যুদ্ধে টালমাটাল বিশ্ববাজার, প্রভাব পড়তে পারে দেশেও
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ২৩:৪৫
ঢাকা: ২০২২ সালের শুরু থেকেই রাশিয়া আর ইউক্রেনের কূটনৈতিক সম্পর্ক যুদ্ধ পরিস্থিতিতে রূপ নিয়েছিল। গতকালই তা পরিণত হয়েছে বাস্তবতায়। প্রথম ধাক্কায় ইউক্রেনের লণ্ডভণ্ড হয়ে গেলেও যুদ্ধের দ্বিতীয় ধাক্কা এসে লেগেছে বিশ্ববাজারে। পুঁজিবাজার থেকে শুরু করে পেট্রোল, সোনা, এমনকি ভোগ্যপণ্যের দামেও প্রড়েছে যুদ্ধের প্রভাব। বিশ্লষকরা বলছেন, যুদ্ধ দীর্ঘায়িত এবং আরও বিস্তৃত হলে অর্থনৈতিক মন্দায় নাকাল হতে হবে বিশ্ববাসীকে।
করোনা মাহামারির কারণে গেল দুই বছর তেলের ব্যবহার কমে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম ছিল কম। এমনিতেও গেল সাত বছরের ব্যারেলপ্রতি তেলের দাম ১০০ ডলার পার হয়নি একবারও। অথচ পূর্ব ইউরোপে যুদ্ধ শুরুর এক ঘণ্টার মধ্যে তেলের দাম ১০০ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। অল্প করে হলেও বাড়তির গ্রাফ এখনো ঊর্ধ্বমুখী। আল জাজিরা, আরব নিউজ সহ মধ্যপ্রাচ্য ভিত্তিক গণমাধ্যমগুলো বলছে, তেলের দাম আরও বাড়বে!
এরই মধ্যে ইউরোপের মূল ভূখণ্ডে জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১০৬ ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এশিয়াতেও প্রতি ব্যারেল অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে ১০২ ডলারে উঠেছে। অথচ এই জানুয়ারি মাসেও এর দাম ছিল প্রতি ব্যারেলে মাত্র ৬৮ ডলার। ২০১৪ সালের পর এবারই প্রথম এশিয়ায় তেলের দাম ১০০ ডলারে উঠল।
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও বাংলাদেশের তেলের এই দামের প্রভাব না পড়লেও পকিস্তানে এরই মধ্যে প্রতি লিটারে ৭ টাকা দাম বাড়ানো হতে পারে বলে দেশটির পত্রিকাগুলোতে খবর বেরিয়েছে। এর আগে এই ফেব্রুয়ারিতেও অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর এই দেশটিতে তেলের দাম ১২ টাকা বাড়ানো হয়েছিল। এবার দাম বাড়ানো হলে এটি হবে এক মাসের মধ্যে তাদের দ্বিতীয় দফায় জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ঘটনা।
তবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দুই অর্থনৈতিক শক্তি বাংলাদেশ ও ভারতের বাজারে তেলের দাম বাড়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ঢাকা ও দিল্লির কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সূত্রগুলোও তেমনটিই বলছে। ভারতের এনডিটিভির অনলাইন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দাম না বাড়লেও তেলের সরবরাহে প্রভাব পড়তে পারে।
এদিকে কেবল তেলের দামই নয়, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে সোনা ও গ্যাসের বাজারও অস্থির। গত একদিনে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বেড়ে গেছে ১২ শতাংশ। সোনার দাম আউন্সপ্রতি (২৮ দশমিক ৪ গ্রাম) ২ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়ে ১ হাজার ৯৬৮ ডলারে উঠে গেছে। মার্চে সরবরাহের জন্য প্রতি আউন্স রুপার দাম ৮৭ সেন্ট বেড়ে হয়েছে ২৫ ডলার ৪৩ সেন্ট।
ব্লুমবার্গ পত্রিকা বলছে, বৃহস্পতিবার ওয়ালস্ট্রিটে সোনার দাম প্রতি আউন্স ১ হাজার ৯১১ ডলার ৫০ সেন্ট দিয়ে শুরু হলেও তা দিনশেষে দাঁড়ায় ১ হাজার ৯৭৬ ডলার ৫০ সেন্টে। এ সময় স্পট মার্কেটে সোনার দাম ২ দশমিক ১ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় প্রতি আউন্স ১ হাজার ৯৭০ ডলার। এটি স্পট মার্কেটে এক বছরের মধ্যে সোনার সর্বোচ্চ দাম।
এদিকে, যুদ্ধর প্রভাব পড়েছে বিভিন্ন ভোগ্যপণ্যেও। রাশিয়ার হামলার প্রথম দিন বৃহস্পতিবার থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন, পাম, গমসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছে। অনেক পণ্যে প্রতি টনে ১০০ ডলার পর্যন্ত দাম বেড়েছে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বলছেন, এর প্রভাবে দেশের ভেতরে বেশ ভালোভাবেই পড়তে পারে।
বাংলাদেশের ভোগ্যপণ্যের বাজার বেশিরভাগটাই মূলত আমদানিনির্ভর। আন্তর্জাতিক বাজারে আগে থেকেই দাম বেড়ে যাওয়ার প্রভাবে দেশের বাজারে সপ্তাহখানেক ধরেই ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছিল। বৃহস্পতিবার যুদ্ধ শুরুর পর সেটি যেন নতুন মাত্র পেল। কেবল পণ্যের দাম বাড়ার কারণে নয়, তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে জাহাজে করে পণ্য আমদানিতেও খরচ বাড়বে, যার সরাসরি প্রভাব পড়বে বাজারে।
এছাড়া যেসব পণ্য রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে আমদানি করেন বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা, সেসবের আমদানিই এখন বন্ধ হওয়ার উপক্রম। এমনকি জাহাজে অপেক্ষমাণ অনেক ভোগ্যপণ্যও আটকে রয়েছে দেশ দু’টির বন্দরগুলোতে। এসব পণ্যের মধ্যে রয়েছে গম ডাল ও সরিষার মতো নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় পণ্যও।
বাংলাদেশের ভোক্তারা ভোজ্যতেলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেন পাম ও সয়াবিন তেল। বৃহস্পতিবার টন প্রতি ১ হাজার ৫০০ ডলারের পামের দাম উঠেছে ১ হাজার ৮০০ ডলারে। খুব বেশি পরিমাণে না হলেও দাম বেড়েছে সয়াবিনেরও। গমের দাম টন প্রতি ৪০০ ডলার থেকে বেড়ে ৫০০ ডলারে উন্নীত হয়েছে।
পুরনো ঢাকায় পণ্য আমদানিকারক চাঁন ট্রেডার্সের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খাদ্যপণ্যের বড় বাজার রাশিয়া ও ইউক্রেন। বাংলাদেশ এই দু’টি দেশ থেকে বেশ বিপুল পরিমাণে খাদ্যপণ্য কেনে প্রতিবছর। এই দু’টি দেশই নিজেদের মধ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় খাদ্যপণ্য আমদানির জন্য বড় ধাক্কা। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে দেশীয় বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাবে।
আমদানিকারক মোহাম্মদ তারিক বলেন, যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেলের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় শিপিং চার্জ বেড়ে যাবে। এর প্রভাব পড়বে বাজারে। ব্যবসার ক্ষেত্র বিশ্বের অন্য সংকট নিজ দেশে প্রভাব ফেলে। বাজারে অস্থিরতার কারণ এটাই।
তবে এই দুই ব্যবসায়ীর বিপরীত কথা বলেছেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (পরিবহন) এনামুল করিম। তিনি বলেন, এখনই পণ্যের বাজারে যুদ্ধের প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা নেই। রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে বাংলাদেশ যে পণ্যগুলো আমদানি করে, তার বিশাল অংশ এরই মধ্যে আমদানি করা হয়েছে। এমনকি ২০২১-২২ অর্থবছরের এখনো পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ভোগ্যপণ্য আমদানি স্বাভাবিক ছিল।
তিনি জানান, এই অর্থবছরে মটর ডাল আমদানি হয়েছে তিন লাখ টন। ছোলা আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৪২ হাজার টন। সয়াবিন আমদানি হয়েছে ১১ লাখ ৬২ হাজার টন। সরাসরি সয়াবিন তেলের আমদানিও এবার বেড়েছে। এই হিসাবকে এখন পর্যন্ত স্বাভাবিক বলছেন তিনি। তবে যুদ্ধ পরিস্থিতি দীর্ঘ হলে পরিস্থিতি এমন নাও থাকতে পারেন বলে জানিয়েছেন এনামুল করিম।
যুদ্ধের প্রভাব বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক আবুল বারাকাত সারাবাংলাকে বলেন, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার শঙ্কা সবসময়ই থাকে। বিশেষ করে আমদানিনির্ভর বাজারে যুদ্ধের প্রভাব পড়ে বেশি। সেক্ষত্রে একই পণ্যের ভিন্ন বাজার খুঁজতে হবে। পণ্য আমদানিতে নিকটবর্তী দেশগুলো বিকল্প বাজার হিসেবে ব্যবহার করতে হবে।
এদিকে পূর্ব ইউরোপের যুদ্ধের আঁচ বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বেশ ভালোভাবেই লেগেছে। সপ্তাহের শেষ দিন গতকাল বৃহস্পতিবার বড় দরপতন হয়েছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে। যুদ্ধ শুরুর সময়ে ডিএসইএক্স সূচক যেখানে ৬ হাজার ৯৪৮ পয়েন্টে ছিল, দিনের শেষে সেই সূচক দাঁড়ায় ৬ হাজার ৮৩৯ দশমিক ৪৪ পয়েন্টে। শতাংশের হিসাবে এই পতন গত চার মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এর আগে এর চেয়ে বেশি পতন হয়েছিল গত বছরের ২৫ অক্টোবর।
বৈশ্বিক শেয়ার বাজারের দৃশ্যও অনেকটা এমনই। জাপানের টোকিও স্টক এক্সচেঞ্জের নিক্কি ২২৫ সূচক ১ দশমিক ৮১, হংকংয়ের হেংসেং সূচক ৩ দশমিক ৮১, ভারতের বোম্বাই স্টক এক্সচেঞ্জের সেনসেক্স সূচক ৪ দশমিক ৭২, চীনের সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জের সমন্বিত সূচক ১ দশমিক ৭১ এবং দক্ষিণ কোরিয়ার কোস্পি সূচক ২ দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে।
এছাড়াও ইউরোপের মধ্যে যুক্তরাজ্যের লন্ডনের এফটিএসই ১০০ সূচক ৩ দশমিক ২৭ ও এফটিএসই ২৫০ সূচক শূন্য দশমিক ৭২, নেদারল্যান্ডসের এইএক্স সূচক ৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ, ফ্রান্সের প্যারিসের সিএসি ৪০ সূচক ৪ দশমিক ৯৩, জার্মানির ফ্রাংকফুর্টের ড্যাক্স সূচক ৫ দশমিক ৫ এবং ইউরো স্টকস সূচক ৪ দশমিক ৯৯ শতাংশ কমেছে।
সারাবাংলা/টিএস/টিআর
ইউক্রেনে হামলা বাজারে প্রভাব যুদ্ধ পরিস্থিতি রুশ আগ্রাসন রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ