৯০ হাজার কর্মচারী জাতীয়করণের আপিল শুনানির জন্য প্রস্তুত
৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১২:৫৩
ঢাকা: স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন গ্রাম পুলিশ সদস্যদের (দফাদার ও মহল্লাদার) চাকরি, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রাইমারি স্কুলের দফতরি কাম প্রহরীদের চাকরি এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার পদের চাকরি জাতীয়করণে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের নিয়মিত আপিল শুনানির জন্য প্রস্তুত হয়েছে।
সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি দফতরের প্রায় ৯০ হাজার কর্মচারীর চাকরি রাজস্বখাতে স্থানান্তর করতে হাইকোর্ট রায় ঘোষণার কয়েক বছর পর রাষ্ট্রপক্ষের আপিল আবেদনের শুনানির জন্য দিন ধার্য করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
দেশের বিভিন্ন জেলার ৬৪০২ জন কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারের (সিএইচসিপি) দায়ের করা ৭৬টি মামলার মধ্যে ৭৪টি মামলায় হাইকোর্ট সিএইচসিপিদের চাকরি রাজস্বখাতে স্থানান্তরের নির্দেশ দেন। পরবর্তী সময়ে ৬১টি মামলার ক্ষেত্রে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি ৬১টি মামলার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের ওপর শুনানির জন্য দিন ধার্য রেখেছেন আপিল বিভাগ।
আর বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৯৩২ দফতরি কাম প্রহরীদের চাকরি রাজস্বখাতে স্থানান্তরে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে চারটি মামলায় আপিল আবেদন করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। আপিল বিভাগে আগামী ৭ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের ওপর শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে।
দেশের বিভিন্ন স্থানের ৩৫৫ জন গ্রাম পুলিশ সদস্যের দায়ের করা রিটের পর হাইকোর্ট তাদের চাকরি রাজস্বখাতে স্থানান্তর করতে রায় দেন।
পরবর্তী সময়ে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল আবেদন করে। আগামী ৮ মার্চ রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের ওপর চূড়ান্ত শুনানির জন্য দিন নির্ধারণ করে দিয়েছেন আপিল বিভাগের চেম্বার জজ আদালত।
আইনজীবীরা বলছেন, এ তিনটি মামলায় আবেদনকারী কয়েক হাজার হলেও হাইকোর্টের রায় আপিল বিভাগে বহাল থাকলে ওই পদগুলোতে দায়িত্বপালনকারী প্রায় ৯০ হাজার কর্মচারীর চাকরি জাতীয়করণের পথ খুলে যেতে পারে। কারণ আপিল বিভাগের রায় পক্ষে থাকলে পরবর্তীতে আইনি প্রক্রিয়া অবলম্বন করে খুব সহজেই অন্যরা তাদের চাকরি রাজস্বখাতে স্থানান্তর করতে পারবে। এ জন্য সরকারের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি দফতরের এই মামলাগুলো শুনানির জন্য দুই (রাষ্ট্রপক্ষ ও রিটকারী) পক্ষের আইনজীবীরা জোর প্রস্তুতি নিয়েছেন।
কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের মামলা: কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের চাকরি রাজস্বখাতে স্থানান্তর চেয়ে ২০১৭ সালে সহিদুল ইসলাম, কামাল সরকার, জাহিদুল ইসলামসহ ১০ জন সিএইচসিপি হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন।
শুনানি শেষে একই বছরের ২২ মার্চ বিচারপতি আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি আশীষ রঞ্জন দাসের হাইকোর্ট বেঞ্চ আবেদনকারী ১০ জন সিএইচসিপির চাকরি রাজস্বখাতে স্থানান্তরের নির্দেশ দিয়ে রায় ঘোষণা করেন। পরে একই বছরের সেপ্টেম্বরে ১০ পৃষ্ঠার ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশিত হয়।
এরপর একইভাবে ২০১৭ ও ২০১৮ সালে হাইকোর্টে ৭৬টি রিট দায়ের করেন দেশের বিভিন্ন জেলার কয়েক হাজার সিএইচসিপি। এর মধ্যে ৭৪টি রিটে সিএইচসিপিদের পক্ষে রায় হয়। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপক্ষ এসব রায়ের মধ্যে ৬১টি রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করে। মামলাগুলো চেম্বার আদালত হয়ে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে আসে। এর ধারাবাহিকতায় আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষের আপিল শুনানির জন্য দিন ধার্য রয়েছে।
কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারদের সংগঠন বাংলাদেশ সিএইচসিপি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জাহিদুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা কমিউনিটি ক্লিনিকের সিএইচসিপিদের চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তর চেয়ে হাইকোর্টে অনেকগুলো রিট করেছিলাম। এর মধ্যে ৭৪টি রিটের রায় আমাদের পক্ষে পেয়েছি। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপক্ষ ৬১টি রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। আগামী ৬ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের ওপর শুনানির জন্য দিন ধার্য রয়েছে।’
আপিল বিভাগে সিএইচসিপিদের (রিটকারী) পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মইনুল হোসেন, রোকনুজ্জামান মাহমুদ, এ জে মোহাম্মদ আলী এবং খুরশীদ আলম খানসহ আরও কয়েকজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে সারাদেশে ১৩ হাজার ৭৬১ জন সিএইচসিপি রয়েছে বলে জানান তিনি।
প্রাইমারি স্কুলের দফতরি কাম প্রহরীদের মামলা: প্রাইমারি স্কুলের দফতরি কাম প্রহরীদের চাকরি রাজস্বখাতে স্থানান্তর চেয়ে ২০১৭ ও ২০১৮ সালে হাইকোর্টে পৃথক ছয়টি রিট করা হয়। সাধন চন্দ্র বাড়ইসহ দেশের বিভিন্ন জেলার ৯৩২ জন দফতরি এ সব রিট দায়ের করেন। এরপর ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি দফতরি কাম প্রহরীদের চাকরি রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের নির্দেশ দিয়ে রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট।
পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপক্ষ হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের করে। চেম্বার আদালত হাইকোর্টের রায় স্থগিত করে তা আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দেন। এরপর রাষ্ট্রপক্ষ হাইকোর্টের ছয়টি রায়ের মধ্যে চারটি রায়ের সারসংক্ষেপ ও পেপারবুক তৈরি করে জমা দেওয়ার পর চূড়ান্ত শুনানির জন্য দিন ধার্য করেন আপিল বিভাগ। আগামী ৭ ফ্রেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপক্ষের আপিল আবেদনের ওপর শুনানির জন্য দিন ধার্য রেখেছেন সর্বোচ্চ আদালত।
আপিল বিভাগে রিটকারীদের পক্ষে মামলা পরিচালনা করতে আইনজীবী আলী আজমকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল দায়ের করেছিল। সেই আপিল আবেদন চেম্বার আদালত হয়ে আপিল বিভাগে এসেছে। রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের ওপর চূড়ান্ত শুনানির জন্য দিন নির্ধারণ করে দিয়েছেন আপিল বিভাগ।’
২০১২ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দফতরি কাম প্রহরী নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। পরবর্তীতে প্রথম ধাপে ২২৯২৫টি এবং এরপর আরও ৪৯২০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সম সংখ্যক পদে দফতরি কাম প্রহরী নিয়োগ দেওয়া হয়।
গ্রাম পুলিশ সদস্যদের মামলা: ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর ঢাকার ধামরাই উপজেলার দফাদার মো. লাল মিয়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের ৩৫৫ জন গ্রাম পুলিশ সদস্য হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের দায়ের করেন। ওই রিটের শুনানি নিয়ে ২০১৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর হাইকোর্ট গ্রাম পুলিশ সদস্যদের চাকরি জাতীয়করণের রায় দেন। রায়ে গ্রাম পুলিশ সদস্যদের মধ্যে দফাদারদের জাতীয় বেতন স্কেলের ১৯তম গ্রেডে এবং মহল্লাদারদের জাতীয় বেতন স্কেলের ২০তম গ্রেডে বেতন প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়।
পরে ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। তবে মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য শুনানির ব্যবস্থা নিতে গ্রাম পুলিশ সদস্যদের পক্ষে আপিল বিভাগে একটি আবেদন দাখিল করা হয়। গ্রাম পুলিশ সদস্যদের দাখিল করা আবেদন আমলে নিয়ে আগামী ৮ মার্চ শুনানির দিন ধার্য করেন চেম্বার আদালত।
গ্রাম পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ হুমায়ন কবির পল্লব।
তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত ২৭ জানুয়ারি বিবাদীদের পক্ষে সারসংক্ষেপ, অতিরিক্ত পেপারবুক এবং মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির দিন নির্ধারণের জন্য আবেদন করা হয়েছিল। ওই আবেদন আমলে নিয়ে আগামী ৮ মার্চ চূড়ান্ত শুনানির দিন ধার্য করেছেন চেম্বার আদালত। ওইদিন আপিল বিভাগে রিটকারীদের পক্ষে শুনানির জন্য জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মুনসুরুল হক চৌধুরীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।’
বর্তমানে সারাদেশে প্রায় ৪৭ হাজার গ্রাম পুলিশ সদস্য (দফাদার ও মহল্লাদার) রয়েছে বলে জানান তিনি।
সারাবাংলা/কেআইএফ/একে