ইউক্রেনীয়রা কারা?
৫ মার্চ ২০২২ ২৩:০১
‘ইউক্রেন’ শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন মত আছে। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় মতটি হলো এটি স্লাভীয় ভাষা থেকে উদ্ভূত। ইউক্রেন শব্দের আক্ষরিক অর্থ ‘সীমান্তবর্তী জায়গা’ বা ‘সীমান্ত অঞ্চল’ বা ‘প্রান্ত’। শব্দের এই অর্থটিই ব্যাখ্যা করে প্রাচীনদের ভবিষ্য দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে, একদিন ইউক্রেন পূর্ব-পশ্চিমের সীমানার মতো কাজ করবে।
১৯শতকের ইউক্রেনীয় বংশোদ্ভূত লেখক নিকোলাই গোগোলের ‘তারাস বুলবা’ নামক উপন্যাসটি রুশ ও ইউক্রেনীয় উভয় জাতির কয়েক প্রজন্মের জন্য একটি অনুপ্রেরণামূলক রচনা। উপন্যাসটিতে কোস্যাকদের বীরত্ব ও দুঃসাহসিক জীবনধারার চিত্রায়ন করা হয়েছে। ১৯৬২ সালে এ উপন্যাস অবলম্বে হলিউডে একটি সিনেমাও তৈরি হয়। সিনেমাটির শ্রেষ্ঠাংশে অভিনয় করেন ইউল ব্রাইন এবং টনি কার্টিস। উপন্যাসটির প্রধান নায়ক ছিলেন একজন কোস্যাক। তিনি ১৬শতকে পূর্ব ইউরোপের বিস্তৃত প্রান্তরে বসবাসকারী যাযাবরদের একজন।
ইউক্রেনীয় জাতীয় সংগীতের একটি লাইন আছে এমন—‘আমরা দেখাব–আমরা, আমাদের ভাইয়েরা, কোস্যাক জাতির!’ কিন্তু জাতীয় সংগীত অনুযায়ী উপন্যাসের নায়ক তারাস বুলবা যদি ইউক্রেনীয় নায়ক হয়ে থাকেন, তাহলে তাকে সাহিত্যে রুশ দেশপ্রেমিক হিসেবেও তুলে ধরা হয়েছে কেন? তারাস বুলবার মতো কোস্যাকরা যদি রুশ দেশপ্রেমিক হয়, তাহলে তারা এখন ইউক্রেনে কেন ভ্লাদিমির পুতিনের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে?
এই প্রশ্নটি বহু রুশ ও ইউক্রেনীয়কে তাড়া করছে। প্রশ্নটি দু’টি অর্থোডক্স স্লাভীয় জাতি—যাদের পরিচয় তারাস বুলবার মতো— তাদের কষ্ট দেয়। তাদের মধ্যে পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও দু’টি জাতি এখনও ঐতিহাসিক বন্ধন এবং একতা স্বীকার করে।
ফিওদর দস্তয়েভস্কি ছিলেন একজন খ্যাতনামা রাশিয়ান ঔপন্যাসিক। মানবতা, ঈশ্বর, প্রেম, সত্য বিষয়ে তার রচনা বিশ্বজুড়ে পাঠককে মুগ্ধ করে। দস্তয়েভস্কি আজকের ভ্লাদিমির পুতিনের মতোই একজন রুশ জাতীয়তাবাদী ছিলেন। তার মতে, নিকোলাই গোগোলের ছোটগল্প ‘ওভারকোট’ রচিত না হলে রুশ সাহিত্য বলে কিছু থাকত না। দস্তয়েভস্কি বলেছিলেন, ‘আমরা সবাই গোগোলের ওভারকোট থেকে বের হয়েছি।’
রাশিয়ার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক হিসেবে যাকে বিবেচনা করা হয়, সেই দস্তয়েভস্কির তরফ থেকে এমন মন্তব্য বেশ আকর্ষণীয় বটে। ‘অপরাধ ও শাস্তি’, ‘কারামাজভ ভাইয়েরা’র মতো কালজয়ী উপন্যাসের লেখক বলছেন, এসব উপন্যাস নাকি গোগোল ছাড়া হতোই না।
দস্তয়েভস্কির এমন রায় ইউক্রেনের উপর বর্তমান রুশ আক্রমণের পক্ষে একটি খারাপ তথ্য। যদি আমরা সাহিত্য বিষয়ে দস্তেয়ভস্কির চিন্তাধারাকে রাজনীতিতে প্রয়োগ করি—তাহলে দেখব—ইউক্রেন ছাড়া মস্কো কখনই একটি ক্ষমতাধর সত্তা হিসেবে টিকে থাকতে পারেনি। বিশেষ করে কিয়েভ থেকেই রাশিয়ার ইতিহাস শুরু।
পুতিনও খুব ভালোভাবে তা জানেন। তিনিও হয়ত ভেবেছিলেন—পশ্চিমপন্থী ইউক্রেন—যে কিনা মস্কোর সঙ্গে মিত্রতা চায় না—তার উপর আক্রমণ ছাড়া আর উপায় নেই। তিনি হয়ত ভেবেছিলেন, ইউক্রেন পশ্চিমের সঙ্গে মিত্রতা করলে স্লাভীয় ভাতৃত্ববোধের প্রতীক হিসেবে রাশিয়া আর টিকে থাকবে না। সারকথা, রাশিয়ার জন্য ইউক্রেন সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ।
পুতিন রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার শত্রুতাকে ‘আমাদের মহান সর্বজনীন দুর্ভাগ্য ও ট্র্যাজেডি’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। গত বছর এক সুদীর্ঘ নিবন্ধে পুতিন লিখেছিলেন, ‘যখন আমাকে রুশ-ইউক্রেনীয় সম্পর্কের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আমি বলেছিলাম রুশ এবং ইউক্রেনীয়রা পুরোটাই অখণ্ড এক সত্তা।’ ওই নিবন্ধে পুতিন লিখেছিলেন, ‘ইউক্রেনীয় এবং রুশদের অখণ্ডতা এমন কিছু যা আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।’
পুতিনের এই দৃষ্টিভঙ্গি নিকোলাই গোগোল রচিত উপন্যাসের নায়ক তারাস বুলবার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। পোলিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময় তারাস বুলবার ছেলে অ্যান্দ্রি পোলিশ এক রাজকুমারীর প্রেম পড়ে। কিন্তু পশ্চিমা রাজকুমারীর সঙ্গে প্রেম করে বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে তারাস বুলবা তার ছেলে অ্যান্দ্রিকে হত্যা করে।
কিয়েভ: একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচনা
ইতিহাসের প্রথম রুশ রাষ্ট্র কিয়েভান রুশ। বর্তমান ইউক্রেনের রাজধানী—যে শহরটি এখন রুশ সেনাদের আক্রমণে শিকার হয়েছে— এটিই ছিল কিয়েভান রুশ। কিয়েভ ইউক্রেনীয় ও রুশদের মধ্যকার শক্তিশালী সংযোগের সবচেয়ে বড় নিদর্শন। দুই জাতিই তাদের জাতীয় পরিচয়ের প্রাচীনতম উৎস হিসেবে কিয়েভান রুশ রাষ্ট্রকে স্বীকার করে।
কিন্তু বিপরীত মতও সত্য হতে পারে। কিছু বিশেষজ্ঞদের মতে, কিয়েভানদের নিজস্ব রাষ্ট্রের রাজধানী ছিল কিয়েভ। যদিওবা পরে ১৩শতকের শেষের দিকে রাশিয়ার জারতন্ত্রের পূর্বসূরি রাজ্য মস্কোর গ্র্যান্ড ডাচির অধীনে রুশরা একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েও থাকে, তবুও রুশরা রাষ্ট্রগঠনের ব্যাপারে ইউক্রেনীয়দের কাছে ঋণী।
যেকোনো বিবেচনায়, ১০ম এবং ১১ শতকে ইউরোপের বৃহত্তম এবং সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র ছিল কিয়েভান রুশ। এর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামো ইতিহাসের সবচেয়ে জটিল রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটি। ইউক্রেনীয় এবং রুশ উভয়েই নিজেদের অর্থোডক্স স্লাভ বলে মনে করে। নবম শতাব্দীতে কিয়েভান রুশ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা রুরিক ছিলেন একজন পৌত্তলিক (পেগান) ভাইকিং।
কিয়েভান রুশ রাষ্ট্রের সীমানা ছিল বর্তমান ইউক্রেন, বেলারুশ এবং পশ্চিম রাশিয়ার কিছু অংশজুড়ে বিস্তৃত। কখনও কখনও রাষ্ট্রটির সীমানা কৃষ্ণ সাগর থেকে বাল্টিক সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। রাষ্ট্রের জনসংখ্যার মধ্যে ছিল পূর্ব পোলানদের মতো পূর্ব স্লাভীয় জনগোষ্ঠী, যারা বর্তমানে পোলিশ জাতির পূর্বপুরুষ পশ্চিম পোলানদের থেকে আলাদা।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভারাঙ্গিয়ান (ভাইকিং) নেতৃত্ব কিয়েভান রুশের স্লাভীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যার মধ্যে আত্তীকরণ করে এবং ভ্লাদিমির দ্য গ্রেটের অধীনে অর্থোডক্স খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে। ভ্লাদিমির দ্য গ্রেট ৯৮৮ সালে কিয়েভকে একটি খ্রিস্টান রাজধানীতে পরিণত করেন।
কিয়েভের সেন্ট ভলোডিমির ক্যাথেড্রালে কিয়েভান রুশের শাসক ভলোদোমির দ্য গ্রেটের বাপ্তিস্ম
ভ্লাদিমির দ্য গ্রেট বর্তমানে ইউক্রেনীয় এবং রাশিয়ান উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। এখানে মজার একটি বিষয় হলো, তাকে রাশিয়ানরা ভ্লাদিমির এবং ইউক্রেনীয়রা ভলোদিমির নামে ডাকত। কাকতালীয়ভাবে, বর্তমানে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের প্রথম নামটিও উচ্চারিত হয় ভলোদোমির, এবং রুশ প্রেসিডেন্টের প্রথম নাম ভ্লাদিমির।
তুর্কি শাসনের অধীনে
১৩শতকের গোঁড়ার দিকে শক্তিশালী মঙ্গোলদের দখলের কারণে কিয়েভান রুশ সম্পূর্ণরূপে খণ্ডে খণ্ডে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রের পরিণত হয়। যে কয়টি প্রদেশ মঙ্গোলদের দখলে যায়নি সেগুলো দিয়ে ১২৫৩ সালে রুথেনিয়া নামক একটি সামন্তরাজ্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। সামন্তরাজ্য রুথেনিয়া মঙ্গোল তুর্কি মুসলিমদের সাম্রাজ্য গোল্ডেন হোর্ড বা সোনালি সাম্রাজ্যের উপর নির্ভরশীল ছিল। ১৪শতকের শেষ পর্যন্ত এই সাম্রাজ্য বর্তমান রাশিয়া এবং ইউক্রেনের বেশিরভাগ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করত।
কিংডম অব রুথেনিয়া বা রুথেনিয়া রাজ্যটি ১৪শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত টিকেছিল। তারপরের তিন শতাব্দীব্যাপী উত্তাল সময়কালে লিথুয়ানিয়ার গ্র্যান্ড ডাচি এবং পোল্যান্ড রাজ্যের মধ্যে ইউক্রেনীয় অঞ্চলগুলো বিভক্ত হয়ে যায়। ১৫৬৯ সালে পোলিশ-লিথুয়ানিয়ান কমনওয়েলথ প্রতিষ্ঠার পর, কিয়েভসহ ইউক্রেনের বেশিরভাগ অঞ্চল পোল্যান্ডের অংশ হয়ে যায়।
এদিকে ১৫শতকের দিকে তুর্কি-ক্রিমিয়ান খানাত (খানদের দ্বারা শাসিত সাম্রাজ্যের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল) গোল্ডেন হোর্ডের উত্তরসূরি রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং বর্তমান ইউক্রেন ও রাশিয়ার উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। তুর্কি-ক্রিমিয়ান খানাত ১৮শতক পর্যন্ত পোলিশ ও কোস্যাকদের বিরুদ্ধে লড়াই করে। মূলত, ইউক্রেনীয় ভূমিতে তুর্কি এবং ক্যাথলিক পোলিশদের বিরুদ্ধে অর্থোডক্স স্লাভিজমের রক্ষক হিসেবে আবির্ভূত হয় কোস্যাকরা।
কোস্যাকরা এবং ইউক্রেনীয় পরিচয়
গোগোলের উপন্যাসে তারাস বুলবার প্রধান শত্রুরা পোলিশ—যারা অর্থোডক্স স্লাভীয় জনগোষ্ঠীকে ক্যাথলিকে রূপান্তর করতে জন্য ইউক্রেনীয় ভূমি জুড়ে কঠোর আত্তীকরণ নীতি আরোপ করেছিল। গোগোলের উপন্যাসের কোস্যাকরা পোলিশদের শাসন থেকে অর্থোডক্স জনসাধারণকে স্বাধীন করার জন্য লড়াই করে। উল্লেখ্য যে, কোস্যাক একটি তুর্কি শব্দ, যার অর্থ দুঃসাহসী বা মুক্ত মানুষ।
গোগোলের তারাস বুলবা চরিত্রের সম্ভাব্য ঐতিহাসিক উৎস নিয়ে সাহিত্য সমালোচকদের বিতর্ক এখনও জারি আছে। কেউ কেউ মনে করেন যে, কোস্যাকদের কাল্পনিক নেতা তারাস বুলবা ১৬৪৮ সালে পোলিশদের বিরুদ্ধে বিখ্যাত কোস্যাক বিদ্রোহের নেতা বোহদান খমেলনিটস্কির সঙ্গে সম্পর্কিত।
সেসময় সফল বিদ্রোহের মাধ্যমে বোহদান খমেলনিটস্কি কোস্যাক হেটমানেট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই হেটমানেটকে আধুনিক ইউক্রেনীয় রাষ্ট্রের প্রধান অনুপ্রেরণা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু সেসময়কার হেটমানেট নানামুখী রাজনৈতিক চাপে পড়েছিল। পোলিশ, রাশিয়ার জারতন্ত্র, অটোমান সাম্রাজ্যসহ বিভিন্ন প্রতিপক্ষের সঙ্গে রাজনৈতিক সংঘাতপূর্ণ ছিল হেটমানেটের ইতিহাস।
মজার বিষয় হলো, ১৬৪৮ সালে বিদ্রোহে বিজয়ী হয়ে কিয়েভে প্রবেশ করা খমেলনিটস্কি নিজেকে কিয়েভান রুশের উত্তরাধিকারী রুথেনিয়ান রাষ্ট্রের শাসক হিসেবে মনে করতেন। তার এই মনোভাব রাশিয়ার জারতন্ত্রের সঙ্গে কোস্যাকদের ঐতিহাসিক রাজনৈতিক সংকটকে তুলে ধরে। কেননা, রাশিয়ার জারতন্ত্র নিজেদের কিয়েভান রুশের উত্তরাধিকারী মনে করে। উল্লেখ্য যে, সে সময় রাশিয়ার জারতন্ত্র ছিল মস্কোর গ্র্যান্ড ডাচির মাধ্যমে রুরিকের (কিয়েভান রুশের প্রতিষ্ঠাতা) বংশধরদের দ্বারা গঠিত একটি রাজ্য।
মুসকোভাইটরা (মস্কোর নাগরিক) ইতিমধ্যেই খুব শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এদিকে পোল্যান্ড রাজ্য এবং লিথুয়ানিয়ার গ্র্যান্ড ডাচির মধ্যে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলায় বিপর্যস্ত ইউক্রেন। সে সময় মুসকোভাইটরা সাবেক কিয়েভান রুশের বহু রাজ্য দখল করে নেয় এবং ১৬শতকে রাশিয়া জারতন্ত্র গঠন করে। সে সময় পোলিশদের চাপে খমেলনিটস্কির অধীন কোস্যাকদের সামনে মুসকোভাইটের সাহায্য চাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না।
ফলস্বরূপ, হেটমানেট বেশিদিন টেকেনি। ১৬৫৪ সালের পেরেয়াস্লাভ চুক্তির পর রাশিয়ার জারডমের আওতাধীন একটি স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রে পরিণত হয় কোস্যাক হেটমানেট। তিন দশক পরে, চিরস্থায়ী শান্তি চুক্তির মাধ্যমে কিয়েভ এবং হেটমানেটের বেশিরভাগ অংশ রাশিয়ার অংশ হয়ে ওঠে। কিন্তু কিছু কোস্যাক নেতা সুইডেন, পোল্যান্ড এবং অটোমানদের সঙ্গে মিত্রতা বজায় রেখে স্বাধীনতার পথ খুঁজতে থাকে।
১৭শতক থেকে ১৯শতক পর্যন্ত, কোস্যাকদের উপর রাশিয়ান রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দমন ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। স্বায়ত্তশাসন ক্ষমতা কমিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে ভাষার উপর নিষেধাজ্ঞা, এবং অন্যান্য ইউক্রেনীয় বিরোধী পদক্ষেপ বৃদ্ধি পায়। একই সময়ে ককেশাস, সাইবেরিয়া এবং মধ্য এশিয়াজুড়ে রাশিয়ার অন্যান্য শত্রুদের বিরুদ্ধে সামরিক ক্ষমতা ব্যবহার করেছিল মস্কো।
মস্কোর চাপ ইউক্রেনীয়দের মধ্যে রুশ-বিরোধী মনোভাব বাড়াতে সাহায্য করেছিল। পুতিনের ভাষায়, সেসময় তাদের মধ্যে কিছু ‘ইউক্রেনীয় সংকট’ তৈরি হয়েছিল। ১৯শতকের শেষের দিকে ইউক্রেনীয় অভিজাতদের মধ্যে ‘রুশদের থেকে আলাদা একটি জাতি হিসেবে ইউক্রেনীয় জনগণের ধারণা’ বিকাশের পথ প্রশস্ত হয়। তাদের এই ধারণাকে প্রেসিডেন্ট পুতিন তার ওই নিবন্ধে ‘অবাঞ্ছিত’ বলে বর্ণনা করেছেন।
সোভিয়েতদের অধীনে সংযুক্ত ইউক্রেন
১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লবের আগে, ইউক্রেনীয় ভূমি অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্য, পোল্যান্ড ও রাশিয়ার জারতন্ত্রের মধ্যে বিভক্ত ছিল। সেসময় ওইসব দেশে বিভক্ত হয়ে যাওয়া ভূখণ্ড একত্র করে একটি ইউক্রেনীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কয়েকটি প্রচেষ্টাও হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, ইউক্রেন কমিউনিস্ট ফেডারেশনের অন্যতম সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, সোভিয়েত ইউক্রেন পোল্যান্ড এবং মোলদোভার বিভিন্ন ভূখণ্ড লাভ করে। কিয়েভান রুশের বহু শতাব্দী পরে সেসময় প্রথমবারের মতো একীভূত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল সোভিয়েত ইউক্রেন। এমনকি ক্রিমিয়া উপদ্বীপও ইউক্রেনকে দিয়েছিল সোভিয়েত নেতৃত্ব (ইউক্রেনীয় বংশোদ্ভূত সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভের আমলে)।
পুতিন তার এক সাম্প্রতিক বিবৃতিতে ইউক্রেনপন্থী বলশেভিক নেতৃত্বের কঠোর সমালোচনা করেছেন। পুতিন বিশ্বাস করেন যে, বর্তমান ইউক্রেন গঠনের জন্য ভ্লাদিমির লেনিনের মতো কমিউনিস্ট নেতারা রাশিয়াকে ছিনতাই করেছিলেন। সোভিয়েতের অধীনে সুবিধা পাওয়া সত্ত্বেও একটি মারাত্মক দুর্ভিক্ষের কারণে ইউক্রেনীয়রা কমিউনিস্ট অতীতকে কিছুটা ঘৃণার চোখে দেখে থাকে।
ক্রুশ্চেভ থেকে ব্রেজনেভ-গর্বাচভ পর্যন্ত ইউক্রেনীয় বংশোদ্ভূত সোভিয়েত নেতারা ১৯২২ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময় কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এ থেকে বুঝা যায়, সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর কিয়েভের ব্যাপক প্রভাব ছিল।
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর ইউক্রেন স্বাধীন হয়ে যায়।
আজকের ইউক্রেন
অত্যন্ত জটিল ইতিহাসের ফলস্বরূপ, আজকের ইউক্রেনে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সংমিশ্রণ রয়েছে। দেশটির বৃহৎ সংখ্যালঘু ক্যাথলিক স্লাভ বা ইউনাইটস- তারা মূলত পোলিশ আত্তীকরণ নীতির ফসল। এছাড়া অন্যান্য সংখ্যালঘুদের মধ্যে রয়েছে পশ্চিমপন্থী অর্থোডক্স স্লাভীয় এবং রুশরা। এদের বেশিরভাগই পূর্ব ইউক্রেনে বাস করে।
২০১৪ সালে অরেঞ্জ বিপ্লবের পর অন্যান্য অনেক পূর্ব এবং পশ্চিম স্লাভীয়-সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের মতো ইউক্রেনও পশ্চিম ঘেঁষা নীতি বেছে নেয়। অরেঞ্জে বিপ্লবে রুশপন্থী প্রেসিডেন্টকে উৎখাত করা হয়। কিন্তু পুতিন ও পূর্ববর্তী জাররা যাকে ‘ছোট রাশিয়া’ বলতেন, সেই ইউক্রেন এতে করে মস্কোতে তার ‘বড় ভাইকে’ ক্ষুব্ধ করে তুলে।
এর ফলস্বরূপ মস্কো ক্রিমিয়া দখল করে নেয় এবং পরে পূর্ব ইউক্রেনের রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দিয়ে কিয়েভে পূর্ণ মাত্রায় আক্রমণ চালায়। প্রেসিডেন্ট পুতিন তার ওই নিবন্ধে লিখেছিলেন, ‘আমি নিশ্চিত যে, ইউক্রেনের সত্যিকারের সার্বভৌমত্ব শুধুমাত্র রাশিয়ার সঙ্গে অংশীদারিত্বের মধ্যেই সম্ভব।’
পুতিন ইউক্রেনীয়দের সতর্ক করে আরও লিখেন, ‘তাদের বড় ভাইকে ভালোবাসা ছাড়া তাদের আর কোনো বিকল্প নেই।’ কিন্তু বাস্তবতা হলো, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি হামলার পর এখন পর্যন্ত ইউক্রেনীয়রা কিয়েভ থেকে মুসকোভাইটদের তাড়িয়ে দিতে তীব্র প্রতিরোধ যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।
[তুরস্কের সরকারি কেন্দ্রীয় তথ্য-সম্প্রচার প্রতিষ্ঠান তুর্কী রেডিও ও টেলিভিশন কর্পোরেশন (টিআরটি)-তে প্রকাশিত। ভাষান্তর- আতিকুল ইসলাম ইমন]
সারাবাংলা/আইই
ইউক্রেন কিয়েভান রাস কিয়েভান রুশ কোস্যাক কোস্যাক হেটমেনেট তারাস বুলবা নিকোলাই গোগোল ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়া