সাগর-রুনি হত্যার ১০ বছর— ‘খুনিরা কি সরকারের চেয়েও প্রভাবশালী?’
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০০:০৬
ঢাকা: ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। ভোরে পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় মানুষের ভিড়। পাওয়া গেছে ওই বাসার বাসিন্দা সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি দম্পতির ক্ষত-বিক্ষত মরদেহ। এই দম্পতির একমাত্র সন্তান মাহির সারোয়ার মেঘের বয়স তখন মাত্র সাড়ে পাঁচ বছর। এরপর দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেল ১০ বছর। মেঘ এখন সাড়ে ১৫ বছর বয়সের কিশোর। বিচার চাইতে চাইতে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন রুনির মা। কিন্তু বিচার মেলেনি সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যার।
বিচার তো দূরের কথা, এখনো আদালতে তদন্ত প্রতিবেদনই জমা দিতে পারেননি তদন্ত কর্মকর্তারা। একের পর এক তদন্ত কর্মকর্তা বদলে গেছেন। আদালতে ৮৫ বার পেছানো হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ। কিন্তু প্রতিবেদন দেবেন কী, তদন্ত কর্মকর্তারা নাকি মামলার ‘ক্লু’-ই খুঁজে পান না!
তদন্ত কর্মকর্তাদের এমন পরিস্থিতি সত্ত্বেও সাগরের মা সালেহা মনির এখনো সন্তানের বিচারের আশা ছাড়ছেন না। তার কথা— ‘মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত সন্তানের হত্যার বিচারের আশা ছাড়ব না।’ সরকারের বিভিন্ন মহলের আশ্বাসের পরও সাগর-রুনি হত্যা রহস্য উদঘাটন না করার পেছনে অন্য কিছু রয়েছে কি না, সেই প্রশ্নও তার— ‘খুনিরা কি সরকারের চেয়েও প্রভাবশালী?’
আরও পড়ুন- সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত: ৮৫ বারেও জমা হলো না প্রতিবেদন
শুক্রবার (১১ ফেব্রুয়ারি) বহুল আলোচিত সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের ১০ বছর পূর্ণ হচ্ছে। ১০ বছর আগের এই দিন ভোরেই পশ্চিম রাজাবাজারের বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর ও এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রুনির মরদেহ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সরকারের বিভিন্ন মহলের আশ্বাস ছিল, যত দ্রুতসম্ভব এই হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের খুঁজে বের করা হবে। বিচার নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু ১০ বছর পেরিয়ে এসেও বলতে গেলে এই হত্যাকাণ্ডে দায়ের করা মামলার তদন্তের অগ্রগতি কিছুই হয়নি।
আদালত সূত্র বলছে, ১০ বছরে এখন পর্যন্ত ৮৫ বার সময় নিয়েও সাগর-রুনি হত্যার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি তদন্তের দায়িত্বে থাকা র্যাব। এই সময়ে পাঁচ বার বদল করা হয়েছে তদন্ত কর্মকর্তা। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয়নি।
সবশেষ গত ২৪ জানুয়ারি মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য তারিখ নির্ধারণ করা ছিল। ওই দিনও মামলার তদন্ত সংস্থা র্যাব প্রতিবেদন দাখিল করেনি। পরে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তরিকুল ইসলামের আদালত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারি নতুন আরেকটি তারিখ ঠিক করে দেন।
সাগরের মা সালেহা মনির সারাবাংলাকে বলেন, ১০ বছর তো হয়েই গেল। আর কত! এখনো সন্তান হত্যার বিচার পেলাম না। কেন তাদের খুন করা হলো, সেটা পর্যন্ত জানতে পারলাম না। দিন-মাস-বছর যায়, কিন্তু তদন্ত শেষ হয় না। একের পর এক তদন্ত কর্মকর্তা আসে। আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এরপর আবার তদন্ত কর্মকর্তা বদলে যায়। কিন্তু মামলার অগ্রগতি হয় না। সবই যেন আইওয়াশ।
ছেলেকে হারানো এই মায়ের জন্য গত ১০ বছরের প্রতিটি দিনই ছিল যন্ত্রণাময়। বিশেষ করে সন্তানকে কেন হারাতে হয়েছে, সেটি জানতে না পারাটা আরও বেশি বেদনাদায়ক তার কাছে। তিনি বলেন, র্যাব তো অনেক ক্লুলেস হত্যার রহস্য উদঘাটন করছে। কিন্তু এই মামলায় কিছুই করতে পারছে না। তাদের হাত-পা বাঁধা? ছেলেকে গুলি করে বা দুর্ঘটনায় মেরে ফেললেও এত কষ্ট পেতাম না। কিন্তু কেন আমার ছেলেটাকে খুন করল, সেটাই তো জানতে পারলাম না! কেনই বা সেই রহস্য র্যাব উদঘাটন করতে পারছে না? খুনিরা কি সরকারের চেয়েও প্রভাবশালী?
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছেলে হত্যার বিচারের দাবি ছাড়বেন না বলেই জানালেন সালেহা মনির। তিনি বলেন, বিচার চেয়ে যাব। আশা ছাড়ব না। মরার আগে খুনিদের দেখে যেতে যাই। তাদের কাছে জানতে চাই, কেন তারা আমার বুক খালি করল? কী অপরাধ ছিল আমার ছেলের? তবে দুনিয়াতে যদি বিচার না-ই পাই, আল্লাহর কাছে বিচারের দায়িত্ব সঁপে দিলাম।
আদালতের কর্মকর্তারা বলছেন, কোনো মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য এত সময় নেওয়া হয়, এমনটি তাদের অভিজ্ঞতায় আর নেই। এত আলোচিত একটি মামলাতে কেন এক দশকেও তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হলো না, সেটি নিয়ে তাদেরও প্রশ্নের শেষ নেই।
চাঞ্চল্যকর হলেও এই মামলার তদন্ত নিয়ে সংশ্লিষ্টরা তৎপর নন বলেই অভিযোগ মামলাটির বাদী নিহত রুনির ছোট ভাই নওশের আলম রোমানের। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, বোনকে হারানোর ১০ বছর হয়ে গেল। বিচার দূরের কথা, কী কারণে এবং কারা খুন করেছে— সেটাই তো জানতে পারলাম না। তদন্তই শেষ হচ্ছে না। সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিষয়টি নিয়ে তৎপর না। আমরা চাই, মামলার সুষ্ঠু তদন্ত হয়ে প্রকৃত অপরাধীরা বের হয়ে আসুক।
মেয়েকে হত্যার বিচার না পেয়েই রুনির মা চিরবিদায় নিয়েছেন— সেটি নিয়েও আক্ষেপ জানালেন নওশের রোমান। বললেন, মায়ের আশা ছিল সন্তানের হত্যাকারীদের বিচার দেখবেন। তা আর পারলেন কই। পরে তো সেই আক্ষেপ নিয়ে আমাদের ছেড়ে চলেই গেলেন।
এদিকে, আসামিপক্ষের আইনজীবীরাও দ্রুত মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল চান। তারা বলছেন, মামলার তদন্ত শেষ না হলেও আসামিদের আদালতে হাজিরা দিতে হচ্ছে। তদন্ত শেষে বিচার হলে তারা অপরাধী হলে সাজা পাবেন, না হলে খালাস পাবেন। কিন্তু তাদেরও দিনের পর দিন হাজিরা দিয়েই যেতে হচ্ছে। দ্রুত তদন্ত শেষে বিচার হলে অন্তত নিরপরাধ মানুষগুলো হয়রানি থেকে মুক্তি পাবেন বলে বলছেন আইনজীবীরা।
২০১২ সালে সাগর-রুনির মরদেহ উদ্ধারের পর রুনির ভাই মামলা দায়ের করেন। ওই বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি মামলাটি তদন্তের জন্য প্রথম ডিবি উত্তরের পুলিশ পরিদর্শক মো. রবিউল আলমকে তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হয়। পরে মামলাটি তদন্তের ভার পায় র্যাব। একে একে বদলে গেছেন আরও চার তদন্ত কর্মকর্তা। কিন্তু মামলার তদন্তের ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি।
আদালতের তথ্য বলছে, ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ও ৭ জুন, ২০১৬ সালের ২ অক্টোবর এবং সবশেষ ২০১৭ বছরের ২১ মার্চ এই মামলায় তদন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করা হয় আদালতে। কিন্তু অগ্রগতি সংক্রান্ত প্রতিটি প্রতিবেদনে প্রায় একই ধরনের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে হত্যা রহস্য বা এ সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো তথ্যই নেই।
মামলার আট আসামির দু’জন পশ্চিম রাজাবাজারের ওই বাড়ির দারোয়ান পলাশ রুদ্র পাল ও সাগর-রুনির বন্ধু পরিচয় দেওয়া তানভীর রহমান জামিনে আছেন। বাকি ছয় আসামি মিন্টু ওরফে বারগিরা মিন্টু, বকুল মিয়া, কামরুল হাসান অরুন, রফিকুল ইসলাম, এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবিল ও আবু সাঈদ কারাগারে রয়েছেন। সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার আট জনের কেউই এখন পর্যন্ত হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেননি।
মামলায় সাগর-রুনির ভাড়া বাসার নিরাপত্তা প্রহরী এনামুল হক ও পলাশ রুদ্র পাল ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে ১৬১ ধারায় জবানবন্দি দেন। অন্যদিকে, ২০১৩ সালের আগস্ট মাসে রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মো. সাইদ, মিন্টু, কামরুল হাসান অরুণ ও তানভীর রহমান মহাখালীর বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণচন্দ্র হত্যার ঘটনায় র্যাব ও ডিবি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। এ মামলায় এ পর্যন্ত ১৫৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে র্যাব।
সারাবাংলা/এআই/টিআর
মেহেরুন রুনি সাগর সরওয়ার সাগর-রুনি হত্যা সাগর-রুনি হত্যা মামলা সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড