।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: ৭ মাস বয়সী তাহমিদ। গত তিন দিন ধরে জ্বর আর ১০দিন ধরে পাতলা পায়খানায় আক্রান্ত। হাজারীবাগের স্থানীয় ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে খাওয়ালেও কোনও উন্নতি হয়নি। বাধ্য হয়ে বাবা-মা গত ৭ এপ্রিল তাহমিদকে ভর্তি করান রাজধানীর মহাখালীর আইসিডিডিআর’বিতে।
লালবাগের ৮ মাস ১৯ দিন বয়সী হোমায়রাকে দেখে বোঝার উপায় ছিল না সে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে খেলনা নিয়ে দিব্যি খেলে যাচ্ছে, বাবার সঙ্গে দুষ্টুমিতে মেতে আছে। অথচ জ্বর, পাতলা পায়খানা আর বমি নিয়ে হাসপাতালে হোমায়রা ভর্তি হয় ৮ এপ্রিল সকালে। লালবাগেই প্লাস্টিকের ব্যবসা করা বাবা ইমরান আহমেদ বলেন, দুষ্টুমিতো কমেই গেছে। সুস্থ থাকাবস্থায় কোনও দিনই তাকে এভাবে শুইয়ে রাখা যেত না। মেয়েটা দুর্বল হয়ে গিয়েছে ডায়রিয়াতে।
পুরান ঢাকার শানারপাড়ের রিদওয়ান খান অনিকেরও একই অবস্থা গত এক সপ্তাহ ধরে। এলাকার ফার্মেসি থেকে ওষুধ খাওয়ালেও অনিক সুস্থ হয়নি। অবশেষে গতকাল অনিককে ভর্তি করানো হয় আইসিডিডিআরবিতে। মা সুবর্ণা আক্তার কাকলি বলেন, আমার হাসিখুশি ছেলেটা অনেকটা চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। তবে এখানে আসার পর তার অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে।
কেবল তাহমিদ, হোমায়রা, অনিকের মতো শিশুরাই নয়, ডায়রিয়াতে আক্রান্ত হয়ে এই হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ৩২ বছরের ফেরদৌসি রহমান, ২৯ বছরের আবুল বাশার, ৩৭ বছরের মীজানুল ইসলামের মতো বড়রাও।
আইসিডিডিআর’বি কর্তৃপক্ষ বলছে, ডায়রিয়াতে আক্রান্ত হয়ে এত রোগীর হাসপাতালে ভর্তি হওয়াটা স্বাভাবিক না। আর সবচেয়ে বড় কথা ডায়রিয়াতে আক্রান্ত হবার মৌসুম এখনও আসেনি। তার আগেই এভাবে মানুষ ডায়রিয়াতে আক্রান্ত হওয়া রীতিমতো অ্যালার্মিং। তাই এখনই সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত হতে হবে, যেন সে ধরণের অবস্থার সৃষ্টি হলে সেবা দেওয়া যায়। নিতে হবে সচেতনতামূলক কর্মসূচি।
সরেজমিনে মহাখালীতে অবস্থিত আইসিসিডিডিআরবিতে (আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র) গিয়ে দেখা যায়, হাসপাতালের প্রতিটি বেডে ডায়রিয়ার রোগী। কেবল নির্ধারিত বেডই নয়, কর্তৃপক্ষকে রোগীর চাপের কারণে বাড়াতে হয়েছে বেডের সংখ্যা, বেড রাখতে হয়েছে হাসপাতালের ভেতরের প্যাসেজেও।
কর্তৃপক্ষ বলছেন, গরমের আগেই ডায়রিয়ার এ প্রকোপের কারণ খাবার পানি। তারা বলছেন, প্রতিটি রোগীই নিজ নিজ এলাকায় দুর্গন্ধময় ও খারাপ পানির কথা বলেছেন।
আইসিডিডিআর থেকে জানা যায়, এই হাসপাতালে গত দুই এপ্রিল ডায়রিয়ার রোগী ছিল ৬২৯ জন, ৩ এপ্রিল ৭৫২ জন, ৪ এপ্রিল ৬৪২ জন, ৫ এপ্রিল ৬৫২ জন, ৬ এপ্রিল ৭৮৮ জন, ৭ এপ্রিল ৭৩৫ জন এবং আজ ৮ এপ্রিল দুপুর ১ টা পর্যন্ত রোগী ছিল ৩৬৫ জন। তবে দিন শেষে এই সংখ্যা দ্রুত হারে বাড়বে বলেই জানান কর্তৃপক্ষ। অথচ গত বছরের এই সময়ে রোগীর সংখ্যা চিল ৪০০ থেকে সাড়ে চারশোর এর মত। ২০১৬-১৭ সালেও ডায়রিয়া আক্রান্তের রোগীর সংখ্যা ৬০০ এর ওপরে ওঠে নি।
আইসিডিডিআরবির চিফ ফিজিশিয়ান এবং হাসপাতাল বিভাগের প্রধান ডা আযহারুল ইসলাম খান সারাবাংলাকে বলেন, সাধারণত মার্চ, এপ্রিল এবং মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত ডায়রিয়াতে আক্রান্ত হবার সময়। গত বছরে মে মাসের মাঝামাঝি রোগী ছিল ৬০০। আর এখনতো সেভাবেব গরম পড়েনি। কিন্তু এ বছরে এখনই রোগীর সংখ্যা ৭৮৮ তে গিয়ে ঠেকেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, আইসিডিডিআরবিতে তার সাড়ে তিন বছরের চাকুরি জীবনে তিনি এত রোগী দেখেননি।
ডা: আযহারুল ইসলাম খান বলেন, ‘আরামবাগ, লালবাগ. স্বামীবাগ, মতিঝিল, রামপুরা, মিরপুর, বাড্ডা, পুরান ঢাকা থেকে আসা রোগীরা সবাই পানির কথাই বলছে। তাই অসময়ের এই ডায়রিয়ার সঙ্গে গরম বা ঝড় বৃষ্টির সর্ম্পক নেই, বরং পানির সঙ্গেই বেশি সম্ভাবনা রয়েছে বলেই ধারণা করছি। ওয়াসার মূল পানির জায়গা খারাপ নয়তো যে পাইপ মানুষের বাসায় গিয়েছে সেই পাইপের কোথাও একটা সমস্যা হয়েছে অথবা বাসায় যাবার পর কোনও একটা সমস্যা হয়েছে। হঠাৎ করেই ওয়াসার পানি খারাপ হয়ে গিয়েছে সেটা বিশ্বাসযোগ্য নয়।’ তাই এটা পানির কারণ কী না, কোথা থেকে সমস্যা হচ্ছে, তা খুঁজে বের করা দরকার।
একই কথা বলেন মেরুল বাড্ডার ডিআইটি প্রজেক্ট থেকে আসা ৩২ বছরের ফেরদৌসি রহমানও। তিনি বলেন, পানিতে দুর্গন্ধ। ফুটিয়েও খাওয়া যায় না, এমনকী হাত মুখ ধুতে গেলেও নাকে এসে গন্ধ লাগে। পানির কারনেই বোধহয় ডায়রিয়াতে আক্রান্ত হলাম-বলেন তিনি।
আযহারুল ইসলাম খান বলেন, পানি কেন দূষিত হলো তা বলা কঠিন। আমাদের বিশ্বাস, ওয়াসা ভালো পানি দেয়। কিন্তু আমার ধারণা, বিভিন্ন সড়কে খোঁড়াখুঁড়ির কারণে পানির পাইপ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এতে পানি দূষিত হয়ে পড়ছে।
প্রতিরোধ হিসেবে করণীয় কী এমন প্রশ্নে এ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, যে কোনও সময় ডায়রিয়ার প্রাদুর্ভাব হলে দেখেছি স্বাস্থ্য অধিদফতরের একটি কো-অর্ডিনেশন কমিটি রয়েছে তারা একটি মিটিং ডাকেন যেখানে সব অংশীদাররা থাকেন। এ বছর এটাই সময় সবাইকে নিয়ে সে মিটিং করার।
প্রতিরোধক হিসেবে নিজে এবং চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার পরামর্শ দেন তিনি। একইসঙ্গে ৬ মাসের ছোট শিশু যারা রয়েছে, তাদেরকে সবসময় বুকের দুধ খাওয়াতে হবে- আর এ বিষয়ে সামাজিক স্টিগমা ভাঙতে হবে। মায়ের বুকের দুধ সন্তান পান করবে-এতে লজ্জা বা সংকোচের কিছু নেই-এ ম্যাসেজটা ছড়িয়ে দিতে হবে সংবাদ মাধ্যমকে-বলেন ডা. আযহারুল ইসলাম।
তিনি বলেন, ডায়রিয়া হলে খাবার স্যালাইন খাবে আর অবনতি হলে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে। সেটা যে এখানেই আসতে হবে তা নয়, কাছের যে কোনও হাসপাতালে গেলেই হবে।
আর গরম যদি সেভাবে পড়ে তাহলে ডায়রিয়া আক্রান্তের রোগীর সংখ্যা আরও বেড়ে যাবার আশঙ্কাও অনেক বেশি বলেন তিনি। আর সে সময়ের জন্য সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বেসরকারি হাসপাতালসহ অন্যান্য স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোকে প্রস্তুত রাখার জন্য নির্দেশ দিতে হবে সরকারকে।
ডা. আযহারুল ইসলাম খান আরও বলেন, বেসরকারি হাসপাতালের প্রতি সরকারের নির্দেশ থাকা দরকার যে, তাদের হাসপাতালেও ডায়রিয়া ওয়ার্ড থাকা উচিত, দরকার হলে আইসিডিডিআরবি তাদেরকে সব ধরনের টেকনিক্যাল সহযোগিতা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রয়েছে। এটা খুব দরকার, কারণ পানির সমস্যা যে রাতারাতি সমাধান হয়ে যাবে সেটা ভাবা ঠিক হবে না।
সারাবাংলা/জেএ/এমএস