‘এভাবে কেউ পদ্মশ্রী দেয়? এরা জানে না আমি কে? নব্বই বছরে আমার শেষে পদ্মশ্রী নিতে হবে? আর এই ফোন করে বললেই আমি চলে যাব? আমি বলে দিয়েছি আমার পদ্মশ্রীর কোন দরকার নেই। শ্রোতাই আমার সব।’— এই তো মাত্র কয়েকদিন আগে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সঙ্গীতজ্ঞ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে পদ্মশ্রী পদক দিতে চাইলে হতাশা আর অভিমানে এ কথাগুলো বলেছিলেন সন্ধ্যা। প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক। সঙ্গীত জগতের সেই সম্রাজী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় আমাদের সবাইকে বেদনাহত করে পাড়ি দিয়েছেন না ফেরার দেশে।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি পৈশাচিক আক্রমণ থেকে প্রাণ বাঁচাতে ঢল নামে সীমান্তের ওপারে। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয় গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের। অতঃপর বাঙালি শিল্পীদের সঙ্গে গণআন্দোলনে যোগ দেন তিনি। শরনার্থী শিবিরে উদ্বাস্তু বাঙালিদের জন্য সংগ্রহ করেন অর্থ সহযোগিতা। এরকম দুর্যোগপূর্ণ সময়ে রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল চাঙ্গা করতে সঙ্গীতশিল্পী সমর দাসকে সাহায্যার্থে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য রেকর্ড করেন দেশাত্মবোধক গান। গানের মাধ্যমে দুনিয়াব্যাপী সচেতনতা সৃষ্টি করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য। কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধুর মুক্তি উপলক্ষে গেয়েছেন ‘বঙ্গবন্ধু তুমি ফিরে এলে’। এমনকি স্বাধীনতা পরবর্তী ঢাকায় পল্টন ময়দানে প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারির উদযাপনে তিনি ছিলেন অন্যতম বিদেশি শিল্পী।
ভারতবর্ষ জুড়ে খ্যাতনামা বর্ষীয়ান এই সংগীতশিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩১ সালের ৪ অক্টোবর কলকাতার ঢাকুরিয়াতে। বাবা নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং মা হেমপ্রভা দেবীর ছয় সন্তানের কনিষ্ঠতম ছিলেন সন্ধ্যা। শৈশবে গানের হাতেখড়ি করেছেন পন্ডিত সন্তোষ কুমার বসু এবং চিন্ময় লাহিড়ীর কাছে। উস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খানের কাছে নিয়েছেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম। ১৯৪৮ সালে প্লে-ব্যাকে প্রথম পদচারণা করেন। চলচিত্র দুনিয়ায়ও দাপিয়েছেন স্ব-মহিমায়। ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ বাঙালি শ্রোতাদের মানসপটে তার উল্লেখযোগ্য এক গান।
রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, লোকগান এবং আধুনিকসহ সব গানে মুগ্ধ করেছেন দর্শক-শ্রোতাদের। গেয়েছেন একাধিক ভাষায়। তার কালজয়ী গানগুলোর মধ্যে অন্যতম হল— ‘এ শুধু গানের দিন, এ লগন গান শোনাবার’, ‘মধুমালতী’, ‘এসো মা লক্ষ্মী, বোসো ঘরে’, ‘আয় বৃষ্টি ঝেঁপে’, ‘চম্পা চামেলি গোলাপেরই বাগে’, এবং ‘কে তুমি আমারে ডাকো’ ইত্যাদি সব গান। গানে সুরে মন মাতিয়ে তুলেছিলেন তৎকালে।
১৯৫০ সালে তারানা চলচিত্রে একটি গান দিয়ে মুম্বাইয়ে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন গীতশ্রী। শিল্পী যখন তার শিল্পের মধ্যগগনে বিরাজমান তখন ফিরে আসেন তার শৈশবের কলকাতায়। ষাটের দশকে সেখানেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন কবি শ্যামল গুপ্তের সাথে। সঙ্গীত জগতে সন্ধ্যার অনন্য জুটিতে ছিলেন হেমন্ত মুখার্জী। হেমন্ত মুখার্জী এবং সন্ধ্যা বাংলার মহানায়ক উত্তম কুমার এবং সুচিত্রা সেনের কণ্ঠস্বর হিসেবে অবিস্মরণীয় খ্যাতি লাভ করেন। উত্তম কুমার এবং সুচিত্রা সেনই মূলত সামনে এনেছিলেন ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ গানটির। অথচ গীতশ্রী সন্ধ্যার জীবনের পথের সমাপ্ত ঘটলো রাষ্ট্রের প্রতি অভিমানের ভেতর দিয়েই।
উপমহাদেশের কিংবদন্তি এই গায়িকা রাষ্ট্রীয় সম্মান না পেলেও সমাদৃত হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গে। ভূষিত হয়েছেন গীতশ্রী সম্মানে। পশ্চিমবঙ্গে পেয়েছেন বঙ্গবিভূষণ। ১৯৭১ সালে জয়জয়ন্তী এবং নিশিপদ্ম চলচিত্রে গান গেয়ে শ্রেষ্ঠ গায়িকা হিসেবে পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ছিল যার গভীর সম্পর্ক। যখনই মুখ্যমন্ত্রীকে ফোন করতেন বলতেন, ‘একটা গান শোনাও মমতা।’ এতটাই নাছোড়বান্দা ছিলেন যে মুখ্যমন্ত্রী শিল্পীকে গান না শুনিয়ে পারতেন না। অথচ কালের খেয়ায় জীবিত থেকেও এক রকমের হারিয়ে গিয়েছিলেন এই শিল্পী। ঠিক যেন আমাদের নির্মলেন্দু গুণের মতো বেঁচে থাকা অবস্থাতেই রাষ্ট্রের কাছে পুরস্কার চাইতে হবে। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বা আমাদের নির্মলেন্দু গুণেরা কী আরও আগে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান পাওয়ার যোগ্য ছিল না? মৃত্যুর কাছাকাছি আসলে বা মৃত্যুবরণ করলে বুঝি শিল্পীর যোগ্যতা হয়!
তরুণ বয়সে শিল্পী তার শিল্পকর্মের জন্য রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেলে নতুন নির্মাণে উৎসাহিত হয়। কিন্তু এই উপমহাদেশে এমন একটা সময়ে পুরস্কার দেওয়া হয় যখন আর কোন পুরস্কারের প্রয়োজন পরে না, তখন কেবল চলে যাওয়ার পালা; সেরকম সময়ে পুরস্কার দিলে তা কেবলই অপমানজনক। রাগে ক্ষোভে অভিমানে ফেলে দিতে ইচ্ছে হয় সে পুরস্কার। মুক্তিযুদ্ধের পরম অকৃত্রিম বন্ধুকে হারিয়ে আমরা শোকাহত। শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং বিদায় জানবেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।
লেখক: সজীব ওয়াফি, প্রাবন্ধিক