Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মূল মঞ্চে শ্রোতা নেই, লিটল ম্যাগে ক্রেতা নেই

আসাদ জামান
২ মার্চ ২০২২ ২৩:৪৯

রিকশা থেকে টিএসসি মোড়ে নেমে বাংলা একাডেমির দিকে যাওয়ার সময় কিছুটা নস্টালজিয়া পেয়ে বসল। আজ থেকে বছর চারেক আগেও মেলার সময় এই সড়কটিতে যে ‘মেলা’ ‘মেলা’ গন্ধ পাওয়া যেত, সেটি আর এখন নেই। সড়কে মেট্রোরেলের নির্মাণ সামগ্রী, ইট-পাথর-কংক্রিটের জঞ্জাল, নিরাপত্তা প্রাচীর, টেম্পোরারি সড়ক বিভাজন, সর্বোপরি মাথার ওপর মেট্রোরেলের দানবীয় স্টেশন মস্তিষ্কে আতঙ্কের বার্তা পাঠায়।

এ কারণেই কাব্যিক ভঙ্গিমা ছেড়ে অনেকটা ত্রস্তপদে দ্রুত বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ঢুকে পড়লাম। আর্চওয়ে পাড় হওয়ার পরই মেলার মূল মঞ্চের মাইক থেকে ভেসে এলো— ‘আপনারা এতক্ষণ যারা ধৈর্যসহকারে আলোচনা শুনলেন, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আর যারা আলোচনায় অংশ নিলেন, তাদেরকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি।’

বিজ্ঞাপন

কণ্ঠ পরিচিত মনে হলো। সামনে একটু অগ্রসর হতেই দেখলাম— কথাসাহিত্যিক ও মনোবিজ্ঞানী আনোয়ারা সৈয়দ হক। অমর একুশে বইমেলার ১৬তম দিন বুধবার (২ মার্চ) মূলমঞ্চে ‘রশীদ হায়দার ও ফরহাদ খান’ শীর্ষক যে আলোচনা সভা ছিল, সেটিতে সভাপতিত্ব করছিলেন তিনি।

এসময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন তিন জন— দু’জন আলোচক, আরেকজন প্রবন্ধ উপস্থাপক। মঞ্চের দিকে আরেকটু এগোতে তাদেরও চিনতে অসুবিধা হলো না। লাল জামা পরা চিরচেনা চিরসবুজ মানুষটির নাম মনি হায়দার, কালো পাঞ্জাবি পরা মানুষটি ইমতিয়ার শামীম, আর নীল শার্ট পরা লোকটি মোজাফফর হোসেন। তিন জনই আধুনিক বাংলা গদ্যের সার্থক শ্রমিক।

কিন্তু এই গদ্যশিল্পীদের জ্ঞানগর্ভ আলোচনা এবং এই আলোচনা থেকে সাহিত্য রস আস্বাদনের জন্য শ্রোতা বা দর্শক ছিলেন মাত্র জনা পঁচিশেক। এদের মধ্যে শব্দযন্ত্র নিয়ন্ত্রণ এবং বাংলা একাডেমির নিজস্ব ক্যামেরা ক্রু বাদ দিলে নিরেট-নিপাট দর্শকের সংখ্যা মেরেকেটে ১৫ জনের বেশি হবে না। ফলে ৩০০ আসন ধারণক্ষমতার এই প্যান্ডেলে রাখা চেয়ারগুলো প্রায় একেবারেই ফাঁকা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আর ওই ১৫ জন দর্শক না থাকলে মঞ্চে থাকা চার জনের অবস্থা কী দাঁড়াত, সেটি ভাবলে…।

বিজ্ঞাপন

মূল মঞ্চের আলোচনায় এই দর্শক খড়া সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া বা মন্তব্য জানতে চাইলে মেলা শেষে আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন, ‘দর্শকরা তো আসছে না। আসবে কী করে— মেলাকে এমনভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যে ওদিকে ঘোরাঘুরি শেষে কেউ আর এদিকে আসতে চায় না!’

‘আয়োজকদেরও গাফিলতি আছে। এখানে (মূল মঞ্চে) যে আলোচনাটা হবে, তা নিয়ে এদের কোনো প্রচারণা নেই। কোনো অ্যানাউন্সমেন্ট নেই। আর যাদের (রশীদ হায়দার ও ফরহাদ খন) নিয়ে আলোচনা, তাদের পরিবার পরিজনকেও বোধ হয় বলা হয়নি। তাদের বললে হয়তো তারা আসতেন এবং আলোচনা শুনতেন,’— বলেন আনোয়ারা সৈয়দ হক।

‘আঁতেল’ হলো আধুনিক বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত একটি ফরাসি-ভাষা-আগত বিশেষ্য ও বিশেষণবাচক শব্দ, যা ‘বুদ্ধিজীবী’ বা ‘ইন্টেলেকচুয়াল’ (intellectual) শব্দের অপভ্রংশ। আভিধানিক অর্থে ‘আঁতেল’ হলেন পণ্ডিত, বিদ্বান, বুদ্ধিজীবীর ধরনধারণবিশিষ্ট ব্যক্তি, যা ফরাসি তেঁলেক্তুয়াল (tellectual)-এর অপভ্রংশ, কিংবা ইংরেজি Intellectual-এর ফরাসিভঙ্গিম উচ্চারণ থেকে আগত।

পুঁথিগত বিদ্যায় পারদর্শী তবে বাস্তববুদ্ধি ও কাণ্ডজ্ঞানের অভাব— এমন ব্যক্তিদেরই ‘আঁতেল’ বলা হয়। ভাষাতত্ত্ববিদ পবিত্র সরকারের মতে, চল্লিশ-পঞ্চাশের দশকে এক শ্রেণির বুদ্ধিজীবী বাঙালির আত্মপ্রকাশ ঘটে, যারা নিয়মিত কফি হাউজে বসতেন, পাঞ্জাবি পরতেন ও নিজেদের সেরা মনে করতেন। এসব বুদ্ধিজীবীকে দেখে অন্যান্যদের বিদ্রুপ এবং প্রতিক্রিয়াতেই ‘আঁতেল’ শব্দটির প্রয়োগ শুরু।

মেলা মূল মঞ্চ থেকে হঠাৎ কেন ‘আঁতেল’ নিয়ে কথা? হ্যাঁ, বলছি। তার আগে ‘কর্ষণ’, ‘লিরিক’, ‘পাতাদের সংসার’, ‘অনুভূতি’, ‘ডানার করাত’, ‘একবিংশ’, ‘কবিতা পত্র’, ‘ক্ষ্যাপা’, ‘দেয়াঙ’, ‘লেখামালা’, ‘চিহ্ন’, ‘অতিত্রাক্ষর’, ‘পুনশ্চ’, ‘জয়ধ্বনি’, ‘কবিতা বাংলা’, ‘মেঘফুল’, ‘চারবাক’, ‘পরণ কথা’, ‘অলিক’, ‘ম্যাজিক লন্ঠন’, ‘মাদুলি’, ‘আলোক’, ‘চর্যাপদ’, ‘জলছবি’, ‘সময়চিহ্ন’, ‘ঘুংঘুর’, ‘সৌম্য’, ‘ডাকটিকিট’, ‘সময় আনন্দ’, ‘নিমন্ত্রণ’, ‘কাঁচামাটি’, ‘প্রত্যাশা’, ‘রৌদ্দুর’, ‘দোয়েল’, ‘চন্দ্রবিন্দু’, ‘ডাহুক’, ‘কবি’, ‘সরলরেখা’ ‘লোক’, ‘মেঘ’, ‘নিসর্গ’, ‘শালুক’ ও ‘একান্নবর্তী’-এর সঙ্গে একটু পরিচিত হয়ে নিই। এখানে যেসব ‘নামপদ’ বা ‘বিশেষ্যগুলো’র কথা উল্লেখ করা হলো, এদের প্রত্যেকেই একেকটি লিটল ম্যাগের নাম।

এই নামগুলোর মধ্যেই কেমন যেন এক ধরনের আঁতেল আঁতেল গন্ধ আছে! অর্থাৎ বুদ্ধিজীবী ধরনধারণবিশিষ্ট ব্যক্তিদের মস্তিষ্কজাত না হলে লিটল ম্যাগের নাম ‘পাতাদের সংসার’, ‘ক্ষ্যাপা’, ‘ডানার করাত’ হতো না। তবে নাম যাই হোক, ভেতরে যাই থাকুক, নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো প্রকৃতির মানুষগুলোর ‘শালুক’, ‘লোক’, ‘লিরিক’, ‘মাদুলি’ নিয়ে ক্রেতাদের যে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই, সেটি বোঝা গেল মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশের লিটল ম্যাগ চত্বরে ক্রেতাশূন্য অবস্থা দেখে।

ঘণ্টাখানেক সময় নিয়ে প্রায় প্রতিটি স্টল তন্ন তন্ন করে খুঁজেও লিটল ম্যাগের একজন ক্রেতাও পাওয়া যায়নি। স্টলে বিক্রয়কর্মী, সম্পাদক-প্রকাশক অথবা নাম না জানা কবি-লেখকদেরই আনাগোনা। নিজেরা নিজেদের মধ্যে গল্প-গুজবে ব্যাস্ত তারা।

বহুদিনের পুরোনো প্রসিদ্ধ লিটল ম্যাগ ‘লিরিক’-এর স্টলে চার কপি ‘লিরিক’ নিয়ে বসে আছেন সম্পাদক এজাজ ইউসুফী। সত্তরোর্ধ্ব এ মানুষটি কীসের প্রয়োজনে চারখানা ‘লিরিক’ নিয়ে বসে আছেন, তা তিনিই ভালো জানেন। হয়তো এর মধ্যেই তার সুখ, এর মধ্যেই তার পরমানন্দ।

লিরিকের ক্রেতা পাওয়া গেলো কি না— জানতে চাইলে সারাবাংলাকে এজাজ ইউসুফী বলেন, ‘হ্যাঁ, গতকাল পাঁচ কপি বিক্রি হয়েছে। কিন্তু আজ এখন পর্যন্ত কোনো কপি বিক্রি হয়নি। তবে লিরিককে যারা চেনে, তারা অবশ্যই মেলায় এসে কপি সংগ্রহ করবে।’

আরেকটি প্রসিদ্ধ লিটিল ম্যাগ ‘লোক’-এর স্টলও ক্রেতাশূন্য, খাঁ খাঁ মরুভূমি যেন। লোকের বিক্রয়কর্মী বোরহান মাসুদ সারাবাংলাকে জানান, বুধবার একটি কপিও বিক্রি করতে পারেননি তিনি। লিটল ম্যাগ ‘শালুক’-এর অবস্থাও একই রকম। এর বিক্রয়কর্মীও জানান, গত কয়েক দিনে একটি কপিও বিক্রি হয়নি।

অপেক্ষাকৃত তরুণ সম্পাদক অরবিন্দু চক্রবর্তী সম্পাদিত লিটল ম্যাগ ‘মাদুলি’র অবস্থাও ‘শালুক’ বা ‘লোক’-এর থেকে ব্যতিক্রম নয়। প্রায় ৮০০ পৃষ্ঠার বিশালাকৃতির এই লিটল ম্যাগটির গায়ের মূল্য ধরা হয়েছে ১০০০ টাকা। সুতরাং এর ধারের কাছে যে ক্রেতা সাধারণ ভিড়বে না, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

লিটল ম্যাগ প্রকাশের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইলে অরবিন্দু চক্রবর্তী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আসলে ভালো লাগা, ভালোবাসা এবং সাহিত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে লিটল ম্যাগ করি। অনেক বিক্রি বা এ থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার প্রবণতা আমাদের মধ্যে কাজ করে না। তবে একে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সাধারণ ক্রেতা ও পাঠকদের সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন।’

সারাবাংলা/এজেড/টিআর

অমর একুশে গ্রন্থমেলা বইমেলা বইমেলা ২০২২ লিটল ম্যাগ

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর