Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রভাতফেরির গানে-স্লোগানে মাথা নত না করার শপথ

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৩:১৯

ছবি: সারাবাংলা

চট্টগ্রাম ব্যুরো: ছয় দশকেরও বেশি সময় আগে তৎকালীন পাকিস্তানের সিংহভাগ মানুষের ভাষা বাংলাকে বঞ্চিত করে সাম্প্রদায়িক চিন্তা থেকে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল বাঙালি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, ফাগুনে ফোটা সেদিনের রক্তপলাশের রঙ বিবর্ণ হয়ে মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া বীরদের রক্তে লাল হয়েছিল রাজপথ। বীরের এই রক্তস্রোত এনে দিয়েছিল মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার। বাঙালি শপথ নিয়েছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা নত না করার।

বিজ্ঞাপন

সেই মাথা নত না করার শপথেই বাঙালি মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া বীর শহিদদের গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করেছে। মহান একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে সোমবার শহিদ মিনারে জড়ো হওয়া মানুষ বলেছেন সকল জাতিগোষ্ঠীর ভাষার অধিকারের কথা, বৈষম্য-শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা, অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা নত না করার কথা। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাকে কোনো সাম্প্রদায়িক-ধর্মান্ধ অপশক্তির কাছে পরাস্ত হতে না দেওয়ার শপথে দৃঢ় হয়েছে মানুষ শহিদ বেদি ছুঁয়ে।

বিজ্ঞাপন

সাংস্কৃতিক বলয় প্রকল্পের জন্য চট্টগ্রাম নগরীর কে সি দে রোডে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার ভেঙে পুনরায় নির্মাণ করা হচ্ছে। পাশেই মিউনিসিপ্যাল মডেল হাইস্কুল প্রাঙ্গনে নির্মিত অস্থায়ী শহিদ মিনারে প্রথমবারের মতো শ্রদ্ধা জানানোর কর্মসূচির আয়োজন করে সিটি করপোরেশন। রাতে সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী এবং প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।

রাতে বৃষ্টি হলেও ভোর থেকে আকাশ ছিল পরিষ্কার। সোমবার (২১ ফেব্রুয়ারি) ভোর থেকেই শুরু হয় শহিদ মিনার প্রাঙ্গনে মানুষের আনাগোণা। শুরু হয় প্রভাতফেরি। বিভিন্ন সংগঠনের কর্মী, শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রভাতফেরিতে যোগ দেন। কারও কণ্ঠে একুশের কালজয়ী গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’, আবার কারও কণ্ঠে স্লোগান। কারও হাতে ব্যানার, কারও হাতে বর্ণমালা, কেউ বা নিয়েছিলেন লাল-সবুজের পতাকা, ভাষার জন্য আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে পতাকা পেয়েছে বাঙালি।

ছবি: সারাবাংলা

ছবি: সারাবাংলা

চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এসময় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র খোরশেদ আলম সুজন, সিডিএর সাবেক চেয়ারম্যান আবদুস ছালামসহ নেতাকর্মীরা ছিলেন। চট্টগ্রাম মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হাসিনা মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা ফুল দেন। দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাংসদ মোছলেম উদ্দিন আহমেদ এবং সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান নেতাকর্মীদের নিয়ে ফুল দেন।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, চট্টগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি অশোক সাহা ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা শহিদ মিনারে ফুল দেন। ওয়ার্কার্স পার্টি, চট্টগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট আবু হানিফ ও সাধারণ সম্পাদক শরীফ চৌহানের নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা ফুল দেন। বাসদ (মার্ক্সবাদী), গণমুক্তি ইউনিয়ন, জাসদ, ন্যাপ, জাতীয় পার্টিসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকেও শ্রদ্ধা জানানো হয়। এছাড়া চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির আহবায়ক শাহাদাত হোসেন ও সদস্য সচিব আবুল হাশেম বক্কর এবং দক্ষিণ জেলার আহবায়ক আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা শহিদ মিনারে ফুল দিয়েছেন।

চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তালেব আলী ও সাধারণ সম্পাদক জাকারিয়া দস্তগীরের নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা ফুল দেন। সরকারি হাজী মুহাম্মদ মহসীন কলেজে ছাত্রলীগ নেতা মায়মুন উদ্দিন মামুন এবং চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি মাহমুদুল করিম ও সাধারণ সম্পাদক সুভাষ মল্লিক সবুজের নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা নিজ নিজ কলেজে শহিদ মিনারে ফুল দেন।

ছবি: সারাবাংলা

ছবি: সারাবাংলা

চট্টগ্রাম জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি অ্যানি সেন ও সাধারণ সম্পাদক ইমরান চৌধুরীর নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা অস্থায়ী শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এরপর ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা বর্ণমালা মিছিল বের করেন। মিছিল শেষে সংগঠনের কার্যালয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সাংস্কৃতিক গণসংগঠন উদীচী চট্টগ্রাম শহিদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানায়। এ সময় উদীচী চট্টগ্রামের সহ-সভাপতি প্রবাল দে, বিধান বিশ্বাস, সুমন সেন ও তপন শীল, সহ-সম্পাদক মনীষ মিত্র চৌধুরী, কোষাধ্যক্ষ বাবলা চৌধুরী, সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য দীপা বিশ্বাস, মীর এনায়েতউল্লাহ সানি, সঙ্গীতা ঘোষ এবং শিল্পীরা উপস্থিত ছিলেন। পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে নগরীর নিউমার্কেট মোড়ে ভাষার জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয়া বীরদের শ্রদ্ধা জানিয়ে গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন উদীচীর শিল্পীরা।

বোধন আবৃত্তি পরিষদ, প্রমা আবৃত্তি সংগঠন, খেলাঘর চট্টগ্রাম মহানগর, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগ, যুব ইউনিয়নসহ আরও বিভিন্ন সংগঠন শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে।

বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সহকারী হাই কমিশনার রাজীব রঞ্জন দূতাবাসের কর্মকর্তাদের নিয়ে শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।

ছবি: সারাবাংলা

ছবি: সারাবাংলা

বেসরকারি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. অনুপম সেন শহিদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ট্রেজারার প্রফেসর এ কে এম তফজল হক, কলা ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন মোহীত উল আলম, প্রধান প্রকৌশলী আবু তাহের, রেজিস্ট্রার খুরশিদুর রহমান, পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক শেখ মুহাম্মদ ইব্রাহিম, প্রকৌশল ও বিজ্ঞান অনুষদের ডিন তৌফিক সাঈদ, স্থাপত্য বিভাগের চেয়ারম্যান সোহেল এম. শাকুর, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের সহকারী ডিন মঈনুল হক, গণিত বিভাগের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইফতেখার মনির, তড়িৎ প্রকৌশল বিভাগের চেয়ারম্যান টুটন চন্দ্র মল্লিক, আইন বিভাগের চেয়ারম্যান তানজিনা আলম চৌধুরী, অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান ফারজানা ইয়াসমিন চৌধুরী, ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান সাদাত জামান খান, প্রক্টর আহমদ রাজীব চৌধুরী ও ডেপুটি লাইব্রেরিয়ান কাউছার আলম ছিলেন।

পুষ্পস্তবক অর্পণের আগে আলোচনা সভায় অনুপম সেন বলেন, ‘দেশভাগের পর পাকিস্তানে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে যারা ছিলেন। তারা, এমনকি তৎকালীন পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের পরিবারও উর্দু ভাষার তোষক ছিল। কারণ মুসলিম লীগের মুখ্য নেতাদের মুখের ভাষা ছিল উর্দু। যদিও উর্দু ছিল পাকিস্তানের কেবলমাত্র সাড়ে সাত শতাংশ মানুষের মুখের ভাষা। অন্যদিকে ছাপ্পান্ন শতাংশ লোকের মুখের ভাষা ছিল বাংলা। তবু পশ্চিম পাকিস্তান উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্ত করেছিল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ফলে এই চক্রান্ত ব্যর্থ হয়।’

১৯৪৮ সালে বঙ্গবন্ধু ভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে ভাষা আন্দোলনের সূচনা করেন এবং এর জন্য কারাবরণও করেছিলেন— এমন তথ্য দেন অনুপম সেন।

সারাবাংলার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি চলন্ত চাকমা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে সোমবার সকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান উপাচার্য ড. শিরীণ আখতার এবং উপ-উপাচার্য বেণু কুমার দে। এরপর ভাষা শহিদদের স্মরণে শোক র‌্যালি অনুষ্ঠিত হয়। ক্যাম্পাসের বঙ্গবন্ধু চত্বরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতেও ফুল দেয়া হয়। এরপর আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি, পোর্ট সিটি ইউনিভার্সিটির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে গিয়ে ফুল দেন।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পরিস্থিতিতে শহিদ মিনারে সংগঠন থেকে সর্বোচ্চ পাঁচজন এবং ব্যক্তিপর্যায়ে দু’জন ঢোকার বিধিনিষেধ দিয়েছিল জেলা প্রশাসন। তবে সেই নিষেধ তেমন কার্যকর হয়নি। দলে দলে মানুষ নির্বিঘ্নেই প্রবেশ করেছে। তবে অন্যান্যবারের মতো এবার শহিদ মিনারে মানুষের ঢল দেখা যায়নি।

সারাবাংলা/আরডি/এনএস

একুশে ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম প্রভাতফেরি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর