Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে বগুড়া ছিল মিছিলের শহর

আমজাদ হোসেন মিন্টু, বগুড়া
১১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৭:০২

বগুড়া: ভাষা আন্দোলনে বগুড়া শহর হয়ে উঠে মিছিলের শহর। ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই উত্তরবঙ্গের শিল্পনগরী বগুড়া এতে সংশ্লিষ্ট ছিল। ভাষা আন্দোলনের অনেক জাতীয় নেতা তখন বগুড়ায় ছিলেন। সূচনালগ্নে বাংলা ভাষা গবেষক ও পুরোধা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’র মতো ব্যক্তিত্ব ছিলেন বগুড়ায়। তাই অপরিসীম গুরুত্বকে ধারণ করেই বগুড়াতে শুরু হয় ভাষা আন্দোলন।

১৯৪৮ সাল থেকে মুসলিম জাতীয়তাবোধ ও সাম্প্রদায়িকতার নামে যখন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙলি জাতির স্বকীয়তা ও জাতীয়তাবোধকে খর্ব করার চেষ্টা করে তখন থেকেই পূর্ব বাংলার বাঙালিদের মধ্যে বিক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। এই বিক্ষোভকে সংগঠিত ও সঠিকখাতে প্রবাহিত করার জন্য বগুড়ায় ভূমিকা রাখে পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক শাখা। এই ভূমিকা রাখতে গিয়ে পার্টি সরকারের কঠোর দমননীতির মুখে পড়ে। তাই নেতারা আত্মগোপন স্থান থেকে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে থাকেন। তারা তাদের শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য পার্টি প্রভাবিত প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি, অনুসারী, সাহিত্য-সংস্কৃত কর্মী, ছাত্র, শিক্ষক, যুবক শ্রমিকদের সক্রিয় করে তোলেন।

বিজ্ঞাপন

ছাত্র-শিক্ষক ও সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনে এ সময় সক্রিয় ভূমিকা রাখে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ‘ছাত্র’ ফেডারেশন ও বগুড়া আজিজুল হক কলেজের ছাত্র-শিক্ষকরা। ১৯৪৮ সালে এ কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি এই তৎপরতায় সম্পৃক্ত ছিলেন। আজিজুল হক কলেজের প্রগতিশীল শিল্প-সাহিত্যমনা ছাত্র-শিক্ষক ও কলেজের বাইরে আরও যারা সচেতন ব্যক্তি ছিলেন তারাই প্রথম বগুড়ায় ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান। এই আন্দোলনের জন্য প্রথম দিকে কোন কমিটি গঠন করা না হলেও উদ্যোক্তাদের মিলিত প্রচষ্টায় কর্মতৎপরতা চলতে থাক। বছরের মাঝামাঝি সময়ের দিকে ভাষা আন্দোলনে কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়।

বিজ্ঞাপন

১৯৪৮ এর ফেব্রুয়ারি মাসে ‘ছাত্র ফেডারেশন’-এর উদ্যাগে এবং কমিউনিস্ট পার্টির ছত্র-ছায়ায় বগুড়াআজিজুল হক কলেজ থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। এ মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন ছাত্র ফেডারেশন নেতা ও সাহিত্য কর্মী মুহম্মদ আব্দুল মতীন। মিছিলটি সড়ক পথ ধরে বগুড়া শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথায় পৌঁছুলে মুসলিম লীগের নেতা ও সমর্থকরা হামলা চালায়। হামলার নেতৃত্বে ছিল মুসলিম লীগ নেতা আব্দুল হামিদ খান। এ সময় মিছিলের নেতা আব্দুল মতীনসহ বেশ কয়েকজন গুরুতভাবে আহত হন। বগুড়ায় এটাই ছিল ভাষা আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রথম আঘাত।

১১ মার্চ ছাত্র-জনতার মিছিল বগুড়া আজিজুল হক কলেজ থেকেবের হয়ে শহরের দিকে যাত্রাকালে অধ্যক্ষ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর সামনে পড়ে যান। ছাত্ররা তাকে মিছিলের নেতৃত্ব দিতে অনুরোধ করলে তিনি তা গ্রহণ করেন। পরে মিছিল শেষে বগুড়া জেলা স্কুল ময়দানে আয়োজিত সমাবেশে তিনি সভাপতিত্ব করেন এবং বাংলা ভাষার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন।

১৯৪৮ সালের ২৯ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের বগুড়া সফরকে কেন্দ্র করে অবাঙালি জেলা প্রশাসক আব্দুল মজিদের হঠকারিতায় এক প্রচণ্ড ছাত্র বিক্ষোভ হয়। তৎকালীন ছাত্রনেতা গোলাম রহমান (দিনাজপুর) নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন। নভেম্বর-ডিসেম্বরে ছাত্র বিক্ষোভে বাধা প্রদানকারী ছিল জেলা প্রশাসক ও শাহ আজিজপন্থী সরকার সমর্থক ছাত্রদল। এদের আক্রমণে মারাত্মকভাবে আহত হন জননেতা মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশের পুত্র এস,এম নূরুল আলম (সুপ্রীম কোর্টের অ্যাডভোকেট), ১৯৪৮ সালের শেষ দিকে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্রনেতা বগুড়াবাসী গোলাম মো. মহিউদ্দিন ও আবুল ফজল সিদ্দিকী, নূর মোহাম্মদ খান (পরে আজিজুল হক কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত হন)।

১৯৪৮ সালের প্রধান ঘটনাপ্রবাহে অংশগ্রহণ করে যারা ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছেন তারা হলেন- (১) আতিউর রহমান (বগুড়া সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহবায়ক, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য)। তিনি আজিজুল হক কলেজের বি এ ক্লাসের ছাত্র ছিলেন। (২) অধ্যাপক গোলাম রসুল, (৩) ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (৪) মুহাম্মদ আবদুল মতীন, (৫) অধ্যাপক আবুল খায়ের (৬) অধ্যাপক প্রিথিশ দত্ত (৭) আতাউর রহমান (৮) গাজীউল হক (তিনি তখন আজিজুল কলেজের ছাত্র ছিলেন)। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত একুশের স্মৃতিচারণ ১৯৮০ গ্রন্থে বগুড়ায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে গাজীউল হকের অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু গোলাম মহিউদ্দি ১৯৮৮ বিচিত্রা’য় (একুশের বিশেষ সংখ্যা) গ্রন্থটিতে গাজীউলহকের অংশ গ্রহণেরকথা অস্বীকার করেন। (৯) গোলাম মহিউদ্দিন (বাদুড়তলা, বগুড়া), (১০) জালাল উদ্দিন আকবর (১১) নাজির হোসেন (১২) সাত্তার (১৩) তরিকুল খান (১৪) নূরুল হোসেন মোল্লা (১৫) ইবনে মিজান (১৬) শ্যামাপদ সেন (১৭) কবিরাজ মতিয়ার রহমান প্রমুখ।

১৯৪৮ সালে বগুড়ায় যে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল, ১৯৪৯ সলে এসে তা অনেকটা বাধাগ্রস্ত হয়। এ বছরের প্রথম দিকে আজিজুল হক কলেজের ছাত্র-শিক্ষকসহ বিভিন্ন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীবৃন্দ, বিড়ি শ্রমিক এবং সাহিত্য সাংস্কৃতিক কর্মীরা আন্দোলনকে বেগবান রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আবার একটি মিছিলের আয়োজন করা হয়। ছাত্রলীগ নেতা আবদুস শহীদের নেতৃত্বে আজিজুল হক কলেজ থেকে মিছিলটি বেরিয়ে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ শুরু করে। দ্বিতীয় বারের মতো মুসলিম লীগ ও অবাঙালিরা মিছিরে ওপর লাঠিসোটা নিয়ে হামলা চালায়। এর আগেই পাকশাসকদের এই দোসররা আন্দোলন দমনে তৎপর হয়ে ওঠে। মিছিলের নেতা আবদুস শহীদ, ভি, এম স্কুলের ছাত্রীনেত্রী সালেহা বেগমসহ কয়েকজন মিছিলকারী হামলায় আহত হন।

পাক শাসকদল মুসলিম লীগ বুঝেছিল যে, তাদের শোষণ-শাসন ও ষড়যন্ত্রের জাল থেকে মুক্তির জন্য গড়ে উঠেছে আন্দোলন, তৈরি হচ্ছে প্রতিরোধ। তাই তারা বাঙালি জাতীয়তাবোধভিত্তিক এই গণবিক্ষোভকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। তারা এ লক্ষ্যে গড়ে তোলা দুর্ধর্ষ বাহিনী সৃষ্টি করে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা ও দাঙ্গা, দমন অভিযান শুরু করে আন্দোলনের মূল শক্তি কমিউনিস্ট পার্টির ওপর। বছরের মাঝামাঝি দিক থেকে এই তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। শাসকচক্রের এই তৎপরতায় অংশ নেয় পুলিশ বাহিনী, গোয়েন্দা বিভাগ এবং অবাঙালিরা। দমন অভিযানের ফলে কমিউনিস্ট পার্টি নেতারা আত্মরক্ষামূলক অবস্থান নিতে বাধ্য হন। তবে তার আন্দোলনকে পরিচালনার জন্য বিভন্ন পন্থা অবলম্বন করেন। বাংলা ভাষা ও জাতীয়তাবোধের দাবিকে সামনে রেখ গ্রামের কৃষক ও শহরের ছাত্র-শ্রমিক শিল্পী-সাহিত্যিকদের মধ্যে আন্দোলনের সাংগঠনিক ভিত্তিকে শক্তিশালী ও ব্যাপক বিস্তৃতকরণ শুরু হয়। এর ফলে বগুড়ায় ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্র শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শ্রমিক প্রতিষ্ঠান, পেশাজীবী প্রতিষ্ঠান, সাহিত্যমোদী অঙ্গন থেকে শুরু করে গ্রামের অত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামের তৎপরতায় আত্মগোপনীয়তাকারী নেতারা অংশ নেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তৎপরতায় অংশ নেন ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্রলীগ ও আজিজুল হক কলেজের ছাত্রনেতা-কর্মীরা। শ্রমিকদের মধ্যে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন শ্রমিক নেতা-কর্মীরা। শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী মহলের মধ্যেও তৎপরতা অব্যাহত থাকে। শহরের আন্দোলনে ছাত্র ও বিড়ি শ্রমিক নেতা বাদে শিল্পী সাহিত্যিকদর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তারা প্রায় প্রতিদিন আলোচনা সভা, সেমিনার, ভাষা প্রশ্নে বিতর্ক অনুষ্ঠান, গান, কবিতা, নাটকের মাধ্যমে সর্বস্তরে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব বিস্তার করেন। ১৯৪৯ সালে বগুড়ায় উডবার্ন পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তন, বাংলা স্কুল, টমসন হল প্রভৃতি স্থান ছিল এই সব সাহিত্য-সাংস্কৃতক অনুষ্ঠানের প্রাণকেন্দ্র।

ভাষা-সংস্কৃতির এই আন্দোলনে ভীতসস্ত্রস্ত পাকিস্তানি শাসক চক্র ওতাদের দোসররা মরিয়া হয়ে প্রতিরোধ তৎপরতায় অংশ হিসেবে বিভিন্ন স্তরে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। মুসলিম লীগকর্মী-সমর্থক এবং অবাালিদের (বিহারি) প্রশাসনিক ক্ষেত্র ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পূর্ণ আদিপত্য বিস্তারের জন্য এসবস্থানে নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়। গুণ্ডাবাহিনী তৈরি করে তাঁর ঘাঁটি স্থাপন করা হয় শহরের দত্তবাড়ি, লতিফপুর কলোজনী, গোহাইলসহ বেশ কয়েকটি স্থানে। এ কারণে ১৯৪৯ সালের মাঝামাঝির পরপর উত্থানমুখী ভাষা আন্দোলন অনেকটা বাধাগ্রস্ত হয়।

এরপর আসে ১৯৫০ সাল। ১৯৪৯-এর শেষ থেকে গোটা ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে চলে সরকারি বাহিনী ও শাসকদের অনুগত শক্তির ভয়াবহ দমননীতি। আন্দোলন দমনে সংগঠিত করা হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। মোটা ১৯৫০ সাল ধরে চালানো হয় এই দাঙ্গা। এ সময় মুসলিম লীগ সমর্থক ও বিহারিদের দ্বারা হতাহত হয় অগণিত আন্দোনমুখী মানুষ। লুন্ঠিত হয় বাঙালিদের সহায় সম্পদ, পুলিশ বাহিনীর তৎপরতায় গ্রেফতার হয় বিপুলসংখ্যক ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-শিল্পী-সাহিত্যিক নেতা-কর্মী। বগুড়ায় বহু কমিউনিস্ট নেতা-কর্মী গ্রেফতার হন। বাকিরা আত্মগোপনের জন্য অন্য অঞ্চলে চলে যেতে বাধ্য হন। গোয়েন্দাদের আনাগোনায় আন্দোলনের তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়। প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল আন্দোলনকারীই এই অবস্থায় হয় গাঢাকা দেন অথবা কারাবরণ করেন। এভাবেই কঠোর দমন নীতির মধ্য দিয়ে গোটা ১৯৫০ সাল কেটে যায়।

আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। স্তিমিত হয়ে যাওয়া আন্দোলনকে আবার পুনর্গঠিত করার জন্য ১৯৫১ সালে উদ্যোগ নেওয়া হয়। আন্দোলনের মূল পরিচালক হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টি পুনরায় সংগঠিত হয়। এবং নতুন উদ্যমে ভাষা সংস্কৃতির আন্দোলন নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে। তবে কমিউনিস্ট নেতা ও সক্রিয় কর্মীদের প্রকাশ্য তৎপরতায় বাধা ছিল বরে পার্টির নেতা-কর্মী হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত নয় এমন সংগঠকরা আওয়ামী লীগ, ছাত্র সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন ও শিল্পী-সাহিত্য গোষ্ঠীর ব্যানারে কাজ করতে থাকেন। এভাবে তাঁরা ভাষা আন্দোলনের ভিতরকে আবার সংগঠনিত ও বিকশিত করতে সক্ষম হন। এর ফলে অবস্থার গুণগত পরিবর্তন আসে।

১৯৫১ সালের মাঝামাঝি কমিউনিস্ট পার্টি একটি ‘কন্ট্রাক্ট কমিটি’ নিয়োগ করে। এ কমিটির কাজ ছিল, আন্দোলনকে একটি সর্বদলীয় আন্দোলনের রূপ দেওয়া এবং একটি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন। পার্টির এই কন্ট্রাক্ট কমিটির সম্পাদক ছিলেন প্রণব চৌধুরী এবং সদস্য ছিলেন মুহম্মদ আবদুল মতীন, মোখলেসুর রহমান ও শাহ আহমেদ। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে এ কমিটি বগুড়ায় ভাষা আন্দোলনের জন্য সর্বদলীয় কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পথে সফল হয়। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত হন ফুলবাড়ি কমিউনিস্ট পার্টি সদস্য মোখলেসুর রহমান, সুবোধ লাহিড়ী, আক্কেলপুরের ছমির উদ্দিন মণ্ডল, আবদুল খালেক মণ্ডল, হারুনর রশিদ, গোলাম মহিউদ্দিন, ছাত্রলীগ নেতা নূরুল হোসেন মোল্লা, আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতা আব্দুল আজিজ কবিরাজ, অ্যাডভোকেট আকবর হোসেন আকন্দ, মোশাররফ হোসেন মণ্ডল, আব্দুল ওয়াজেদ খলিফা, আবদুস শহীদ, ফজলার রহমান, হাবিবর রহমান, বিড়ি শ্রমিক নেতা শাহ আহমদ, ফজলার রহমান ভেলুপুর, জালাল উদ্দিন আকবর, আবদুল খালেক, আওয়ামী লীগ নেতা সিরাজ উদ্দিন আহমেদ, সাদেক আলী আহমদ প্রমুখেরওপর।

এই দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের দধ্য থেকে আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতারা মওলানা ভাসানী সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেন। অতপর ভাষা আন্দোলনের সর্বদলীয় সংগ্রম পরিষদ গঠন করার ক্ষেত্র তৈরির মধ্য দিয়ে ১৯৫১ সালের শেষ ভাগ থেকে শুরু হয় কাঙ্ক্ষিত আন্দোলন।

সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কমিটি বাস্তবায়নে দায়িত্বপ্রাপ্তদের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে কন্ট্রাক্ট কমিটি বা কমিউনিস্ট পার্টির আরেকটি লক্ষ্য ছিল, ‘নন কমিউনিস্টদের সামনে রাখো নীতিতে’ ভাষা আন্দোলনকে সর্বাত্মক রূপ দেওয়া। প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠীর অপপ্রচার থেকে আন্দোলনকে মুক্ত করা এবং আন্দোলনকে মুসলিম লীগ ও শাসকচক্র বিরোধী আন্দোলনে রূপ দেওয়া। উদ্যোক্তরা এতে সফল হন। ফলে ভাষা আন্দোলন পরবর্তীকালে শুধুমাত্র ভাষা সংস্কৃতি আন্দোলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং তা একটি গুণগত পরিবর্তনমুখী আন্দোলনের দিকে ধাবিত হয়।

এই প্রেক্ষাপটে ১৯৫২ সালের প্রথমদিকে আন্দোলন পরিচালনার জন্য একটি সর্বদলীয় কমিটি ঘোষণা জরুরি হয়ে পড়ে। এ লক্ষ্যে দায়িত্বপ্রাপ্তদের উদ্যোগে ১৭ ফেব্রুয়ারি সর্বস্তরের প্রতিনিধিদের নিয়ে এক সমাবেশের আয়োজন করা হয়। তারা আগেএকাধিকবার বিভিন্ন বৈঠক ও সভায় বিষয়টি উপস্থাপন করে। ইতোমধ্যে কমিটি ছাড়াই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, যুব সংগঠন, শ্রমিক ও সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠন রাজপথের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সর্বদলীয় কমিটির গঠনের পাঁচ দিন আগে ১২ ফেব্রুয়ার স্থানীয় অ্যাডওয়ার্ড পার্কে এক জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সভাপতি আতিউর রহমান মধ্যপ্রাচ্য দিবস পালনের জন্য এই সমাবেশ ডাকেন। সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কমিটি গঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত মুহম্মদ আবদুল মতীন, মোশাররফ হোসেন মণ্ডল, মোখলেসুর রহমান, নূরুল হোসেন মোল্লা, আব্দু রহিম সওদাগর, গোলাম মহিউদ্দিন, জালাল উদ্দিন আকবর, শেখ হারুনুর রশিদ, শাহ আহমদ প্রমুখ। সমাবেশে দুর্বর আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য সর্বস্তরের মানুষের প্রতি আহবান জানানো হয়। এই সভাতেও ভাষা আন্দোলন কমিটি গঠনের জন্য প্রতিনিধি পাঠাতে বিভিন্ন সংগঠনের প্রতি আহবান জানানো হয়।
১৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে বগুড়ার থানা রোড (বর্তমানে কবি নজরুল ইসলাম সড়কে) ছাত্রনেতা আবদুল শহীদের পিতা আব্দুল ওহাব খলিফার ত্রিতল বাসভবনের নিচতলার হল ঘরে বিপুলসংখ্যক প্রতিনিধি নিয়ে বৈঠক বসে। এতে রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন, যুব সংগঠন, শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষক, আইনজীবী, কৃষক, শ্রমিক প্রতিনিধিরা অংশ নেন। প্রতিনিধি সভায় প্রবীন রাজনীতিবিদ মজির উদ্দিন আহমেদকে সভাপতি, কৃষক নেতা আবদুল আজিজ কবিরাজকে সহ-সভাপতি এবং ছাত্রনেতা গোলাম মহিউদ্দিনকে আহবায়ক করে ১৭ সদস্য বিশিষ্ট সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি, বগুড়া শাখা গঠন করা হয়।

এই ভাষা কমিটি গঠনের দিন থেকে বগুড়া শহর পরিণত হয় মিছিলের শহরে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। সর্বদলীয় কমিটি নেতাদের নেতৃত্বে ঐদিনই বিশাল মিছিল বের করা হয় এবং তা বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি এইকমিটির আহবানে জেলা স্কুল ময়দানে বিশাল জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন কমিটির সহ-সভাপতি আব্দুল আজিজ কবিরাজ। সমাবেশে সকল থানায় ভাষা আন্দোলনকমিটি গঠনের আহ্বান জানানো হয়। ২১ ফেব্রুয়ারিই খবর আসে, ঢাকায় পুলিশের গুলিবর্ষণে অনেক আন্দোলনকারী হতাহত হয়েছেন। নিহতের মধ্যে বগুড়ার তৎকালীন ছাত্রনেতা গাজীউল হকও রয়েছেন বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রতিবাদে ছাত্র-জনতা জঙ্গি মনোভাব নিয়ে এদিন পূর্ণ দিবস হরতাল পালন করে এবং আলতাফুন্নেসা খেলার মাঠে বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গুলিবর্ষণ ও ছাত্র-হত্যার প্রতিবাদে বগুড়ায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করা হয়। হরতাল শেষে জনসমাবেশ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়, অনির্দিষ্টকালের জন্য বগুড়ার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। এরপর একটানা ১৮দিন সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়।

ঢাকায় গুলিবর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ২৩ ফেব্রুয়ারি জগন্নাথ মাঠে এক ছাত্র গণজমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন তরিকুল আলম খান। সমাবেশে ঢাকার ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে গুলিবর্ষণের তদন্ত দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি, হতাহতের পরিবারবর্গকে ক্ষতিপূরণ, গ্রেফতারকৃত ছাত্র-জনতার মুক্তি, মন্ত্রীসভার পদত্যাগ এবং রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি জানানো হয়। ওইদিনও সকাল থেকে দিনভর বগুড়াশহর ও গ্রামাঞ্চল প্রতিবাদ বিক্ষোভ মিছিল চলে। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ কমিটির ডাকে পরদিন ২৪ ফেব্রুয়ারি আবার সকাল সন্ধ্যা-হরতাল পালিত হয়। হরতালে সরকারী-বেরকারী অফিস-আদালত, শিল্প-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, যানবাহন, দোকানপাট, স্কুল-কলেজসহ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও ঢাকার ঘটনার বিচারের দাবিতে ঐদিন বগুড়া শহর থেকে ১০/১২ মাইল দূরবর্তী শেরপুরে জসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই জনসভার আয়োজন করেছেন খোদ মুসলিম লীগের বিক্ষুব্ধ অংশ। সভায় সভাপতিত্ব করেন মো. আলী আহমেদ।

এছাড়া এর আগর দিন বগুড়ার মেরিনা হলে (অধুনা লুপ্ত) জেলা মুসলিম লীগের এক কাউন্সিল অধিবেশনেও ঢাকায় গুলিবর্ষণের নিন্দা ও প্রাদেশিক মুসলিম লীগের নেতাদের কঠোর সমালোচনা করা হয়। অধিবেশনে বিক্ষুব্ধ কাউন্সিলদের চাপের মুখেই নেতারা এই ঘটনা সমালোচনা ও নিন্দা প্রস্তাব নিতে বাধ্য হন। ২৫ ও ২৮ ফেব্রুয়ারিতে সান্তার, ২৭ ফেব্রুয়ারি রাজারামপুরে পূর্ণ দিবস হরতাল, বিক্ষোভ ও জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

সান্তাহারে ডা. বছির উদ্দিন খানের সভাপতিত্বে বিকেল ৩ টায় ডাকবাংলো মাঠে পাঁচ সহস্রাধিক লোকের সমাগমে জনসভা হয়। রাজারামপুরে ফুটবল খেলার মাঠে সমাবেশের আয়োজন করা হয়। এসব স্থান ছাড়াও বগুড়ার গ্রামগঞ্জে বাংলা ভাষার দাবিতে এবং ঢাকায় গুলি ও হত্যার প্রতিবাদে ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে সভা, সমাবেশ, মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। এক কথায় গোটা বগুড়া আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

বগুড়ায় বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতি বিরোধী রাজনৈতিক দল বলতে ছিল মুসলিম লীগ। কাজেই রাজনৈতিক ছাড়াও প্রশাসনিকভাবে ভাষা আন্দোলনের বিরোধী ছিল এ দল। অবশ্য বাঙালি অধ্যুষিত পূর্ব বাংলার অংশ হিসেবে বগুড়ার প্রশাসনে বাঙালিদের ক্ষীণ আকারের সমর্থক ছিল। মুসলিম লীগাররা তাই প্রশাসন থেকে এসব বাঙালি অপসারণ করে কট্টর মুসলিম লীগ সমর্থক বা বিহারিদের পুনর্বাসিত করার কাজ চালায়। এতে প্রশাসনিক দপ্তরগুলো হয়ে ওঠে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিবিরোধী। সরকারি দপ্তর ছাড়াও বেসরকারি দপ্তরগুলোতে একই কায়দায় শাসকগোষ্ঠী ভাষা আন্দোলন বিরোধীদের পুনর্বাসিত করার চেষ্টা চালায়। এছাড়া ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান দখল করার জন্যও তারা তৎপরতা চালায়। সামাজিক ক্ষেত্র যেমন, স্কুল, কলেজ, ক্লাব, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মাদ্রাসা প্রভৃতিস্থানেও তারা তাদের প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টা করে। এসবই করা হয় শরণার্থী হিসেবে আগত অবাঙালিদের পুনর্বাসিত করার দিক খেয়াল রেখে। এ তৎপরতা যখন ব্যর্থ হয়, তখন মুসলিম লীগ তার গুন্ডা বাহিনী ও পুলিশ প্রশাসনকে লেলিয়ে দিয়ে আন্দোলনকারীদের উপর কঠোর দমননীতি চালায়। ১৯৫২ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি গোলাম মহিউদ্দিন, শেখ হারুন উর-রশীদ, সুবোধ লাহিড়ী, আবদুল মতীন ও ছমির মণ্ডলকে রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়।

অপরদিকে ভাষা সংস্কৃতির আন্দোলন ও প্রতিক্রিয়াশীল শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী মূল দল ছিল (১৯৪৭ পরবর্তী) বগুড়ায় ‘পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি, পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক শাখা, বগুড়া। এই পার্টির সমর্থকদের দ্বারাই পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়ন গঠিত হয়। পরবর্তীকালে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এদের নিয়ে কমিটি গঠিত হয়। ভাষা আন্দোলনকারী এই দলগুলোর ভুমিকা ছিল শাসক মুসলিম লীগ চক্রের অপপ্রচার ও ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতার বিরুদ্ধে পাল্টা কার্যক্রম চালানো, জনমত গড়ে তোলা, জনগণকে সচেতন করে তোলা এবং তাদের রাজপথের আন্দোলনে সামিল করে দাবি আদায়ের ক্ষেত্র রচনা করা। ব্যাপক দমননীতির মুখে পড়েও যে তারা সাফল্য অর্জন করেছ তার প্রমাণ মেলে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বগুড়ার বিস্ফোরণোম্মুখ অবস্থা থেকে। বগুড়ায় প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয় ১৯৫৩ সালে। এটি স্থাপিত হয় আলতাফুন্নেছা খেলার মাঠে। এর পরপরই আরও দুটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। এর একটি এডওয়ার্ড পার্কে এবং অপরটি শহরের মূল কেন্দ্র সাতমাথায়। কিন্তু ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তিনটি শহীদ মিনারের উপরই হামলা চালিয়ে তা ভেঙে গুড়িয়ে দেয়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নতুন করে শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। রাজনৈতিক ও দেশপ্রেমিক জনতার দাবি অনুযায় বগুড়া পৌরসভা শহীদ মিনার নির্মাণের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এই দায়িত্ব পালিত হয় স্বাধীনতার প্রায় ১০ বছর পর। ১৯৮২-৮৩ অর্থ বছরে বগুড়া পৌরসভার অর্থে এই শহীদ মিনার নির্মিত হয় শহীদ খোকন পার্কে। এটিই আজ বগুড়ার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। এটি নির্মাণে পৌরসভার খরচ হয় ১ লক্ষ ৮০ হাজার টাকা। এর নকশা প্রণয়ন ও সামগ্রিক নির্মাণ কাজ তত্ত্বাবধায়ন করেন বগুড়ার কৃতি শিল্পী (অধুনালুপ্ত কারুপল্লীর স্বত্ত্বাধিকারি) আমিনুল করিম দুলাল। এই শহীদ মিনারের দেয়ালে যে চিত্র (ম্যুরাল) রয়েছে, তা করেন দুলাল নিজ হাতে। দেয়াল চিত্রে মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ঐতিহাসিক ৬ দা আন্দোলন, সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৮-৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের চিত্র খোদাই করা ছিল। এই মিনায় প্রকল্পের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন পৌর কমিশনার মোখলেছুর রহমান রেডিও এবং নির্মাণকালে পৌর চেয়ারম্যান ছিলেন অ্যাডভোকেট জহুরুল ইসলাম। (এখানে উল্লেখ্য যে, বগুড়ার নন্দিত শিল্পী আমিনুল আরিম দুলাল-এর নান্দনিক শিল্পকর্ম সংবলিত শহীদ মিনারটি বিগত জামাত-বিএনপি জোট সরকার ভেঙে ফেলে বর্তমান শহীদ মিনারটি নির্মাণ করে। যা বগুড়ার সুধি মহলে অসন্তোষের সৃষ্টি করেছেন।) বগুড়ায় ১৯৪৮-১৯৫২ পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনে যারা অংশ নিয়েছেন তাঁদের মধ্য রয়েছেন সাধারণ ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, চিকিৎসক, আইনজীবী, পেশাজীবী শ্রেণীর মানুষ। এঁরা সবাই ভাষা সৈনিক। কারণ এমন অনেক নেতা রয়ে গেছেন, যারা বগুড়ায় ভাষা আন্দোলনের স্থপতি ও রূপকার অথচ তারা শাসকচক্রের দমননীতি ও হুলিয়ার কারণে ‘আন্ডার গ্রাউন্ডে’ থাকতে বাধ্য হয়েছেন। ফলে যারা প্রকাশ্য ভূমিকা নিয়েছেন তাঁদের পরিচিতির মত এই সব নেপথ্য নেতাদের তেমন পরিচিতি জনসাধারণ বা আন্দোলনকারী সাধারণ মানুষের মধ্যে ঘটেনি। অথচ এই নেপথ্য, নেতারাই ছিলেন আন্দোলনের পরিচালক, রক্ষক এবং শক্তি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের স্মৃতি থেকে সংগৃহীত বিবরণ অনুযায়ী বগুড়ায় ভাষা আন্দোলনে যারা মুলত নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় পর্যন্ত আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ), অধ্যাপক গোলাম রসুল, মুহম্মদ আব্দুল মতীন (কমিউনিস্ট পার্টি), গাজীউল হক (আজিজুল হক কলেজের ছাত্র নেতা, আন্দোলনের প্রথমদিকে তিনি বগুড়ায় ছিলেন পরে ঢাকা চলে যান), অধ্যাপক আবুল খায়ের, অধ্যাপক প্রিথিশ দত্ত, কবি আতাউর রহমান, জালাল উদ্দিন আকবর, নাজির হোসেন, আবদুস সাত্তার, তরিকুল আলম খান, ইবনে মিজান, শ্যামাপ্রদ সেন, কবি রাজমতিয়ার রহমান, আবদুস শহীদ (ছাত্রলীগ নেতা, সালেহা, বেগম, প্রণব চৌধুরী (কমিউনিস্ট পার্টি), সুবোধ লাহিড়ী (কমিউনিস্ট পার্টি), মীর শহীদ মণ্ডল (কমিউনিস্ট পার্টি), আবদুল খালেক মণ্ডল, হারুনর রশীদ (কমিউনিস্ট পার্টি), গোলাম মহিউদ্দিন, নূরুল হোসেন মোল্লা (ছাত্রলীগ নেতা), আব্দুল আজিজ কবিরাজ (আওয়ামী লীগ), অ্যাডভোকেট আকবর হোসেন আকন্দ, মোশাররফ হোসেন মন্ডল (কমিউনিস্ট পার্টি), আব্দুল ওয়াজেদ খলিফা, ফজলার রহমান, হাবিবর রহমান, শাহ আহমেদ (বিড়ি শ্রমিক নেতা), ফজলার রহমান ভেলুপুরি, সিরাজ উদ্দিন আহমেদ (আওয়ামী লীগ), সাদেক আলী আহমেদ, আদক মোক্তার, আতিউর রহমান (আওয়ামী লীগ), আব্দুর রহিম সওদাগর, মজির উদ্দিন আহমেদ, মো. সুলতান এমএ নূরুল আলম, হাবিবুর রহমান শেলী প্রমুখ। মহিলাদের মধ্যে নেতৃত্ব দেন রহিমা খাতুন ও সালেহা খাতুন (পরে সালেহা চক্রবর্তী)।

সারাবাংলা/একে

বগুড়া ভাষা ভাষা আন্দোলন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর