Thursday 14 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

এক দশকের গবেষণায় সাফল্য— লিউকোমিয়া সারাবে টি-সেল থেরাপি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৯:১৪

ক্যানসারে আক্রান্ত কোষকে ধ্বংস করে দেয় কাইমেরিক অ্যান্টিজেন রিসেপটরযুক্ত টি-সেল

লিউকোমিয়া বা রক্তকণিকার ক্যানসার। অনিরাময়যোগ্য বলেই মরণব্যধি হিসেবে পরিচিত এই রোগ। তবে সাম্প্রতিক এক গবেষণার তথ্য বলছে, বিশেষ এক ধরনের ‘টি সেল’ থেরাপিতে লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত দুই ব্যক্তি এই রোগের লক্ষণ থেকে মুক্ত হয়েছেন। এক দশক ধরে ওই দুই ব্যক্তিকে এই থেরাপি দেওয়া হচ্ছিল। গবেষকরা বলছেন, লিউকোমিয়ার জন্য এটি দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। কোনো কোনো গবেষক এটিকে লিউকোমিয়া থেকে আরোগের সম্ভাব্য চিকিৎসা হিসেবেও দেখছেন।

বিজ্ঞাপন

সিএনএন ও গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়েছে, ব্রিটিশ সাপ্তাহিক জার্নাল ‘ন্যাচার’-এ গবেষণার ফল প্রকাশ করা হয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভ্যানিয়া এবং ক্যামব্রিজ, ম্যাসাচুসেটসের নোভারটিস ইনস্টিটিউট অব বায়োমেডিকেলে রিসার্চের গবেষকরা এই গবেষণাটি চালিয়েছেন।

গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, ওই দুই ব্যক্তির লিউকোমিয়ার চিকিৎসায় মূলত ব্যবহার করা হয়েছে ‘কাইমেরিক অ্যান্টিজেন রিসেপটর-টি’ সেল তথা কার-টি সেল থেরাপি। এটি বিশেষ এক ধরনের রোগ প্রতিরোধী কোষ, গবেষণাগারে যেটিকে কিছুটা পরিবর্তন করা হয়েছে।

বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বলছে, বিশ্বে যত মানুষ লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত হন, তার এক-চতুর্থাংশই ক্রনিক লিম্ফোসাইট লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন। কার-টি সেল থেরাপিকে এই ক্রনিক লিম্ফোসাইট লিউকোমিয়ার ‘নিরাময়যোগ্য চিকিৎসা’ হিসেবে বর্ণনা করছেন গবেষকরা।

কার-টি সেল থেরাপি নিয়ে লিউকোমিয়া থেকে মুক্ত হয়েছেন ডোগ ওলসন

কার-টি সেল থেরাপি নিয়ে লিউকোমিয়া থেকে মুক্ত হয়েছেন ডোগ ওলসন

১০ বছরেরসফল গবেষণা

গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত যে দুই জন রোগীকে নিয়ে গবেষণা চালানো হয়েছে, তাদের মধ্যে প্রথম জনকে ১০ বছর ধরে কার-টি সেল থেরাপি দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রথমবারের মতো রোগীর নিজস্ব রোগ প্রতিরোধী ব্যবস্থা থেকেই কোষ ব্যবহার করা হয়েছে। এরপর ওই কোষটিকে গবেষণাগারে নিয়ে ভাইরাস ব্যবহার করে কিছু জেনেটিক পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর ফলে ওই কোষটি ক্যানসারের উৎসগুলোকে ধ্বংস করার সক্ষমতা অর্জন করেছে।

১০ বছর এই থেরাপি দেওয়ার পর তার ফলাফল বিশ্লেষণ করে এই গবেষণার অন্যতম গবেষক এবং ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভ্যানিয়ার ক্যানসার ইমিউনোলজিস্ট ড. কার্ল জুন বলছেন, আমরা এখন এই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে কার-টি সেল প্রকৃতপক্ষে লিউকোমিয়ার রোগীকে আরোগ্য দিতে সক্ষম।

বিজ্ঞাপন

ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত ওই দুই ব্যক্তির চিকিৎসার দুইটি আলাদা ধাপের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রথম ধাপে সিডি৮+ বা সিডি৪-সিডি৮ কার-টি সেলে হেলিওস নামে একটি মার্কার ব্যবহার করা হয়েছে। এতে ওই দুই ব্যক্তির শরীরে লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত কোষের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আসতে শুরু করে। দ্বিতীয় দীর্ঘমেয়াদি ধাপে ব্যবহার করা হয় সিডি৪+ কার-টি সেল। এই ধাপে লিউকোমিয়ার প্রভাব ক্রমেই কমে গিয়ে এই নতুন কোষগুলোই প্রাধান্য বিস্তার করতে থাকে।

গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, কার-টি সেলগুলো ওই দুই রোগীর শরীরে প্রবেশ করানোর ১০ বছর পরও এর উপস্থিতি শনাক্ত করা গেছে। একইসঙ্গে দু’জনেই লিউকোমিয়া থেকে ধারাবাহিকভাবে আরোগ্য লাভ করেছেন। ২০১০ সালে প্রথম ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ওই দুই রোগীর শরীরে দীর্ঘস্থায়ী কার-টি সেল প্রবেশ করানোর পর থেকেই তারা লিউকোমিয়ার প্রভাবমুক্ত হন। থেরাপি প্রয়োগের ১০ বছরেরও বেশি সময় পরও তারা একই অবস্থায় ছিলেন।

লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত রোগীর শরীরে যেভাবে কাজ করে কার-টি সেল থেরাপি

লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত রোগীর শরীরে যেভাবে কাজ করে কার-টি সেল থেরাপি

পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কমছে

লিউকোমিয়ার আরোগ্যের পথ দেখালেও এর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও রয়েছে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই থেরাপি আরও বেশি নিরাপদ হয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছেন এই গবেষণায় যুক্ত আরেক গবেষক ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ড. ডেভিড পোর্টার। তিনি বলেন, গত কয়েক বছর ধরে কয়েক হাজার মানুষের ওপর এই থেরাপি প্রয়োগ করা হয়েছে। এটি আগের তুলনায় অনেক বেশি নিরাপদ হয়ে উঠেছে।

এই থেরাপির একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে টিউমার লাইসিস সিনড্রোম। এ ক্ষেত্রে থেরাপিতে প্রয়োগ করা টি-সেলগুলো ক্যানসারের জন্য দায়ী কোষগুলোকে একই সময়ে ধ্বংস করে। এর ফলে ওই কোষগুলোর উপদান রক্তে ছড়িয়ে পড়লে মানুষ দ্রুত অসুস্থ হয়ে যেতে পারে। এর ফলে ইলেকট্রোলাইটের ভারসাম্যও নষ্ট হতে পারে এবং কিডনিতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে হবে।

এর আরেকটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে সাইটোকাইন রিলিজ সিনড্রোম, যেখানে ফ্লুজাতীয় উপসর্গে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তীব্র জ্বর, মাথা ঘোরানো, বমি বমি ভাব, পেশী ও শরীরের বিভিন্ন সংযোগস্থলে ব্যথার মতো উপসর্গগুলো দেখা দিতে পারে। ড. পোর্টার বলছেন, এর ফলে রক্তচাপও ব্যাপকভাবে কমে যেতে পারে এবং শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা ও ফুসফুস থেকে তরল বেরিয়ে আসার মতো ঘটনা ঘটতে পারে।

টি সেল থেরাপির বড় ধরনের আরেকটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে নিউরোলজিক টক্সিসিটি বা স্নায়বিক বৈকল্য, যার জের ধরে কথা বলা বা স্পষ্টভাবে চিন্তার ক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোমায় চলে যাওয়া বা খিঁচুনির মতো লক্ষণ দেখা দিতে পারে। তবে ড. পোর্টার বলছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ ধরনের সমস্যাগুলোর সমাধান নিজে থেকেই হয়ে যায়।

প্যারিসের একটি ল্যাবে চলছে কার-টি সেল তৈরির কাজ

প্যারিসের একটি ল্যাবে চলছে কার-টি সেল তৈরির কাজ

১০ বছরেও সক্রিয় কার-টি সেল

কার-টি সেল থেরাপির মাধ্যমে লিউকোমিয়ার চিকিৎসার প্রভাব পর্যবেক্ষণের জন্য ড. জুন নিজেদের একটি গবেষণাগার স্থাপনের জন্য নিজেদের দলে যুক্ত করেন ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভ্যানিয়ার ড. জোসেফ মেলেনহর্স্টকে। তিনি বলছেন, থেরাপিতে কার-টি সেল যেগুলো ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানার চেষ্টা করেছেন। নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা এই কোষগুলোকে সম্পূর্ণ আলাদা করতে পেরেছেন। দু’জনের শরীরেই এর প্রভাবগুলোও তারা চমৎকারভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছেন।

যে দু’জনের ওপর এই গবেষণাটি চালানো হয়েছে তার মধ্যে একজন ডোগ ওলসন। তার শরীরে যখন ক্রনিক লিম্ফোসাইটিক লিউকোমিয়া ধরা পড়ে তখন তার বয়স ছিল ৪৯ বছর। তিনি জানান, ক্যানসারে আক্রান্তের খবর শুনে অন্যদের মতো তিনিও অত্যন্ত ভীত হয়ে পড়েছিলেন। তবে প্রথম ছয় বছরে তার তেমন কোনো চিকিৎসা হয়নি। পরের পাঁচ বছরে তিনি কেমোথেরাপি নিতে শুরু করলে এর প্রভাব কমতে শুরু করে। তবে এরপর দ্রুতই তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। ২০১০ সাল নাগাদ তার অস্থিমজ্জার প্রায় অর্ধেকই লিম্ফোসাইটিক লিউকোমিয়ায় পরিণত হয়ে যায়।

ওলসন বলেন, ওই বছরেই অর্থাৎ ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে তাকে প্রথম কার-টি সেল থেরাপি দেওয়া হয়। ওই সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং তিন দিন হাসপাতালেও থাকতে হয়। তবে পরের সপ্তাহেই ওলসন যে চিকিৎসককে দেখাচ্ছিলেন তিনি জানান, তার শরীরে ক্যানসারের কোনো কোষ আর পাওয়া যাচ্ছে না।

ড. জুন বলেন, আমরা ২০১০ সালে এই থেরাপি শুরু করেছি। কিন্তু ওই সময়ও আমরা ভাবতে পারিনি যে এটি লিউকোমিয়া নিরাময়ে সক্ষম চিকিৎসা পদ্ধতি হয়ে উঠতে পারবে। কিন্তু এখন গবেষণার তথ্য দিয়ে আমরা বলতে পারি— হ্যাঁ, এটি লিউকোমিয়া নিরাময় করতে সক্ষম। কারণ আমরা থেরাপি দেওয়ার ১০ বছর পরও ওই রোগীদের শরীরে লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত কোষের উপস্থিতি দেখতে পাচ্ছি না। বরং তাদের শরীরে কার-টি সেলের উপস্থিতি এখনো বর্তমান। অর্থাৎ এই সেলগুলো এখনো ক্যানসারে আক্রান্ত কোষগুলোর সন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে এবং পেলে নিশ্চয় ধ্বংসও করে দিচ্ছে।

সারাবাংলা/টিআর

ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভ্যানিয়া কাইমেরিক অ্যান্টিজেন রিসেপটর কার-টি সেল কার-টি সেল থেরাপি ক্যানসারের চিটিৎসা ক্রনিক লিম্ফোসাইটিক লিউকোমিয়া নোভারটিস ইনস্টিটিউট অব বায়োমেডিকেলে রিসার্চ ন্যাচার জার্নাল লিউকোমিয়া

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর