বেদিতে সব ভালোবাসা একাকার
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ২০:৩৯
ঢাকা: মায়ের সঙ্গে ফুল দিতে এসেছে আয়েশা আক্তার তায়েবা, সুমাইয়া আক্তার হাফশা। তাদের একজন পড়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে, একজন শিশু শ্রেণিতে। জানে না ভাষা দিবস কী, জানে না ভাষা দিবসের তাৎপর্য, জানে না ভাষা দিবসের ইতিহাস, তবুও আবেগমাখা ভালোবাসায় সেই সকালে খালি পায়ে মায়ের সঙ্গে ফুল দিতে আসে সরকারি তিতুমীর কলেজের শহিদ মিনারে।
বেদিতে ফুল দিতে আসার কারণ জানতে চাইলে তারা বলে, মা শিখিয়েছে আজকের এ দিনে নাকি আমাদের ভাষা শহিদরা আমাদের মাতৃভাষা এনে দিয়েছে, তাদেরকে আমি অনেক ভালোবাসি, তাদের প্রতি আমি ভালোবাসা জানাই।
বাবা তার ৪ সন্তানকে নিয়ে আসেন শহিদ মিনারে ফুল দিতে। সাদা কালোয় রাঙানো একই রকমের ৪ পাঞ্জাবি পড়ে ভাইদের সঙ্গে মহাখুশি সাফিন। বাঁধভাঙা আনন্দ নিয়ে ফুল দিচ্ছে শহীদ মিনারে। বাংলা ভাষায় কথা বলতে পেরে এই দিনটিকে ভাষা উৎসব হিসেবে মনে করেই তাদের খুব আনন্দ। খুশি থেকেই এসেছে ফুল দিতে।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালির রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল রাজপথ। রক্তের দামে এসেছিল বাংলার স্বীকৃতি এই ভাষা। ভাষা শহিদদের আত্মত্যাগের ফলে বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। আজ তারা আমাদের কাছে অমর। এই ভাষা দিবসে শহিদদের শ্রদ্ধা জানাতে সরকারি তিতুমীর কলেজের শহিদ মিনারে এসেছেন সাধারণ জনগণ থেকে শিক্ষার্থীরা। ভাষা আন্দোলনের অনুভূতি নিয়ে সরেজমিনে কথা হলো ফজলুল কবির তালুকদারের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও আমরা তিতুমীর কলেজের বেদিতে ফুল দিতে এসেছি। তবে করোনা সংক্রমণ বাড়ায় স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে সতর্ক থাকতে হচ্ছে। যেহেতু ভাষার জন্য শহিদেরা আজকের দিনে তাদের জীবন উৎসর্গ করলেন। তাদের শ্রদ্ধা নিবেদনে করোনা মহামারির মধ্যেও আমরা এসেছি পুষ্পস্তবক অর্পণে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পূর্বের তরুণ প্রজন্মের দেশের এবং সংস্কৃতির প্রতি টান ছিল প্রাকৃতিক। তবে বর্তমানে অপসাংস্কৃতিক ও যন্ত্রনির্ভর তরুণ সমাজ কিছুটা হৃদয়গ্রাহী হচ্ছে না। তবে আমরা তরুন প্রজন্মকে পিছিয়ে রাখতে চাই না। শুধু তাদের কাছে চাওয়া তারা যেন দেশপ্রেম সংস্কৃতি ধরে রাখে।’
বার্ধক্যে ঝুঁকে পড়া রমিজ উদ্দিন নাতি নাতনির সঙ্গে এসেছেন শহিদ মিনারে তার অনুভূতিতে, আমি সাক্ষী ছিলাম ভাষা আন্দোলনের। আমি থাকতাম ক্যান্টেনমেন্ট এলাকায় তখন আমার বয়স ৬ বছর। ভাষা আন্দোলনের স্লোগান আমি দেখেছি, শুনেছি। ছোটবেলা থেকেই পাড়ায় পাড়ায় আমরা শহিদ মিনার করেছি, গান গেয়েছি, বর্ণমালা তৈরি করেছি। ভাষা শহিদদের প্রতি অনুভূতি থেকেই শ্রদ্ধা জানিয়েছি৷ বর্তমান সময় পাল্টেছে আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে শহীদ দিবস পালন করা হয়।
সাদাকালো পড়ে শহিদ মিনারে আসার অনুভূতি জানতে চাইলে তিতুমীর কলেজে পড়ুয়া ইভা ইসলাম বলেন, ‘আমাদের সেই অনুভূতিটা আমরা ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারি না। কিন্তু আমাদের মনে হয় আমরা ভাষা শহিদদের কাছে, তাদের আত্মত্যাগের কাছে ঋণী। তারা যদি না থাকত তাহলে আমরা এত সুন্দরভাবে কথা বলতে পারতাম না। বাংলার মধ্যে ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করলেও অন্য ভাষায় বা উর্দুতে এত সুন্দর, সাবলীলভাবে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারতাম না। বাংলা বলাটা উনাদের জন্যই সম্ভব হয়েছে। সবার মধ্যেই ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা সম্মান বোধ রয়েছে। হয়তো সবাই ভালভাবে প্রকাশ করতে পারে না।’
বেদিতে ফুল দিতে আসা ও সাদা কালো পড়ার কারণ জানতে চাইলে এই শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমরা সম্মানের দিক থেকে বা শ্রদ্ধার দিক থেকেই শহিদ মিনারে আসি। এসে ফুল দিয়ে যাই। আর সাদা কালোর মিশ্রণটা শহিদের প্রতি আমাদের যে শোক প্রকাশ হয় তাই পড়ে থাকি।’
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া আরেক শিক্ষার্থী মাঈদুল ইসলাম বলেন, ‘পৃথিবীর বুকে একমাত্র জাতি বাংলা বাঙালি জাতি যারা ভাষার জন্য ১৯৫২ সালে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করে দিয়েছেন। জাতির এ সকল সূর্যসন্তানদের স্মরণে এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আজকের দিনে দেশের সকল প্রান্তের সকল শ্রেণির মানুষেরা শহিদ মিনারের বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। ফুল শ্রদ্ধা নিবেদন এবং ভালোবাসা জানানোর অন্যতম মাধ্যম যার ধারাবাহিকতায় আজকের দিনে আমরা বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করি। এভাবেই মায়ের ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা নিয়েই প্রতিবছর বেদিতে ভালোবাসা অর্পণ করছেন প্রতিটি মানুষ।’
সারাবাংলা/এনএসএম/একে