পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রভাব ফেলতে পারে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ
১ মার্চ ২০২২ ২২:১৪
ঢাকা: চলছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভসহ বড় বড় শহরগুলোতে রুশ ও ইউক্রেনীয় সেনাদের লড়াই এখন তুঙ্গে। যদিও সংঘাত বন্ধে ইতোমধ্যে দেশ দুটির মধ্যে বেলারুশে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু সেই বৈঠকের ফলাফল এখনো ইতিবাচক নয়। এদিকে আন্তর্জাতিক আর্থিক লেনদেন ব্যবস্থা ‘সুইফট’ থেকে রাশিয়ার কয়েকটি ব্যাংককে বিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের মিত্র দেশগুলো। এমন পরিস্থিতিতে দেশটি ভবিষ্যতে আর্থিক সংকটে পড়তে পারে বলে মত আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের।
আর এ নিয়ে বড়ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের। কারণ, দেশের প্রথম এবং একমাত্র পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত রাশিয়া। পরিকল্পনা অনুযায়ী, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের যন্ত্রাংশ, বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থায়ও থাকছে রাশিয়া। এই সম্পৃক্ততায় দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বড়ধরনের আর্থিক লেনদেন তৈরি হচ্ছে। যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না।
দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় একক প্রকল্প ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র’। পাবনার ঈশ্বরদীতে ২০০৯ সালে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। রাশিয়ার রোসাটোম স্টেট অ্যাটমিক এনার্জি করপোরেশন নির্মাণাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২০২৩ সালের এপ্রিলে জাতীয় গ্রিডে পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ সরবহারের লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে। আর রূপপুর কর্তৃপক্ষ বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে চায় ২০২৪ সাল থেকে।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের সিংহভাগ কাজ শেষের দিকে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালেই পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু করা যাবে। তবে নির্মাণ শেষ করেই রাশিয়ার দায়িত্ব শেষ হচ্ছে না। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত থাকবে দেশটি। শুধু তাই নয়, এই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে ইউরিনিয়াম দরকার হবে তার যোগানও দেবে রাশিয়া। থাকবে ব্যবস্থাপনাতেও। সব মিলিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক লেনদেনের একটি ক্ষেত্র দীর্ঘ সময়ের জন্য তৈরি হচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন পরিস্থিতি যদি অব্যাহত থাকে তাহলে তাদের ব্যাবসা বিনিয়োগেও প্রভাব পড়তে শুরু করবে। সেক্ষেত্রে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি যথাসময়ে চালু করা যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে রাশিয়ার আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। যার প্রভাব তাদের বৈদেশিক বিনিয়োগ পড়ার আশঙ্কা তৈরি হতে পারে। অর্থনীতি খারাপের দিকে গেলে বাংলাদেশে নির্মাণাধীন রূপুপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত কর্মী ও নির্মাণ সামগ্রী সরবরাহ কঠিন হয়ে পরার আশঙ্কা রয়েছে।
তবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে থাকা রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি রোসাটম এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণকাজে কোনো ধরনের ব্যাঘাত ঘটনার আশঙ্কা তারা করছে না। তারা যে প্রতিশ্রুতি নিয়ে কাজ করছে, তার কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না।
এ প্রসঙ্গে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বাংলাদেশের অন্যতম বড় এবং ব্যয়বহুল প্রকল্প। এটি দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। যেখানে রাশিয়া প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে এবং দেশটির অর্থনীতি এখানে জড়িত। সেক্ষেত্রে চলমান যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পে প্রভাব পড়তে পারে। তবে এরই মধ্যে যদি বিষয়টি মীমাংসা হয়ে যায় তাহলে প্রভাব পড়বে না। আর যদি যুদ্ধ দীর্ঘ হয় তাহলে রাশিয়া অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল পড়তে পারে। সে কারণেও তাদের দিক থেকে প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্ব হতে পারে। সেটা এখনি বলা যাচ্ছে না। বিষয়টা নির্ভর করবে কতদিন যুদ্ধ চলবে এবং সার্বিক অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তার ওপর।’
বাংলাদেশ তেল গ্যাস খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাব কিছুটা হলেও তাদের বিনিয়োগে প্রভাব ফেলবে। তবে বিনিয়োগ বন্ধ করবে না। কারণ, রাশিয়ার ঋণের ব্যবসা রয়েছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ সামগ্রী বিক্রি ও তাদের নাগরিকদের চাকরির বিষয়ও জড়িত। সেহেতু রাশিয়া এই ব্যবসা সহজেই গুটিয়ে নেবে না। তবে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্ব হবে। এতে আর্থিক বোঝা বাড়বে। বলতে গেলে বাংলাদেশের ঘাড়েই বিপদের বোঝাটা পড়বে।’
তবে যুদ্ধের কারণে এখনই প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখছেন না নীতি নির্ধারকরা। সরকারের মন্ত্রীরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রভাব ফেলবে না। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এ নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, ‘এটি একটি পরিরিকল্পিত প্রকল্প। সেভাবে এগোচ্ছে। আশা করছি, যুদ্ধের কোনো প্রভাব এ প্রকল্পে পড়বে না ‘
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বিষয়টি গভীর পর্যবেক্ষণে রেখেছে বাংলাদেশ। বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক করেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। এ প্রসঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জিয়াউল হাসান সারাবাংলা বলেন, ‘রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের আর্থিক ও কারিগরি দু’দিকেই সহযোগিতা দিচ্ছে রাশিয়া। ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এলেও পরবর্তী সময়ে রাশিয়া এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। যেহেতু একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সেজন্য বিষয়টি মাথায় রেখে প্রকল্প পরিচালককে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে যেতে বলা হয়েছে।’
এদিকে, আগামী বছর উৎপাদনে যাওয়ার লক্ষ্যে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ চলছে পুরোদমে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল অংশ রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল বা পরমাণু চুল্লিপাত্র বসানোর কাজ শেষ। প্রকল্প সুত্রে জানা গেছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পুরোপুরি নির্মাণ শেষ হওয়ার পর প্ল্যান্টের কমিশনিং বা সচল হওয়া শুরু হবে। সচল হলে রিঅ্যাকশন শুরু হবে। অর্থাৎ প্ল্যান্টের কাজ শেষ হলেও তা পরিচালনার জন্য যেসব আয়োজন থাকে তা শেষ করতে দীর্ঘ সময় দরকার। আর এসব ব্যবস্থাপনায় থাকবে রাশিয়ান কর্মীরা। যারা রাশিয়ার বেতনভুক্ত। দেশটিতে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিলে এসব কর্মীদের বেতন ভাতা, প্ল্যান্টের নিমার্ণ সামগ্রী ও উৎপাদনের জ্বালানি সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
উল্লেখ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করছে রাশিয়া। দেশটির ১৮টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এই কাজে যুক্ত। আর তত্ত্বাবধানে রয়েছে রাশিয়ান প্রতিষ্ঠান রোসাটম। প্রায় ২৫ হাজার কর্মী বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে নিয়োজিত রয়েছেন। এর মধ্যে পাঁচ হাজার কর্মীই রাশিয়ার।
সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম