১০ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে ৫.৫ বিলিয়ন ডলার
১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০০:১৬
ঢাকা: ১০ থেকে ১২টি প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎখাতে ব্যবসা করে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে পিডিবি থেকে ৫.৫ বিলিয়ন ডলার নিয়েছে। গত দশ বছরে এ টাকা জনগণের পকেট থেকে গেছে। সরকার জেনেশুনেও এটি হতে দিয়েছে। আমাদের হাতে থাকা তথ্য অনুযায়ী- সরকারের এই ভুল ইচ্ছাকৃত। জনগণের করের টাকা অল্প কিছু মানুষের হাত তুলে দেওয়া হচ্ছে। এটি জনমুখী নয়, প্রাইভেট সেক্টরমুখী।
শনিবার (১২ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক (বেন) আয়োজিত জ্বালানী, জলবায়ু পরিবর্তন এবং স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন শীর্ষক দুদিনব্যাপী বাপা-বেন সম্মেলনের শেষ অধিবেশনে এই তথ্য তুলে ধরেন ইউরোপিয়ান ক্লাইমেট ফাউন্ডেশনের ফোকাল পার্সন মুস্তাফা মনোয়ার।
তিনি বলেন, ‘দশ বছরে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে অভাবনীয় উন্নতি ঘটেছে, বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে যা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। কিন্তু তা কোনো মূল্য ছাড়া নয়। বর্তমান সময়ে তেল, গ্যাস, কয়লা, ইউরেনিয়াম ছাড়া আধুনিক অর্থনীতি এগোতে পারবে না। কারণ বিদ্যুৎ তৈরিতে এগুলোর দরকার আছে। অল্পকিছু কয়লা ও গ্যাস ছাড়া বাংলাদেশে বাকিগুলো আমরা আমদানি করি। যে দামে বিদেশ থেকে আমদানি করি, তার চেয়ে কম দামে জনগণকে দিতে হয়। অর্থাৎ এক্ষেত্রে কিছু সাবসিডি দিতে হয় সরকারকে। জনগণের উপকারের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই এটি দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশে দেখা যায় কোনো এক কারণে সাবসিডির টাকায় জনগণের কাজে না লেগে বিশেষ এক গোষ্ঠীর কাজে লাগে যা এক ধরনের অপব্যয়।’
তিনি বলেন, ‘গত দশ বছরে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে ৯০ শতাংশ। গ্যাসের দাম ১৪৪ শতাংশ। ডিজেলের দাম বেড়েছে ১৮২ শতাংশ। মানুষের আয়ও বেড়েছে এটাও ঠিক। কিন্তু তথ্য-উপাত্ত বলছে ধনীদের আয় যেভাবে বেড়েছে সাধারণ মানুষের আয় অত বাড়েনি। এভাবে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। তাই জিডিপির উল্লম্ফন দিয়ে বাস্তব তথ্যের ফাঁকফোকর বন্ধ করা যাবে না।’
মুস্তাফা মনোয়ার বলেন, ‘বছর বছর বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর টাকা বাজেট অর্থাৎ জনগণের পকেট থেকে যায়। আবার দিন শেষে বাড়তি দামের বোঝা জনগনকেই ভোগ করতে হয়। আমদানি মানেই কাঁচা টাকার কারবার। যদি বিদেশ থেকে ১০০ টাকার তেল আমদানি করা হয় তাহলে দেশে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে সরকার ৩২ টাকা নিয়ে নেয়। এভাবে তেলের দাম দাঁড়ায় ১৩২ টাকা। যার ফলে বোঝা যায় আমদানিকারক একা নয়, সরকার নিজেও লাভবান হয়। এতে লাভ, কমিশন, দুর্নীতি হিস্যা বানিজ্যের রমরমা হয়েছে। এভাবে আমদানি নির্ভরতা দেখা যাচ্ছে যেখান থেকে ছোট্ট একটি গোষ্ঠী লাভবান হয়। আর ক্ষয়ক্ষতির বোঝা বইতে হয় সাধারণ জনগণকে। এভাবে আমদানী নির্ভরতার একটি মধুর ধারা তৈরি হয়েছে দেশে। আমদানি নির্ভরতার ফলে যে লাভবান হওয়ার ধারা তার বড় একটি অংশ খায় বিদ্যুৎ খাত। গত বছর সরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ প্রতিষ্ঠান পিডিবির লোকসান ৮ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকা। এর আগের বছর লোকসান ৪ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা।’
তিনি বলেন, ‘এই লোকসান কাটিয়ে ওঠার টাকা দেয় আবার জনগণ। এভাবে সাবসিডির মাধ্যমে জনগণের করের টাকা দিয়ে টিকিয়ে রাখা হচ্ছে। এই লোকসানের কারণের মধ্যে যেমন দুর্নীতি রয়েছে তেমনি করেছে কিছু ভুল নীতি। আমাদের দেশে ১৪৮ টি কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। এদের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ২২ হাজার মেগাওয়াট। এগুলো প্রতিষ্ঠিত হলেও এ থেকে আমরা বিদ্যুৎ নেই না। গত বছর ৩৬৫ দিনের মধ্যে মাত্র ১৫৩ দিন আমরা এ সব বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ নিয়েছি। বাকি ২১২ দিন এগুলোকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। এর কারণ আমরা ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত উৎপাদন করেছি। এগুলো বন্ধ না করে টিকিয়ে রেখেছি কোন কোন ব্যক্তির স্বার্থের জন্য। ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর স্বার্থে এগুলো টিকিয়ে রাখার ফলে বিদ্যুৎ খাত একটি লোকসানি খাতে তৈরি করেছি। এর কারণ ভুল নীতি।’
মুস্তাফা মনোয়ার বলেন, ‘এভাবে অলস বসিয়ে রাখা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের খরচ আছে। বেসরকারি কেন্দ্রে খরচ (ক্যাপাসিটি চার্জ) গত বছর ১৩ হাজার কোটি টাকা। সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের খরচ (মেন্টেনেন্স খরচ) ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা বছরে দেওয়া লাগছে যা পিডিবির বাৎসরিক হিসেবে দেখানো হয় না। এসব বাড়তি খরচ যখন সাবসিডি দিয়ে কুলোচ্ছে না তখন বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এভাবে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দামও বাড়ছে। এভাবে সরকারি ভুল নীতির সরাসরি ভুক্তোভোগী জনগণ।’
সারাবাংলা/আরএফ/একে