ব্যবসায়ীরা জমিয়ে রাখছে তেল, রমজানে বিপর্যয়ের আশঙ্কা
৪ মার্চ ২০২২ ২২:২১
ঢাকা: রাজধানীর সূত্রাপুর বাজারে সয়াবিন তেল কিনতে এসে রীতিমতো বিপাকে পড়েছেন গৃহিনী মরিয়ম আক্তার। হাজী স্টোরে খোলা সয়াবিনের দাম রাখা হচ্ছে ১৭৮ টাকা। মরিয়ম বলছেন, ‘খোলা তেলের দাম সরকার বেঁধে দিয়েছে ১৪৩ টাকা। আপনার পাইকারি দোকান। তাই আপনি আমার কাছ থেকে ১৪৩ টাকা রাখবেন। কিন্তু আপনি ১৭৮ টাকা নিচ্ছেন কেন?’ এ নিয়ে উভয়ের মধ্যে তুমুল হট্টগোল বেধে যায়। অবশেষে তেল না নিয়েই চলে যান মরিয়ম।
শুক্রবার (৪ মার্চ) সকালে মরিয়ম সারাবাংলাকে বলেন, ‘পাইকারি ১৭৮ টাকা হলে খুচরা দোকানে আরও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে খোলা সয়াবিন তেল। এই তো কয়েক মাস আগেও একই তেল কিনেছি মাত্র ৭৬ টাকা থেকে ৮৫ টাকার মধ্যে। কি কারণে এই তেলের দাম বাড়ানো হলো তা বুঝে উঠতে পারছি না। আমরা যারা দিন আনি দিন খাই বিশেষ করে তারা না পারছি মরতে, আর না পারছি বাঁচতে। ১৪৩ টাকা কোথায় আর ১৮০ টাকা কোথায়? মনে হচ্ছে সরকারের কোনোপ্রকার বাজার মনিটরিং নেই।’
সূত্রাপুর বাজারের আরেক ক্রেতা নজরুল ইসলাম মানিক বলেন, ‘বোতলজাত তেল বিক্রি হচ্ছে ১৭০ থেকে ১৭৫ টাকা লিটার। বোতলে ৯০০ মিলি গ্রাম তেল থাকে। সেই হিসেবে খোলা আর বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম একই দাঁড়ায়। অথচ বোতলজাত সয়াবিনের চেয়ে খোলার দাম অনেক কম হওয়া উচিত। অনেক দোকানে গিয়ে তেল চাইলে বলে, খোলা তেল নিলে নেন। বোতলজাত তেল নেই, ফলে বাধ্য হয়ে খোলা তেল কেনেন অনেকে।’
সয়াবিনের বাড়তি বাজার নিয়ন্ত্রণে ‘ভ্যাট’ কমানোর পরামর্শ
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেশিরভাগ ব্যবসায়ী তেল মজুদ করে রেখেছেন। সামান্য কিছু খোলা তেল বাজারে বিক্রি করছেন। আবার বোতলজাত তেলও কিছু দোকানে রেখেছেন। তবে ব্যবসায়ীরা কাস্টমারদের আগে থেকেই বলছেন, ‘কোম্পানি তেল দিচ্ছেন না। কোনো গাড়ি পাঠাচ্ছে না। আমরা তেল পাবো কোথায়? অথচ তারা বাসায়, গুদামে তেল গুদামজাত করছেন।’
কেন এমন করা হচ্ছে জানতে চাইলে ভাই ভাই স্টোরের সেলসম্যান বলেন, ‘রমজানের আগে তেলের দাম ২০০ টাকা হয়ে যাবে, আবার বেশিও হতে পারে। তাই এখন কম দামে কেনা তেল তখন বেশি দামে বিক্রি করা যাবে। এজন্য সবাই তেল মজুদ করছেন।’
প্রায় একই অবস্থা জুরাইন রেলগেট বাজারেও। সেখানেও পাইকারি সব দোকান। দক্ষিণ ঢাকার বেশির ভাগ মুদি দোকানি এখান থেকে পাইকারি মাল কিনে পরে তা খুচরা বিক্রি করেন। অথচ এখানেও খোলা তেল ১৮৫ টাকা বিক্রি হচ্ছে। মুদি দোকানি তা ১৯০ টাকায় বিক্রি করছেন।
কুমিল্লা স্টোর, বিক্রমপুর স্টোর, নোয়াখালী স্টোর, শরীয়তপুর স্টোরসহ এখানকার ব্যবসায়ীরাও বলছেন, ‘কোম্পানি থেকে তেল কম দেওয়া হচ্ছে। আর প্রতিবারই কয়েক পয়সা হলেও দাম বাড়ানো হচ্ছে। এ অবস্থায় রোজার আগে তেলের দাম বাড়বে নাকি কমবে তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।’
কুমিল্লা স্টোরের একজন কর্মচারী বলেন, ‘কোথাও তেল নাই। কাজেই তেলের দাম কমার কোনো সম্ভাবনা নেই। আসন্ন রোজার আগে যে তেলের দাম ২০০ টাকার বেশি হবে তা এরইমধ্যে কোম্পানি থেকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।’
আতিকুর রহমান নামে একজন মুদি দোকানি বলেন, ‘তেল বিক্রি বন্ধ করতে হবে। না হলে বাঁচার কোনো উপায় নেই। একদিকে কেনায় দাম বেশি পড়ছে, অন্যদিকে দাম বেশি নিলে অভিযানে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। তাই তেল বিক্রি না করলে কোনো অসুবিধায় পড়তে হবে না। সরকার কোম্পানিগুলো বা রাঘব বোয়ালদের না ধরে খুচরা পর্যায়ে অভিযান চালায়। দাম তো খুচরা পর্যাযে বাড়ে না কখনও। দাম সবসময়ই পাইকারি পর্যায়ে বাড়ানো হয়ে থাকে।’
সাধারণ ক্রেতারা বলছেন, এক সয়াবিন তেল নিয়েই সাধারণ মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। কিন্তু এরই ফাঁকে সব কিছুর দাম নাগালের বাইরে চলে গেছে। মানুষের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। এরপর যদি আরও দাম বাড়ে তাহলে কিভাবে কি হবে তা বলা মুশকিল। কাজেই আগামী রমজান মাসে যেন তেল নিয়ে অস্থিরতা তৈরি না হয় সেজন্য সরকারের দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর পদক্ষেপ জরুরি।
যদিও বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সী এরইমধ্যে বলছেন, ‘প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিল তেল ১৬৮ টাকা, প্রতি লিটার খোলা তেল ১৪৩ টাকা আর প্রতি লিটার পামওয়েল তেল ১৩৩ টাকা বেঁধে দিয়েছে সরকার। এর বেশি কেউ বিক্রি করলে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। গোয়েন্দাসহ সকল সংস্থাকে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। সবার জায়গা থেকে যেন বাজার মনিটরিং জোরদার করা হয়। একইভাবে সারাদেশে বাজার মনিটরিংয়ের জন্য জেলা প্রশাসকদের বলা হয়েছে। আগামী রমজান উপলক্ষে বাজার যেন অস্থিতিশীল করে তুলতে না পারে সেজন্য কাজ করা হচ্ছে।’
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাজার মনিটরিং কঠোর পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। তা না হলে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম যে লাগামহীন হয়ে পড়েছে তা নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না। সাধারণ মানুষ এক ছটাকের যুগে এরইমধ্যে ফেরত গেছে। নিয়ন্ত্রণ না থাকলে বাজারে নিত্যপণের দাম আরও এক দফা বাড়বে। তখন মানুষ ছটাকও কিনতে পারবে না। তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘গতকাল বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি সভা হয়েছে। সেখানে আমরা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে নানাভাবে পরামর্শ দিয়েছি। সেগুলো আমলে নিয়ে সময় মতো অভিযান শুরু করলে হয়তো বাজার দর নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।’
সারাবাংলা/ইউজে/এমও