটে স্ক্র্যাপ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। রাজনৈতিক পদ-পদবিধারী কয়েকজনের ছত্রছায়ায় এ ছিনতাইয়ের চক্রে আছে হাজারখানেক সদস্য যাদের অনেকেই শিশু-কিশোর। এদের প্রায় সকলেই মাদকসেবী ও ভাসমান।

চট্টগ্রামের সাতটি লোহার রড তৈরির কারখানায় স্ক্র্যাপ ব্যবহার হয়। কারখানাগুলো হচ্ছে— বিএসআরএম, কেএসআরএম, আরএসআরএম, জিপিএইচ, আবুল খায়ের স্টিল, সীমা রি-রোলিং এবং মোস্তফা হাকিম। আমদানি করা স্ক্র্যাপ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খালাসের পর খোলা ট্রাক, ড্রাম ট্রাক অথবা অল্প সংখ্যক কাভার্ড ভ্যানের মাধ্যমে কারখানায় নিয়ে যাওয়া হয়। কারখানাগুলোর অধিকাংশের অবস্থান সীতাকুণ্ড এলাকায়।

গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর নগরীর আকবর শাহ থানার লতিফপুর এলাকায় আবুল খায়ের গ্রুপের ট্রাক থেকে স্ক্র্যাপ ছিনতাইয়ের সময় বাধা দেওয়ায় একজন নিরাপত্তা কর্মীকে খুন করা হয়। মূলত ওই ঘটনার পর স্ক্র্যাপ ছিনতাইকারীদের বিভিন্ন তথ্য পুলিশের কাছে আসতে শুরু করে। সেসময় আকবর শাহ থানা পুলিশ ঘটনায় জড়িত ১০ জনকে গ্রেফতার করেছিল।

এদিকে ‘ক্রমশ ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা’ স্ক্র্যাপ ছিনতাইকারীদের নিয়ে অনুসন্ধানে নামে নগর গোয়েন্দা পুলিশও। টানা চার মাস অনুসন্ধান চালিয়ে ছিনতাইয়ের সাতটি স্পট চিহ্নিত করার পাশাপাশি এ অপরাধে নেতৃত্ব দেওয়া বেশ কয়েকজনের তথ্যও সংগ্রহ করেছে সংশ্লিষ্টরা।

নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (ডিবি-বন্দর) অতিরিক্ত উপ-কমিশনার নোবেল চাকমা সারাবাংলাকে জানান, নগরীর মাঝিরঘাট, বারিক বিল্ডিং মোড়, ঈদগাহ বাসস্ট্যান্ড, বার কোয়ার্টার পিবিআই অফিসের সামনে, অলঙ্কার মোড়, সীতাকুণ্ডের সেবা ফিলিং স্টেশনের সামনে, পাকা রাস্তার মাথা ও কালু শাহ ব্রিজ- এই আটটি স্পটে স্ক্যাপ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।

‘অনেকক্ষেত্রে স্ক্র্যাপ বহনকারী পরিবহনের চালকের সঙ্গে ছিনতাইকারী চক্রের যোগসাজশ থাকে। নির্ধারিত স্পটগুলোতে গিয়ে চালক গাড়ির গতি কমিয়ে দেন। এতে সুযোগ পেয়ে লাফ দিয়ে উঠে যায় ছিনতাইকারীরা। ১০-১২ জন একসঙ্গে উঠে যায়। সমপরিমাণ কিংবা তার চেয়ে বেশি সদস্য রাস্তায় থাকে। যারা গাড়িতে উঠে তারা স্ক্র্যাপগুলো নাড়াচাড়া করে গাড়ি থেকে রাস্তায় ফেলে দেয়। অন্যরা সেগুলো কুড়িয়ে নেয়। মোটামুটি এটাই তাদের স্ক্র্যাপ ছিনতাইয়ের পদ্ধতি।’

একবছর ধরে ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে ওঠা এই চক্রের সদস্যরা এখনও আরও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠার তথ্য দিয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তা নোবেলের তথ্য—প্রত্যেক ছিনতাইকারী পকেটে একটি করে ছোরা রাখে। ছিনতাইয়ের সময় বাধা দিতে এলে তারা ছুরিকাঘাত করে। আবুল খায়ের গ্রুপের নিয়োগ করা নিরাপত্তা কর্মীকে খুনের পর সোমবার (৩১ জানুয়ারি) জিপিএইচ ইস্পাতের দুই নিরাপত্তা কর্মীকেও ছুরিকাঘাত করা হয়েছে।

সোমবার (৩১ জানুয়ারি) সকাল সাড়ে ১১টার দিকে নগরীর সদরঘাট থেকে স্ক্র্যাপবোঝাই ট্রাককে নিরাপত্তা দিয়ে সীতাকুণ্ডে নেওয়ার পথে ৮-১০ জন গাড়িতে উঠে স্ক্র্যাপ ছিনতাই শুরু করে। ট্রাকের সামনে পিকআপে তিনজন নিরাপত্তাকর্মী ছিলেন। তারা বাধা দিলে আবু সুফিয়ার ও মোহিনী কুমার চাকমাকে ছুরিকাঘাত করা হয়। এ ঘটনায় সদরঘাট থানা পুলিশ ও ডিবি যৌথভাবে অভিযান চালিয়ে মোট ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে। এরা হলো— তোরাব ফকির (২৮), নুর নবী সাকিব (২২), মো. রাতুল (১৯), মো. পারভেজ (২২), মো. ইমন (১৯) এবং মো. শাকিল (১৯)।

নগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার (ডিবি-পশ্চিম) এ কে এম মহিউদ্দিন সেলিম সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, গত চার মাস ধরে টানা অনুসন্ধানের পর চট্টগ্রাম নগরীতে এই ছিনতাইকারী চক্রের ছয়টি আস্তানা এবং বেশ কয়েকজনের নাম ও তাদের ‘গডফাদারের’ তথ্য উদঘাটন করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দরকেন্দ্রিক এই ছিনতাইকারী চক্রের নেতৃত্ব দেয় মিরাজ, ম্যাগনেট, বাবুল ও জসীম। তাদের নিয়ন্ত্রণ করেন কথিত যুবলীগ নেতা আলাউদ্দিন আলো।

নগরীর মাঝির ঘাটকেন্দ্রিক চক্রে আছে মনির, নয়ন, আশরাফ, নোমান, সাগর, আশিকের নেতৃত্বে শতাধিক সদস্য। মনির এবং সদরঘাট থানায় গ্রেফতার হওয়া তোরাব ফকির তাদের নেতৃত্ব দেয়।

চট্টগ্রাম বন্দর সংলগ্ন টোলরোডের আব্বাসপাড়া এলাকায় সক্রিয় এই চক্রের সদস্যদের নেতৃত্বে আছে তৈয়ব, সাদ্দাম হোসেন মিন্টু, সুজন, তানভীর, জাকির, ফরহাদ, মানিক, তুষার, রুবেল, ফয়সাল ও ইমতিয়াজ। এদের মধ্যে মূল নেতা হল তৈয়ব ও সাদ্দাম।

উত্তর কাট্টলী-কর্ণেলহাট এলাকায় আজাদ, মুন্না, জসীম, সুমন, লিটন, রাশেদ, আব্বাস, ডালিম, রকি ও খালেদের সঙ্গে শতাধিক সদস্য আছে।

নগরীর হালিশহরে সাহেব-বাবুর বৈঠকখানা এলাকায় মামুনের নেতৃত্বে ১০-১৫ জন সদস্য অবস্থান করে। চট্টগ্রাম বন্দরের টোল রোড সংলগ্ন এছাক কনটেইনার ডিপো এলাকায় রুবেল, হাছান, সাকিব, জুয়েল, সাগরের নেতৃত্বে শতাধিক সদস্য আছে।

নগরীর সদরঘাট থেকে বন্দর পর্যন্ত এলাকায় ১৬ জনের আরও একটি সক্রিয় চক্র আছে। এদের মধ্যে ছয়জনকে সর্বশেষ সদরঘাট থানায় গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকি সদস্যরা হল- নয়ন, ইলিয়াছ, বেলা, সজীব, নূর, গেদ্যা, রাসেল, সাকিব, সাগর, ইমন, সোহাগ, আনোয়ার, রাতুল।

নগরীর হালিশহর থেকে আকবর শাহ থানার একে খান হয়ে সীতাকুণ্ডের লতিফপুর এবং বার আউলিয়া পর্যন্ত এলাকায় সক্রিয় অন্তত ৬০ জনের একটি তালিকা তৈরি করেছে পুলিশ।

আকবর শাহ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জহির হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার এলাকায় স্ক্র্যাপ ছিনতাইকারী চক্রের হাতে প্রথম খুনের ঘটনা ঘটে। এরপর আমরা অভিযান চালিয়ে প্রথমে ১০ জন এবং পরে আরও ১৫ জনকে গ্রেফতার করি। সক্রিয় প্রায় ৬০ জনের একটি তালিকা আমরা তৈরি করেছি। এরা হালিশহর থেকে মহাসড়ক পর্যন্ত ছিনতাই করে। একবছর আগেও এদের দৌরাত্ম্য এত বেশি ছিল না। তখন শুধুমাত্র ভাসমান শিশু-কিশোররা স্ক্র্যাপ চুরিতে জড়িত ছিল। কিন্তু লোহার রডের দাম বেড়ে যাওয়ার পর গত এক বছরে গ্যাং লিডারদের নেতৃত্বে কয়েকটি চক্র তৈরি হয়েছে। স্ক্র্যাপ ছিনতাইয়ে তারা এখন অনেক বেপরোয়া।’

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সীতাকুণ্ডের পাকা রাস্তার মাথা, কালু শাহ ব্রিজ এলাকায় সবচেয়ে বেশি ছিনতাইকারী অবস্থান করেন বলে জানান গোয়েন্দা কর্মকর্তা মহিউদ্দিন সেলিম। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম শহর থেকে সীতাকুণ্ড পর্যন্ত এলাকায় হাজারখানেক স্ক্র্যাপ ছিনতাইকারী আছে। তাদের অধিকাংশই ভাসমান ও মাদকসেবী। রেললাইন এবং সংলগ্ন বিভিন্ন বস্তিতে তারা অবস্থান করে। রেলের পরিত্যক্ত বগিতে বসে মাদক সেবন করে। এরপর স্ক্র্যাপবাহী পরিবহনে উঠে ছিনতাই করে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা কিছু ব্যক্তি শিশু-কিশোরদের ব্যবহার করে এই ছিনতাই কার্যক্রম পরিচালনা করছে।’

‘সাতটি রডের কারখানার মধ্যে প্রায় সবগুলোই খোলা ট্রাক অথবা ড্রাম ট্রাকে করে স্ক্র্যাপ পরিবহন করে। কারখানাগুলো নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মী দিয়ে স্কট দিয়ে সেগুলো বন্দর থেকে নিয়ে যায়। নিরাপত্তা কর্মীদের কাছে সে অর্থে কোনো অস্ত্র থাকে না। এজন্য তারা ছিনতাইকারীদের প্রতিরোধও করতে পারে না। এর মধ্যে দু’য়েকটি কারখানা স্ক্র্যাপ পরিবহনের আগে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে সহযোগিতা নেয়। বাকিগুলো পুলিশের সহযোগিতা নেয় না।’- বলেন একেএম মহিউদ্দিন সেলিম

সিএমপির গোয়েন্দা শাখার বন্দর জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার নোবেল চাকমা সারাবাংলাকে বলেন, ‘ছিনতাই করা স্ক্র্যাপ লোহাগুলো আবার পরিত্যক্ত মালামাল কেনার দোকানে বিক্রি হয়। আমরা এখনও সুনির্দিষ্টভাবে ক্রেতাদের শনাক্ত করতে পারিনি। তাদের শনাক্ত করে এসব স্ক্র্যাপ কেনা বন্ধ করতে পারলে ছিনতাইও কমে যাবে।’

সারাবাংলা/আরডি/একে

টপ নিউজ রড কোম্পানি রড তৈরির কাঁচামাল স্ক্র্যাপ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর