Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ল্যাব ও অনুমোদন ছাড়াই চলছে নমুনা সংগ্রহ

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ২৩:১৪

ঢাকা: স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না থাকলেও বিদেশগামীদের নমুনা পরীক্ষাও করানো হচ্ছে বাসায় গিয়ে। নিজস্ব ল্যাব ও নমুনা সংগ্রহের অনুমোদন না থাকলেও প্রায় প্রকাশ্যেই নানা রকম মূল্য ছাড়ের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে চলছে নমুনা সংগ্রহ কার্যক্রম। স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, বিদেশগামীদের নমুনা বাসায় গিয়ে সংগ্রহের কোনো সুযোগ নেই। একইসঙ্গে অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান বাদে অন্য কাউকেই নমুনা সংগ্রহের কোনো অনুমতি দেওয়া হয়নি। আর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কিটের দাম কমলেও এখন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে করোনার নমুনা পরীক্ষার মূল্য কমানো হয়নি। আর এই সুযোগে মধ্যস্বত্ত্বভোগী কিছু প্রতিষ্ঠান এই ধরনের সুযোগ নিচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

বাসায় গিয়ে বিদেশগামীদের নমুনা পরীক্ষার প্রতিশ্রুতি

‘হেলথপোর্ট বাংলাদেশ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বুস্ট করা একটি বিজ্ঞাপন দিয়ে জানায়, হেলথপোর্টের মাধ্যমে ঘরে বসে কোভিড টেস্ট করুন ১০% ছাড়ে। আমাদের কোভিড টেস্ট রিপোর্ট সকল এয়ারলাইন্স গ্রহণ করছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নির্ভুল ডায়াগনস্টিক রিপোর্ট ডেলিভারিও পেয়ে যাবেন ঘরে বসে।

৯ ফেব্রুয়ারি গ্রাহক সেজে প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যোগাযোগ করেন এই প্রতিবেদক। আরেক সামাজিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপে প্রতিবেদককে জানানো হয়, বাসায় বসে নমুনা সংগ্রহের খরচ ৫০০ টাকা। এছাড়া নমুনা পরীক্ষার খরচ হবে তিন হাজার ২০০ টাকা। বিদেশগামীদের জন্য দুই হাজার ৭০০ টাকায় নমুনা পরীক্ষা করানো হয়ে থাকে। একজন বিদেশগামীসহ সর্বমোট চারজন ব্যক্তির নমুনা পরীক্ষার খরচ হবে ১১ হাজার ১০০ টাকা। যারা নমুনা পরীক্ষা করাবেন তাদের নাম ও বিস্তারিত বিষয়ে জানিয়ে প্রতিবেদককে কিছু তথ্য জানানোর জন্য বলা হয়।

একইসঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে হেলথ পোর্ট কর্তৃপক্ষ জানায়, প্রতিষ্ঠানটি রাজধানীর ডিএমএফআর মলিউকুলার ল্যাব অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সাহায্যে নমুনা পরীক্ষা করিয়ে থাকে। ১১ ফেব্রুয়ারি নমুনা সংগ্রহ করা হবে বলেও জানানো হয় ওইদিন।

তবে ১১ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদক গণমাধ্যমকর্মী পরিচয় দিয়ে কথা বললে তখন জানানো হয়, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী আজ থেকে বিদেশগামীদের বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহ বন্ধ রাখা হয়েছে। শুধুমাত্র নরমাল কোভিড টেস্টের জন্য বাসায় লোক পাঠাতে পারবে।

প্রতিবেদকের পরিচয় জেনে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা নাদিরুল সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি এখানে নতুন এসেছি। তাই কিছু বলতে পারছি না।’ বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহের অনুমতি আছে কি না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সেটাও আমি বলতে পারছি না।’ নিজস্ব কোনো ল্যাব আছে কি না? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, আমাদের নিজস্ব কোনো ল্যাব নেই। আমরা অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে নমুনা পরীক্ষা করায়ে দিই।’ এক্ষেত্রে অন্য প্রতিষ্ঠানকে কত ভাগ লভ্যাংশ দেওয়া হয়? জানতে চাইলে নাদিরুল বলেন, ‘এ বিষয়ে আসলে আমি বিস্তারিত বলতে পারছি না।’ তবে ডিএমএফআর মলিকুলার ল্যাবের প্রধান মানব সম্পদ উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. ফিরোজ আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা বাইরে এভাবে কারও নমুনা পরীক্ষা করাই না।’

বিজ্ঞাপন

থাইরোকেয়ার বাংলাদেশ লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একইভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিজ্ঞাপন দেখে যোগাযোগ করা হয়। তারা জানায়, গ্রিন ক্রিসেন্ট হেলথ সার্ভিসেসের সাহায্যে তারা নমুনা পরীক্ষা করান। এক্ষেত্রে তারাই বাসা থেকে নমুনা সংগ্রহ করে থাকেন। প্রতিষ্ঠানটি জানায়, তাদের নমুনা পরীক্ষার জন্য গ্রাহককে দুই হাজার ৫০০ টাকা দিতে হবে। বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহের জন্য এক হাজারসহ সর্বমোট তিন হাজার ৫০০ টাকা খরচ হবে। এ সময় যোগাযোগের জন্য একটি ফোন নম্বর দেওয়া হলে প্রতিষ্ঠানটি থেকে একজন কর্মকর্তা যোগাযোগ করেন।

থাইরোকেয়ার বাংলাদেশ লিমিটেড থেকে ফোন দিয়েছেন জানিয়ে এক কর্মকর্তা বলেন, ‘উত্তরাতে বাসায় গিয়ে নমুনা পরীক্ষা করানো সম্ভব। প্রতিজনের জন্য দুই হাজার ৫০০ টাকা করে খরচ হবে। যদি একই জায়গায় একাধিক নমুনা সংগ্রহ করা হয় তবে কালেকশন চার্জ এক হাজার টাকা নেওয়া হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সহযোগী ল্যাবের মাধ্যমে নমুনা পরীক্ষা করে থাকি। নমুনা সংগ্রহের পর আমরা তা ল্যাবে পাঠিয়ে দিই। নমুনা পরীক্ষার পর ল্যাব থেকেই ফলাফল জানিয়ে দেওয়া হয়। আমাদের সরকারি অ্যাপ্রুভাল থাকলেও আমরা নমুনা পরীক্ষা করছি না। এটি আমরা অন্যদের মাধ্যমে করাচ্ছি।’

‘আমার ল্যাব (AmarLab)’ নামের একটি ল্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানায়, থাইরোকেয়ার, ডা. পাথ লাল ল্যাবস, পপুলার ডায়াগন্সটিক সেন্টার, ইবনে সিনা, ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল ও ইউনাইটেডের মাধ্যমে তারা নমুনা পরীক্ষা করে থাকে। প্রতিটি নমুনা পরীক্ষার জন্য তিন হাজার ও নমুনা সংগ্রহের জন্য ৭০০ টাকাসহ তিন হাজার ৭০০ টাকা নিয়ে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। এক্ষেত্রে সার্ভিস চার্জ হিসেবে ২০০ এবং ম্যাটারিয়াল কস্ট হিসেবে আরও ৫০ টাকা যোগ হয়। ডা. পাথ লাল ল্যাবস থেকে নমুনা পরীক্ষা করালে ৪০০ টাকা কম রাখা হবে বলেও জানায় প্রতিষ্ঠানটি।

একইভাবে প্রতিষ্ঠানটি থেকে ফোনে যোগাযোগ করা হয় প্রতিবেদকের সঙ্গে। থাইরোকেয়ার কর্তৃপক্ষ জানায়, তাদের নিজস্ব কোনো ল্যাব নেই। এক্ষেত্রে কীভাবে নমুনা পরীক্ষা করানো হবে? জানতে চাইলে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। একইভাবে সরকারি অনুমোদন থাকার কথা বলা হলেও গণমাধ্যমকর্মী পরিচয় জানানোর পরে তাদের সঙ্গে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

‘মায়া (Maya)’ নামের ব্লু ব্যাজধারী একটি পেজের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে নমুনা পরীক্ষা করানোর কথা জানানো হয়। প্রথমে তাদের নিজস্ব ল্যাবে নমুনা পরীক্ষা করানোর কথা জানায়। পরে অবশ্য তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, অন্য ল্যাব থেকে নমুনা পরীক্ষা করেন। এক্ষেত্রে তারা বিদেশগামীদের নমুনা পরীক্ষা করালেও কোনো সনদ দেন না বলে জানানো হয়। বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহের জন্য তাদের তিন হাজার ৯০ টাকা দিতে হবে বলেও জানানো হয়। সেইসঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি জানায় তারা চট্টগ্রাম থেকেও নমুনা সংগ্রহ করে থাকে।

একইভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নমুনা সংগ্রহের বিজ্ঞাপন দিয়েছে প্যাথোকেয়ার, পালস হেলথ কেয়ার, কার্নিভাল কেয়ার নামে কিছু প্রতিষ্ঠান। বাসা থেকে নমুনা সংগ্রহের বিষয়েও আগ্রহ প্রকাশ করে এই প্রতিষ্ঠানগুলো। ডা. আনোয়ার হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান জানায়, বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহের পরে পরীক্ষা করানোর জন্য সর্বমোট তিন হাজার ৭০০ টাকা খরচ হবে।

এদিকে, রাজধানীর ধানমন্ডিতে অবস্থিত পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে চাওয়া হয়, তারা নিজেদের সংগ্রহ করা বাদে অন্য কোনো নমুনা পরীক্ষা করে কি না। জবাবে নমুনা পরীক্ষাবিষয়ক ফোকাল পারসন নন্দ লাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘না, আমরা এভাবে বাইরের কোনো নমুনা পরীক্ষা করি না।’

কর্তৃপক্ষ যা বলছে

জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. মো. ফরিদ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইতোমধ্যেই স্বাস্থ্য অধিদফতর ও মন্ত্রণালয় থেকে যাদের আরটিপিসিআর ল্যাব আছে তাদের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। দেশে থাকা রোগী ও বিদেশগামীদের জন্য আলাদা আলাদাভাবেও অনুমোদন দেওয়া আছে। বিদেশগামীদের বাসায় বসে নমুনা দেওয়ার কোনো ব্যবস্থার অনুমোদন দেওয়া হয়নি এখন পর্যন্ত।’

তিনি বলেন, ‘আরটি পিসিআর পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষা করানোর জন্য শুধুমাত্র তারাই বিজ্ঞাপন দিতে পারবে যাদের অনুমোদন আছে। যাদের অনুমোদন নাই তারা এ ধরনের কোনো বিজ্ঞাপন দিতে পারবে না।’

এ বিষয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব লোকমান হোসেন মিয়াঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেন নি।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশে নমুনা পরীক্ষার মূল্য কমানো প্রয়োজন। কিন্তু এখন পর্যন্ত বেসরকারিভাবে যে মূল্য নির্ধারণ করা আছে তা আসলে অনেকটাই কষ্টসাধ্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য। এমন অবস্থায় যেহেতু কিটের দাম কমেছে তাই নমুনা পরীক্ষার মূল্যও কমানো প্রয়োজন ছিল। সেটা না হওয়া এভাবে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নমুনা পরীক্ষা করানো হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘এর আগে রিজেন্ট হাসপাতাল ও জেকেজি হেলথকেয়ারের ক্ষেত্রেও কিন্তু নমুনা পরীক্ষার বিষয়ে এমন গাফিলতি দেখা গেছে। এগুলোর বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।’

সারাবাংলা/এসবি/পিটিএম

আমার ল্যাব করোনা পরীক্ষা কোভিড-১৯ টেস্ট থাইরোকেয়ার মায়া

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর