হঠাৎ অস্ত্রের চালান নিয়ে দেশে কেন ‘যুবদল ক্যাডার’ রাজীব?
২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ২১:৫০
চট্টগ্রাম ব্যুরো: একসময়ের ‘যুবদল ক্যাডার’ হিসেবে পরিচিত রাজীব বড়ুয়া। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পালিয়ে চলে যান ভারতে। সেখান থেকে লিবিয়া হয়ে পৌঁছান ইতালি। সম্প্রতি চট্টগ্রাম কাস্টমসে বিদেশি ডাকের একটি চালান থেকে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় আলোচনায় উঠে এসেছেন সেই রাজীব।
পুলিশ জানতে পেরেছে, বিদেশি ডাকে বন্ধুর নামে অস্ত্রের চালান পাঠিয়ে দেশে ফিরেছেন রাজীব। সেই চালানের আগেই রাজীব দেশে পৌঁছেছেন। হঠাৎ কেন রাজীবের দেশে ফেরা এবং কেনই বা অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র দেশে নিয়ে আসা— সেই তথ্য বের করতে মরিয়া নগর পুলিশ।
নিছক কেনাবেচার উদ্দেশ্যে অস্ত্রগুলো ইতালি থেকে দেশে এনেছিলেন নাকি এর সঙ্গে যুবদল ক্যাডারের আগামী সংসদ নির্বাচন পূর্ববর্তী কোনো পরিকল্পনা আছে— এগুলো এখন বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে নগর পুলিশের কর্মকর্তাদের কাছে। দেশে ফেরার তথ্য পেয়ে রাজীবকে গ্রেফতারের জন্য এখন হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ।
গত রোববার (২০ ফেব্রুয়ারি) চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে বৈদেশিক ডাকের একটি চালানে গৃহস্থালি ও প্রসাধনী সামগ্রীর সঙ্গে থাকা চারটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়। ওই চালানে দু’টি ইতালিতে তৈরি এইট এমএম পিস্তলের সঙ্গে আছে ৬০ রাউন্ড কার্তুজ। বাকি দু’টি খেলনা পিস্তল। এ ঘটনায় চট্টগ্রাম কাস্টমসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন বাদী হয়ে চালানের প্রেরক রাজীব বড়ুয়া ও প্রাপক মজুমদার কামরুল হাসানকে আসামি করে বন্দর থানায় মামলা দায়ের করেন। এরই মধ্যে মজুমদার কামরুল হাসানকে (৪২) পুলিশ সোমবার (২১ ফেব্রুয়ারি) রাতে গ্রেফতার করেছে।
কামরুল আয়কর বিভাগে চট্টগ্রামের কর অঞ্চল-১-এর ১২ নম্বর সার্কেলে উপ-কর কমিশনারের কার্যালয়ে উচ্চমান সহকারী পদে কর্মরত। তার বাসা আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনিতে। বাড়ি নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলায়।
আরও পড়ুন-
- বিদেশি ডাকে পিস্তল: আয়কর কর্মী রিমান্ডে
- বিদেশি ডাকে পিস্তল: আয়কর কর্মচারী গ্রেফতার
- বিদেশি ডাকে পিস্তল: মামলায় আসামি প্রেরক-প্রাপক
- বিদেশি ডাকে গৃহস্থালি পণ্যের চালানে এলো পিস্তল-কার্তুজ
পলাতক রাজীব বড়ুয়ার (৪২) বাসাও আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনিতে ছিল। পুলিশের তথ্য বলছে, রাজিব রাউজান উপজেলার উরকিরচর ইউনিয়নের আবুরখীল গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক ফণীভূষণ বড়ুয়ার ছেলে। তার মা গীতা রাণী বড়ুয়া চট্টগ্রাম কাস্টমসের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা ছিলেন।
রাজীব বড়ুয়াকে নিয়ে তদন্ত প্রক্রিয়ায় যুক্ত একাধিক পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ২৫ জানুয়ারি রাজীব ইতালি থেকে চালানটি কামরুল হাসানের নামে বুকিং দেন। ৪ ফেব্রুয়ারি তিনি দেশে ফেরেন। ৭ ফেব্রুয়ারি তিনি বাংলাদেশি মোবাইল সিম ব্যবহার শুরু করেন। ২০ ফেব্রুয়ারি চালানটি কাস্টমসে স্ক্যানিংয়ের সময় অস্ত্র ধরা পড়ে।
জানতে চাইলে নগর পুলিশের উপকমিশনার (বন্দর) এস এম মেহেদী হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাজীব দেশে ফিরেছেন কি না, আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত নই। আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি। যদি দেশে ফিরে থাকে, তাকে অবশ্যই গ্রেফতার করা হবে। বিদেশে থাকলে ইন্টারপোলের মাধ্যমে গ্রেফতার করে দেশে ফেরানোর চেষ্টা করা হবে। এছাড়া অস্ত্রগুলো কী উদ্দেশ্যে দেশে আনা হয়েছে, কারা কারা এর সঙ্গে জড়িত— এসব আমরা তদন্ত করে বের করব এবং জড়িতদের আইনের আওতায় আনব।’
এদিকে, কামরুলকে গ্রেফতারে নেতৃত্ব দেওয়া নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (ডবলমুরিং জোন) আরিফ হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে কামরুল দাবি করেছেন, চালানটি তার নামে এলেও সেখানে অস্ত্র থাকার বিষয় তিনি জানতেন না। রাজীব তাকে ক্রোকারিজের একটি চালান আসার কথা বলেছিলেন।’
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, কামরুল ও রাজীব ১৯৯৪ সাল থেকেই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। রাজীব একসময় যুবদল করতেন। কামরুলের পুরো পুরিবারও বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। কেবল তার এক ছোট ভাই নগর ছাত্রলীগের পদে আছেন। রাজীব দেশে ফেরার পর কয়েকবার কামরুলের সঙ্গে দেখা করেন। সবশেষ গত শনিবারও তিনি কামরুলের সঙ্গে দেখা করার জন্য সিজিএস কলোনিতে গিয়েছিলেন। তবে তাদের মধ্যে দেখা হয়নি।
‘কামরুল অস্ত্রের বিষয়টি অবগত না থাকার যে দাবি করেছেন, সেটিও মিথ্যা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ চালানে কামরুলের যে মোবাইল নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে সেটি তার মায়ের সিম। সুনির্দিষ্ট কোনো উদ্দেশ্য না থাকলে নিজের নম্বর বাদ দিয়ে মায়ের মোবাইল নম্বর ব্যবহারের কথা নয়। কামরুল অপরাধী না হলে চালানটি আটকের পর তার দু’টি মোবাইল নম্বর বন্ধ করে পালিয়ে গিয়েছিলেন কেন, সেটিও বড় প্রশ্ন,’— বলছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
রাজীব যে দু’টি অস্ত্র এনেছেন সেগুলো অত্যাধুনিক, স্বয়ংক্রিয় এবং দামি— এমন তথ্য জানিয়ে পুলিশ কর্মকর্তারা আরও বলছেন, ইতালিতে এগুলোর একেকটির দাম ৪০ হাজার টাকার মতো হতে পারে। তবে দেশে একেকটির দাম কমপক্ষে আট লাখ টাকা।
নিছক অর্থের জন্য রাজীব অস্ত্রগুলো এনেছেন নাকি এর সঙ্গে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির কোনো উদ্দেশ্য আছে— এ বিষয়টি খতিয়ে দেখার কথা বলেছেন উপপুলিশ কমিশনার এস এম মেহেদী হাসান।
বিভিন্ন সময় নগর গোয়েন্দা পুলিশ ও নগরীর একাধিক থানায় দায়িত্ব পালন করা কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রয়াত ছাত্রদল নেতা টিংকু দাসের হাত ধরে নব্বইয়ের দশকে সংগঠনটিতে জড়ান রাজীব। একপর্যায়ে আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনি এলাকায় একটি বড় গ্রুপ গড়ে তুলে এর নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় ছিলেন তিনি। জড়িয়ে পড়েন বিভিন্ন অপরাধেও।
২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাজীব আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। ওই সময় রাজীব ‘যুবদল ক্যাডার’ হিসেবে পরিচিতি পান। বর্তমানে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি থানা যুবদলের আহ্বাবায়কের দায়িত্ব পালন করা অরূপ বড়ুয়ার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। সে সময় একটি অস্ত্র মামলায় জড়িয়ে জেলেও যান। ডবলমুরিং ও বায়েজিদ বোস্তামি থানায় কয়েকটি মামলায় আসামি হন।
২০০৬ সালে জোট সরকার বিদায় নেওয়ার পর ওয়ান-ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল থেকে ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হতে শুরু করেন রাজীব। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে প্রথমে ভারতে যান। ২০১১ সালে ভারত থেকে লিবিয়া হয়ে যান ইতালিতে। গত ১১ বছরে কেবল একবার দেশে ফিরে বিয়ে করে আবার দ্রুতই ইতালি ফিরে যান তিনি। ২০১৪ সালে নগর গোয়েন্দা পুলিশের রাজনৈতিক পরিচয়ধারী সন্ত্রাসীদের একটি তালিকায় রাজীব বড়ুয়ার নাম ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ছিল।
নগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার (বন্দর) এ কে এম মহিউদ্দিন সেলিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাজীব ক্যাডারভিত্তিক রাজনীতি করত। যুবদল করত। টিংকু দাশদের একই গ্রুপে ছিল। তার বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা হয়েছিল। পরে সে দেশে ছেড়ে চলে গিয়েছিল।’
তবে রাজীব বড়ুয়ার বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেফতারি পরোয়ানা কিংবা সাজা পরোয়ানা সংক্রান্ত কোনো তথ্য সিএমপির হালনাগাদ তালিকায় নেই বলে জানিয়েছেন সহকারী পুলিশ কমিশনার (ডবলমুরিং জোন) আরিফ হোসেন।
এদিকে, যুবদল নেতারা বলেছেন, রাজীব বড়ুয়া কখনোই তাদের সংগঠনের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। যুবদলের কোনো কমিটিতে তার কোনো পদ-পদবি ছিল না।
বায়েজিদ বোস্তামি থানা যুবদলের আহ্বায়ক অরূপ বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি বড়ুয়া, উনিও বড়ুয়া— সেজন্য হয়তো আমার সঙ্গে মেলাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে আমি রাজীব বড়ুয়াকে চিনিই না। নব্বই পরবর্তী যারা চট্টগ্রাম শহরে ছাত্রদল-যুবদল করেছে, আমি কমবেশি সবাইকে চিনি। কিন্তু সিজিএস কলোনির বা বায়েজিদের কোনো রাজীব বড়ুয়াকে আমি চিনি না।’
নগর যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ শাহেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাজীব বড়ুয়া নামে কেউ আমাদের নগর যুবদল, থানা, ওয়ার্ড কিংবা ইউনিটের কোনো কমিটিতে নেই। এ নামে কাউকে আমরা চিনি না।’
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে নগর পুলিশের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ে আগ্রাবাদ সিজিএস কলোনিকেন্দ্রিক যুবলীগের একটি গ্রুপের সঙ্গে রাজীবের সখ্য গড়ে ওঠে, যাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে টেন্ডারবাজির অভিযোগ আছে। চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের একজন সহসভাপতির অনুসারী হিসেবে তারা নিজেদের পরিচয় দেয়।
সারাবাংলা/আরডি/টিআর