রাসিকের সঙ্গে প্রতারণা চেষ্টায় কোরিয়ান কোম্পানি
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৩:৩৯
রাজশাহী: আড়াই মাস আগে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) সাবেক প্রধান প্রকৌশলী আশরাফুল হকের কাছে একটি ফোনকল আসে। ফোনের ওপাশে দক্ষিণ কোরিয়ার সিনসিন গ্লোবাল কোম্পানি লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) বেয়ং চেওল সিন। তিনি জানতে চাইলেন, সিটি করপোরেশন তাদের কাছ থেকে যে আটটি ফায়ার ফাইটিং ট্রাক কেনার চুক্তি করেছে তার কোন অগ্রগতি নেই কেন?
আশরাফুল হক জানান, রাসিক তো এ ধরনের কোনো চুক্তি করেনি। তারপর মি. সিন চুক্তি সংক্রান্ত কিছু ডকুমেন্ট পাঠান। আশরাফুল হক এখন রাসিকের প্রকৌশল উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন। তিনি ছুটলেন মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের কাছে। মেয়র ডকুমেন্টগুলো দেখে বললেন, এ সব ডকুমেন্টই ভুয়া। মেয়রের ভুয়া পাসপোর্ট, ভুয়া ইমেইল আইডি, কর্মকর্তাদের ভুয়া নাম ব্যবহার করে সিনসিনের সঙ্গে ১০ দশমিক ১২ মিলিয়ন ডলার বা প্রায় ৯০ কোটি টাকার চুক্তি দেখানো হচ্ছে।
তারপর সিটি করপোরেশন স্পষ্টভাবেই সিনসিনকে জানিয়ে দিয়েছে এমন কোনো চুক্তি করা হয়নি। সব ডকুমেন্টই ভুয়া। কিন্তু, সিনসিনও থেমে থাকেনি। রাসিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে দক্ষিণ কোরিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসে। দাবি করেছে তিন লাখ ডলার ক্ষতিপূরণ। সম্প্রতি এ ব্যাপারে বাংলাদেশের দূতাবাসের কমার্সিয়াল কাউন্সিলর ড. মিজানুর রহমান রাসিককে চিঠি দিয়েছেন। চিঠির অনুলিপি পাঠানো হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ তিনটি দফতরে। ভুয়া চুক্তির ব্যাপারে রাসিকও নগরীর বোয়ালিয়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছে।
এ সমস্ত ঘটনাই সংবাদ সম্মেলন করে সাংবাদিকদের কাছে তুলে ধরেছেন রাসিক মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটন। বুধবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) দুপুর ১২টায় নগর ভবনের অ্যানেক্স ভবনে তিনি এই সংবাদ সম্মেলন করেন।
মেয়র বলেন, আগুন নেভানোর জন্য কাজ করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। সিটি করপোরেশন এ ধরনের কাজ করে না। তাই ফায়ার ফাইটিং ট্রাক কেনার চুক্তি করার কোন প্রশ্নই আসে না। বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিক এবং অযৌক্তিক। আন্তর্জাতিক চক্র জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধমে রাসিকের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার অপতৎপরায় লিপ্ত হয়েছে।
তিনি বলেন, সিনসিনের সিইও বি.সি সিন কয়েকটি ইমেইলে আটটি ফায়ার ফাইটিং ট্রাক কেনা সংক্রান্ত ভূয়া ডকুমেন্ট পাঠিয়েছেন। এগুলো যাচাই করে দেখা গেছে, ট্রাক কেনার ব্যাপারে যাবতীয় যোগাযোগ একটি ভুয়া ইমেইল আইডির সঙ্গে হয়েছে।
বি.সি সিন গত ৪ ডিসেম্বর একটি ডিমান্ড নোটিশ পাঠিয়েছেন। এতে সংযুক্তি হিসেবে নয়টি ডকুমেন্ট পাঠিয়েছেন। এগুলো যাচাই-বাছাই করে দেখা গেছে, মেয়রের পাসপোর্টও জালিয়াতি করা হয়েছে। পাসপোর্টে যে ছবি আছে সে ছবি মেয়র লিটনের পাসপোর্টে নেই। ডকুমেন্টে যে প্যাড ব্যবহার করা হয়েছে সেটিও রাসিকের নয়। চুক্তিতে রাসিকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যে নাম লেখা আছে সে নামে কখনও কোন ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন না। চুক্তিতে ইসলাম খান উদ্দিন নামে একজন হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার নাম, পদবী ও সীল উল্লেখ রয়েছে। অথচ এ নামে কোন হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা নেই বা ছিলেন না। এছাড়া ই-মেইলে যে টাইম জোন দেখা যায়। তা বাংলাদেশ বা দক্ষিণ কোরিয়ার টাইম জোন নয়।
মেয়র বলেন, ‘ডকুমেন্টে থাকা ই-মেইল অ্যাড্রেস ও মোবাইল নম্বর তার নয়। ডকুমেন্ট হিসেবে সংযুক্ত আছে পাসপোর্টের দুটি জাল পাতা। সেখানে দেওয়া তার নাম, পাসপোর্ট নম্বর, জরুরি যোগাযোগ এবং অন্যান্য তথ্য সঠিক নয়। পাসপোর্টে থাকা ছবিটি পাসপোর্ট সাইজের না। ছবিটি পোস্টার বা ফেসবুক থেকে সংগ্রহ করে পাসপোর্টে লাগানো হয়েছে। সুতরাং বি.সি সিনের কথিত লেনদেনের দায় আমার বা রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ওপর বর্তায় না।
মেয়র জানান, বাংলাদেশে সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়া পিপিএ-২০০৬ ও পিপিআর-২০০৮ অনুযায়ী সিটি করপোরশনের সকল ক্রয় কার্যক্রম সম্পাদিত হয়। যানবাহন বা যে কোন পণ্য কেনার ক্ষেত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সরবরাহকারীর কাছ থেকে কেনা হয়ে থাকে। বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই সরাসরি টাকায় এ রকম বড় অংকের অর্থের কেনাকাটা করার সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে কোরিয়ান সিনসিন কোম্পানির সাথে ১০ দশমিক ১২ মিলিয়ন ডলারের সরাসরি ক্রয়চুক্তি সরকারি ক্রয় নীতিমালা পরিপন্থি ও বাস্তবসম্মত নয়। এ সবই ভুয়া।
রাসিক মেয়র বলেন, বি.সি সিন বার বার দূতাবাসে অভিযোগ করেছেন। তিনি বলেছেন, কথিত ওই চুক্তি হওয়ার পর ট্রাক সরবরাহ করার জন্য তিনি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানকে ৭৮ হাজার ডলার অগ্রিম দিয়েছেন। এখন ট্রাক না নেওয়ার কারণে তার তিন লাখ ডলার ক্ষতি হয়েছে। তিনি এই ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন। এ অভিযোগ পেয়ে যাচাই-বাছাই ছাড়াই দূতাবাসের কর্মকর্তা চিঠি পাঠানোয় তার মানহানি ঘটেছে। রাসিক তথা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে। রাসিকের প্রকৌশল উপদেষ্টা আশরাফুল হক চিঠি দিয়ে দূতাবাসকে বিস্তারিত জানিয়েছেন।
প্রশ্ন উঠেছে রাসিক মেয়রের পাসপোর্টের দুই পাতা ছবি কিংবা ই-মেইল ঠিকানার তথ্য কে সিনসিন কোম্পানিকে দিয়েছে? জালিয়াতি এ চক্রে রাসিক বা দেশের কেউ জড়িত থাকতে পারে কি না জানতে চাইলে মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘সন্দেহ করা যেতে পারে। কিন্তু স্পষ্টভাবে নাম বলা কঠিন। এটা তদন্তের ব্যাপার।’
তিনি জানান, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে সিনসিন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড রাজশাহীতে ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের আগ্রহ দেখিয়ে তাকে চিঠি দিয়েছিল। সে সময় বি.সি সিন রাজশাহী এসেছিলেন। একাধিক আলোচনার পর রাসিক এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ব্যাপারে অনাগ্রহ দেখায়। সে সময়ই পত্রযোগাযোগসহ এ বিষয়টির সমাপ্তি ঘটে। সে সময় প্রধান প্রকৌশলী ছিলেন আশরাফুল হক। বি.সি সিন তার মোবাইল নম্বর ও ই-মেইল ঠিকানা নিয়ে গিয়েছিলেন। তিন বছর পর হঠাৎ বি.সি সিন আশরাফুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করে এই ট্রাকের বিষয়ে জানান। অথচ এ রকম কোন চুক্তি রাসিক করেনি।
মেয়র বলেন, ‘১০০ নয়, ১৫০ শতাংশ নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে সব ডকুমেন্ট ভূয়া এবং এ রকম কোন চুক্তি হয়নি। তাই কোনরকম ট্রাক কেনা কিংবা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সিনসিন কোম্পানি তৃতীয় কোন পক্ষ দ্বারা প্রতারিত হয়েছে, নাকি প্রতিষ্ঠানটির সিইও বি.সি সিন ও তার সহযোগীরা নিজেরাই বিভিন্ন ভূয়া ডকুমেন্ট তৈরি করে রাসিককে ফাঁসানোর জন্য চেষ্টা চালাচ্ছেন তা স্পষ্ট নয়। যথাযথ তদন্ত ও তথ্য প্রমাণ প্রাপ্তি সাপেক্ষে তা জানা যাবে। এ জন্য রাসিকের প্রকৌশল উপদেষ্টা আশরাফুল হক থানায় একটি জিডি করেছেন। প্রকৃত ঘটনা জানিয়ে তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলে বাংলাদেশের দূতাবাসে চিঠিও দিয়েছেন।
মেয়র আরও জানান, এ ব্যাপারে পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটেরও সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। দু’একদিনের মধ্যে এ ব্যাপারে মামলা করা হবে। তিনি আশা করছেন কে কে এই চক্রে জড়িত তা তদন্তেই বেরিয়ে আসবে। এ ব্যাপারে মেয়র সাংবাদিকদের সহায়তা কামনা করেন। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমি জানানোর আগেই জানাজানি হলে বিভ্রান্তি ছড়াতো। তাই প্রকৃত বিষয়টা সবার কাছে তুলে ধরলাম।’
সারাবাংলা/একেএম