১ বছরে ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ পেয়েছে ১০ কোটি মানুষ
৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১২:৪৫
ঢাকা: দেশে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে জাতীয় পর্যায়ে ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হয় ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। নানা রকমের ঘটনাপ্রবাহের মাঝে এক বছর সময়ে দেশে এখন পর্যন্ত প্রথম ডোজের ভ্যাকসিন পেয়েছে ৯ কোটি ৯১ লাখ ৩৭ হাজার ৭৩৮ জন। এখন পর্যন্ত দ্বিতীয় ডোজের ভ্যাকসিন পেয়েছেন ছয় কোটি ৫১ লাখ ৪৫ হাজার ৪৫৭ জন। এ ছাড়াও এখন পর্যন্ত ২০ লাখ ৭৮ হাজার ৫০৫ জনকে বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে কোভিড-১৯ সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি দেখা দিলেও মৃত্যুর হার কম ছিল। ভ্যাকসিন প্রয়োগের কারণে এ সময়ে মৃত্যুঝুঁকি অনেকটাই কমে এসেছে। এই এক বছরে যেভাবে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়েছে তা বাংলাদেশের ভ্যাকসিন প্রয়োগের সক্ষমতার প্রমাণ দেয়। এখন খুব দ্রুত যারা এখনো ভ্যাকসিন গ্রহণ করেন নি তাদের পরিকল্পনার আওতায় এনে সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
ভ্যাকসিন কর্মসূচির উদ্বোধন
দেশে ২৭ জানুয়ারি প্রথম করোনা ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে এদিন ২৬ জন ভ্যাকসিন গ্রহণ করেন। ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে কেনা এবং ভারতের কাছ থেকে উপহার পাওয়া অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার কোভিশিল্ড ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়। এ দিন দেশে প্রথম ভ্যাকসিন নেওয়া কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স রুনু ভেরোনিকা কস্তা।
এ দিন ভ্যাকসিনের নিবন্ধনের জন্য সুরক্ষা প্ল্যাটফর্মের ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন (www.surokkha.gov.bd) সীমিত আকারে উন্মুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে অফিসিয়ালি এই ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনে নিবন্ধন শুরু করা হয়।
এর একদিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) প্রাথমিকভাবে ৫৪১ জনকে ভ্যাকসিন প্রদান করা হয়। এ দিন জানানো হয় ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সারাদেশে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা শুরু হবে জাতীয় পর্যায়ে।
৭ ফেব্রুয়ারি ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু সারাদেশে
২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পর্যায়ে ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু করা হয়। সকাল ১০টা ৩০ মিনিটে স্বাস্থ্য অধিদফতরের সম্মেলনকক্ষে সারা দেশে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কর্মসূচি উদ্বোধন করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। এসময় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম ও সাবেক খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম। বিভিন্ন জেলায় ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রমে জড়িত কর্মকর্তাদের সঙ্গেও কথা বলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। এর পরপরই বিভিন্ন জেলায় ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম শুরু হয়।
এদিন এক হাজার পাঁচটি হাসপাতালে একযোগে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) ভ্যাকসিন প্রয়োগের কর্মসূচি শুরু করা হয়। ঢাকায় ৫০টি ও ঢাকার বাইরে ৯৫৫টি হাসপাতালে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগের কার্যক্রম শুরু করা হয়।
সব আলোচনা-সমালোচনা, দ্বিধা-ভয় কাটিয়ে একযোগে সারাদেশে ভ্যাকসিন নেন মন্ত্রী, বিচারপতি, প্রতিমন্ত্রী, এমপি, মেয়র, সচিব ও সরকারি পর্যায়ের সিনিয়র কর্মকর্তারা।
এদিন সারাদেশে ভ্যাকসিন নেন ৩১ হাজার ১৬০ জন। আর রাজধানীতেই ভ্যাকসিন গ্রহণ করেন পাঁচ হাজার ৭১ জন। এর মধ্যে তিন হাজার ৭৭২ জন পুরুষ ও এক হাজার ২৯৯ জন নারী।
পরবর্তীতে ৮ এপ্রিল থেকে ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ প্রয়োগ শুরু হয়।
ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ প্রয়োগ বন্ধ ঘোষণা
ভারতে কোভিড-১৯সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলে সিরাম ইনস্টিটিউটকে ভ্যাকসিন রফতানি করতে নিষেধাজ্ঞা দেয় দেশটি। এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রমে। এই প্রতিষ্ঠান থেকেই তিন কোটি ভ্যাকসিন কেনার চুক্তি করে বাংলাদেশ যা ছয় মাসে ৫০ লাখ করে পাওয়ার কথা বাংলাদেশের। কিন্তু সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায় ভারতে কোভিড-১৯ সংক্রমণ বৃদ্ধি পেলে।
এর ফলে ২৫ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদফতর জানায়, ২৬ এপ্রিল থেকে দেশে ভ্যাকসিনের প্রয়োগ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
এ দিন স্বাস্থ্য অধিদফতরের এমএনসিঅ্যান্ডএইচ শাখার লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. শামসুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ২৩ এপ্রিল থেকে ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজের জন্য এসএমএস পাঠানো হচ্ছে না। ২৬ এপ্রিল থেকে ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ প্রয়োগ আপাতত বন্ধ করা হচ্ছে। তবে এটি চালু কবে হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। ভ্যাকসিনের প্রাপ্যতার ওপরে নির্ভর করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ভ্যাকসিন কূটনীতি
ভারত থেকে ভ্যাকসিন আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে এলে সরকারের পক্ষ থেকে নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর ফলশ্রুতিতে চীন, রাশিয়াসহ একাধিক দেশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয় কূটনৈতিক পর্যায়ে।
২৯ এপ্রিল দেশে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেওয়া হয় চীনে উদ্ভাবিত সিনোফার্মা ভ্যাকসিন।
এদিন ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘আমরা আজকে সেটার ইমার্জেন্সি ইউজের অথরাইজেশন দিয়েছি। এই ভ্যাকসিন কেনা হবে সরকারি পর্যায়ে। চীন অনুদান হিসেবে ৫ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন দিয়েছে। এগুলো আগামী এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশে আসবে।’
এর আগে ২৭ এপ্রিল রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি ভ্যাকসিন দেশে প্রয়োগের জরুরি অনুমোদন দেয় ওষুধ প্রশাসন অধিদফতর।
১৯ মে দেশে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সরাসরি সংগ্রহ প্রক্রিয়ার (ডিপিএম) অধীনে চীনের সিনোফার্মের কাছ থেকে ভ্যাকসিন কেনার প্রস্তাব নীতিগতভাবে অনুমোদন দেয় সরকার।
চীন থেকে আসে উপহারের ভ্যাকসিন
ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পরে সর্বপ্রথম ভ্যাকসিন আসে চীন থেকে। ১২ মে ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ৫ লাখ চীনা ভ্যাকসিনের একটি চালান এসে পৌঁছে বাংলাদেশে।
কোভ্যাক্স সহায়তা
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মোকাবিলায় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের ৯২টি দেশে ভ্যাকসিন সরবরাহের উদ্যোগ নেয় ‘দ্য ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স, গ্যাভি’। এই দেশগুলোর ভ্যাকসিন পাওয়া নিশ্চিত করতে গঠন করা হয়েছে আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম ‘কোভ্যাক্স’। বাংলাদেশ এই বৈশ্বিক উদ্যোগ থেকে ভ্যাকসিন পাওয়ার জন্য আবেদন করে গত বছরের ৯ জুলাই। ১৪ জুলাই গ্যাভি সেই আবেদন গ্রহণ করে। ১৮ সেপ্টেম্বর গ্যাভির পক্ষ থেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি পাঠানো হয়। তাতে জানানো হয়, কোভিড-১৯ মোকাবিলায় বাংলাদেশ এই ভ্যাকসিন পেতে পারে।
এই কোভ্যাক্স উদ্যোগের আওতাতেই বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত এসেছে কোভিশিল্ড, মডার্না, ফাইজার ও জনসনের ভ্যাকসিন। ২০২১ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির মধ্যেই কোভ্যাক্স থেকে ভ্যাকসিন পাওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা ছিল। নানা কারণেই সেই তারিখ পিছিয়ে যায়। পরবর্তীতে ৩০ মে কোভ্যাক্স ফ্যাসিলিটি থেকে ফাইজারের অন্তত এক লাখ ছয় হাজার কোভিড ভ্যাকসিন বাংলাদেশে পাঠায় গ্যাভি।
২ জুলাই কোভ্যাক্স সুবিধার আওতায় বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসে মডার্নার ভ্যাকসিন।
ফের শুরু ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ প্রয়োগ
দেশে ১৯ জুন থেকে শুরু হতে হয় চীন থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া সিনোফার্মের প্রথম ডোজ ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম। রাজধানীর চারটি মেডিকেল কলেজসহ দেশের অন্যান্য ৬৩ জেলায় এক যোগে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম শুরু করে সরকার। চীন সরকারের পক্ষ থেকে উপহার হিসেবে পাওয়া এই ভ্যাকসিন দেওয়ার জন্য ১০টি ক্যাটাগরিতে পাঁচ লাখ মানুষকে টার্গেট করা হয়।
পরবর্তীতে ২১ জুন রাজধানীর তিনটি কেন্দ্রে পর্যবেক্ষণমূলকভাবে প্রয়োগ করা হয় ফাইজার-বায়োএনটেকের ভ্যাকসিন। ১ জুলাই থেকে দেশে প্রবাসীদের পর্যবেক্ষণমূলকভাবে এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু করা হয়। ৫ জুলাই থেকে তাদের নিবন্ধন শুরু করা হয়।
১৩ জুলাই থেকে দেশে মডার্নার ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হয় দেশের ১২ সিটি করপোরেশনে।
৫ জুলাই ফের সুরক্ষা প্ল্যাটফর্ম উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় ভ্যাকসিন নিতে আগ্রহীদের জন্য। তবে শুরুতে ভ্যাকসিন গ্রহণের জন্য ন্যূনতম বয়সসীমা ৪০ করা হলেও এদিন বয়সসীমা কমিয়ে ৩৫ আনা হয়। পরবর্তীতে ১৯ জুলাই সেই বয়সসীমা ৩০-এ নামিয়ে আনা হয়। ৩০ জুলাই এই বয়সসীমা আরও কমিয়ে ২৫এ নিয়ে আসা হয়।
১৮ জুলাই থেকে দেশে বিভিন্ন কল-কারখানার শ্রমিকদের ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু করা হয়। ৭ আগস্ট থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হয়। এই কর্মসূচিতে জাতীয় পরিচয় পত্র বা জন্মনিবন্ধন না থাকলেও ভ্যাকসিন প্রয়োগের নির্দেশনা দেওয়া হয়।
৮ আগস্ট থেকে ১৮ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সের নাগরিকরা জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে ভ্যাকসিন গ্রহণের জন্য সুরক্ষা প্ল্যাটফর্মে নিবন্ধন করতে পারবেন বলে জানানো হয়। আর যারা এখনো জাতীয় পরিচয়পত্র পাননি, তারা স্থানীয় জনপ্রতিনিধির কাছ থেকে প্রত্যয়নপত্র নিয়ে ভ্যাকসিন নিতে পারবে বলেও জানানো হয়।
একই দিন (রোববার, ৮ আগস্ট) স্বাস্থ্য অধিদফতরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিইআই) থেকে জারি করা এক নির্দেশনায় অন্তঃসত্ত্বা ও স্তন্যদানকারী নারীদের ভ্যাকসিন প্রয়োগ করার নির্দেশনার বিষয়ে জানানো হয়।
১৯ আগস্ট দেশে ভ্যাকসিন প্রয়োগের বয়সসীমা ১৮ বছর করা হয়।
আগস্টে গণটিকা কার্যক্রম
৭ আগস্ট দেশে প্রথমবারের মতো গণটিকাদান কর্মসূচি হাতে নেয় সরকার। ওই কর্মসূচির আওতায় ছয় দিনে দেশে ৫০ লাখ ৭১ হাজার মানুষ প্রথম ডোজের ভ্যাকসিন নিয়েছিলেন বলে জানায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। পরে ৭ সেপ্টেম্বর এ কর্মসূচিতে দ্বিতীয় ডোজ ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হয়। ৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কেবল ঢাকায় এ কর্মসূচি চালানো হয়। ঢাকার বাইরে চলে আরও তিন দিন, ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।
পরবর্তী সময়ে ২৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে স্বাস্থ্য অধিদফতর বিশেষ গণটিকাদান কর্মসূচি ঘোষণা করে। দেশব্যাপী পরিচালিত গণটিকা কার্যক্রমের আওতায় দুই দিনে ৮২ লাখেরও বেশি মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। এর মধ্যে প্রথম ডোজের ভ্যাকসিন পায় ৭৮ লাখ ১১ হাজার ২১৬ জন।
১৬ নভেম্বর থেকে দেশের বিভিন্ন বস্তি এলাকায় ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হয়। এরপর ৩০ নভেম্বর দেশে ভ্যাকসিনের বুস্টার ডোজ দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানানো হয়। পরে ১৯ ডিসেম্বর পরীক্ষামূলকভাবে ৬০ জনকে করোনা ভ্যাকসিনের বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়। এরপর ২৮ ডিসেম্বর থেকে জনসাধারণ পর্যায়ে এই ভ্যাকসিনের বুস্টার ডোজ প্রয়োগ শুরু হয়।
শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন প্রয়োগ
১৪ অক্টোবর মানিকগঞ্জে পরীক্ষামূলকভাবে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী স্কুল শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু করা হয়। পরবর্তীতে ১ নভেম্বর রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলে শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়। প্রথমদিন প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থীকে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়। দ্বিতীয় দিন থেকে অর্থাৎ ২ নভেম্বর থেকে রাজধানীর ৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়।
ভ্যাকসিন প্রয়োগের লক্ষ্যমাত্রায় পরিবর্তন
মোট জনসংখ্যার ৮০ ভাগ নাগরিককে ভ্যাকসিন দেওয়ার প্রাথমিক পরিকল্পনা পরিবর্তন করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, আগামী জুন মাসের মধ্যে দেশের জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ মানুষকে ভ্যাকসিন দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। অর্থাৎ ১১ কোটি ৯২ লাখ ২১ হাজার মানুষকে ভ্যাকসিন দিতে হবে এই সময়ে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, আগামী জুন মাসের মধ্যে দেশের জনসংখ্যার ৭০ শতাংশকে অর্থাৎ ১১ কোটি ৯২ লাখ ২১ হাজার মানুষকে টিকা দিতে হবে।
জানুয়ারিতে রেকর্ড ভ্যাকসিনেশন
দেশে নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী অবস্থায় বিভিন্ন নমুনার সিকোয়েন্সিংয়ে শনাক্ত হয় নতুন ভ্যারিয়েন্ট বলে পরিচিত ওমিক্রন। কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রমে মাঝে কিছুটা সময় মানুষের মাঝে আগ্রহের হার কম দেখা গেলেও জানুয়ারি মাসে রেকর্ড পরিমাণ ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়েছে। শুধুমাত্র এই মাসে দেশে প্রথম, দ্বিতীয় ও বুস্টার মিলিয়ে তিন কোটি ৫৮ লাখ ৪১ হাজার ৮১৫ ডোজ ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়েছে।
মাসভিত্তিক ভ্যাকসিনেশনের পরিসংখ্যান
দেশে ২০২১ সালের ৭ জানুয়ারি জাতীয় পর্যায়ে ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু করা হয়। সেই মাসে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয় ৩০ লাখ ৭৮ হাজার ৭৯৮ জনকে। পরবর্তীতে মার্চ মাসে ২২ লাখ ৫৯ হাজার ৯০৬ জনকে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়। তবে এর পরে ভারতে সংক্রমণ বাড়তে থাকার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রমে। সিরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ভ্যাকসিন দিতে না পারায় এপ্রিল মাসে মাত্র চার লাখ ৪৯ হাজার ২২৫ জনকে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়।
তবে এই সংখ্যা আরও কমে আসে মে মাসে। এই মাসে মাত্র দুই হাজার ৫০১ জনকে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়। একইসঙ্গে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম শ্লথ করে অন্যান্য স্থান থেকেও ভ্যাকসিন ক্রয়ের চেষ্টা করা হয়। জুন মাসে ৫৮ হাজার ৭৪৫ জনকে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হলেও এর গতি বৃদ্ধি পায় জুলাই মাস থেকে।
মূলত জুলাই মাসে পরে দেশের ভ্যাকসিন কার্যক্রম পুনরায় গতি ফিরে পায়। এই মাসেই দেশে গণটিকা কার্যক্রমের মাধ্যমে ওয়ার্ডভিত্তিক ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু করা হয়। দেশে এই মাসে ২৯ লাখ ৭৪ হাজার ২৯০ জনকে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়। আগস্ট মাসে ৯৬ লাখ ৮৩ হাজার ৬৬৭ জন ও সেপ্টেম্বর মাসে দেশে এক কোটি ৪৮ লাখ ৩৫ হাজার ৭৬৪জনকে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়।
অক্টোবর মাসে দেশে আবার ভ্যাকসিন প্রয়োগে কিছুটা ভাটা দেখা যায়। এই মাসে ৮৮ লাখ ৩৪ হাজার ৭৮৮ জনকে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়। নভেম্বর মাসে দেশে এক কোটি ৯৬ লাখ ৬৭ হাজার ২৮৯ জনকে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয় যা এখন পর্যন্ত দেশে এক মাসে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভ্যাকসিন প্রয়োগের পরিসংখ্যান। ডিসেম্বর মাসে দেশে এক কোটি ২০ লাখ ৫৬ হাজার ৪৫৯ জনকে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়।
তুলনামূলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশে জানুয়ারি মাসে দেশে নভেম্বরের তুলনায় এক দশমিক ৮২ শতাংশ ও ডিসেম্বরের তুলনায় দুই দশমিক ৯৭ শতাংশ বেশি ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়েছে।
কর্তৃপক্ষ যা বলছে
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, সরকার সফলতার সঙ্গে ভ্যাকসিন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এখন সারা দেশে বাদ পড়া সবাইকে খুঁজে বের করে টিকাদান কার্যক্রম চলছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের ভ্যাকসিন ডেপ্লয়মেন্ট কমিটির সদস্য সচিব ডা. শাসমুল হক বলেন, টিকাদানের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। ইতোমধ্যে টিকাদান কার্যক্রম বিভাগ, জেলা, উপজেলা এমনকি তৃণমূল পর্যায়ের কমিউনিটি ক্লিনিকেও পৌঁছে গেছে। এ কার্যক্রমে গতি বেড়েছে। দেশে এখন পর্যন্ত ২৪ কোটি ভ্যাকসিন এসেছে। পাঁচ কোটি ভ্যাকসিন এখনো মজুত রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘সরকার সবাইকে ভ্যাকসিন দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। আমরা সেই অনুযায়ী কাজ করে যাচ্ছি। মূলত জানুয়ারি মাসে যে পরিমাণ ভ্যাকসিন দেওয়া হয়েছে তা আমাদের সক্ষমতারই প্রমাণ দেয়। আমরা আরও দ্রুত নতুন পরিকল্পনা নিয়ে দেশের সকল জনগোষ্ঠীর মাঝে ভ্যাকসিন পৌছাতে চাই। যেসব স্থানে এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিন দেওয়ার হার কম সেগুলোকেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে টিকাদান কর্মসূচির চালিয়ে যেতে চাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা ধাপে ধাপে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। সর্বশেষ আমরা ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিন প্রয়োগ করেছি। যারা এখন পর্যন্ত কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারেনি বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে গেছে তাদের মতন ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশু-কিশোরদের আমরা ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসব। পাঁচ থেকে ১১ বছর বয়সী শিক্ষার্থীদের বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যদি কোনো পরামর্শ দেয় তবে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কাজ করে যাবো। আমাদের সকল ধরণের প্রস্তুতি আছে।’
ভ্যাকসিন কর্মসূচি যেসব এলাকায় একটু শ্লথগতিতে আছে সেখানেও আমরা গতি বাড়ানোর চেষ্টা করে যাবো। সেসব এলাকার প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এ বিষয়ে- যোগ করেন ডা. শামসুল হক।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
কোভিড-১৯ মোকাবিলায় জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো. সহিদুল্লা সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রমের প্রভাব পড়েছে সংক্রমিতদের মৃত্যু হারে। একইসঙ্গে যারা সংক্রমিত হচ্ছে তাদের মৃত্যুঝুঁকি কমেছে। তবে এরপরেও রিল্যাক্স হওয়ার কোনো উপায় নাই। আত্মতুষ্টিতে না ভুগে সবাইকে কাজ করে যেতে হবে। সেইসঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। সবাইকে ভ্যাকসিন নিতে হবে যদি আমরা এই মহামারীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চাই তো।’
স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘জানুয়ারিতে সংক্রমণ শনাক্তের হার বাড়লেও এখন কিছুটা নেমে আসছে। আমাদের দেশে মৃত্যুর সংখ্যাও কিন্তু এবার কম ছিল। মূলত ভ্যাকসিন একটা প্রভাব ফেলেছে এক্ষেত্রে।’
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যকরী সদস্য ডা. মোশতাক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশে ভ্যারিয়েন্ট যাই আসুক না কেন, ভাইরাস থেকে নিজেকে নিরাপদে রাখতে হলে সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। একইসঙ্গে হাত ধোয়ার অভ্যাস চালু রাখতে হবে। মাস্ক না পরে যদি ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে কেউ দুশ্চিন্তা করে, তবে লাভ কী! কেউ যদি ভাইরাসকে নিজের কাছে প্রবেশের সুযোগ না দেয়, তাহলে ভাইরাসের পক্ষে কাউকে আক্রান্ত করা সম্ভব না। সে কারণেই স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, মাস্ক পরতে হবে। একইসঙ্গে ভ্যাকসিন নিতে হবে। ভ্যাকসিন একদিকে যেমন সংক্রমণের ঝুঁকি কমাবে, অন্যদিকে সংক্রমিতদের হাসপাতালে যাওয়ার সংখ্যাও কমাবে।’
সারাবাংলা/এসবি/একে