Thursday 21 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সাগরে নিখোঁজ ২৮ সঙ্গী, বেঁচে ফেরা ২ জন জানালেন ‘নরকযাত্রা’র কথা

শ্যামল মিত্র, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট
৬ মার্চ ২০২২ ২২:৫০

নরসিংদী: চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি লিবিয়া থেকে স্পিডবোটে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাচ্ছিলেন অভিবাসনপ্রত্যাশী ৩৫ জন বাংলাদেশি। ইতালি পৌঁছার ঘণ্টাখানেক আগে মাল্টা সীমানার জলরাশিতে অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই স্পিডবোটটি উল্টে গেলে সব যাত্রী ডুবে যান। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় ভেসে থাকার ১১ ঘণ্টা পর কোস্টগার্ডের সদস্যরা উল্টে যাওয়া স্পিডবোটের ওপরে অবস্থান করা জীবিত সাত জনকে উদ্ধার করেন। তবে তীরে পৌঁছার আগেই ঠাণ্ডায় জমে এক জনের মৃত্যু হয়।

বিজ্ঞাপন

ঘটনার ৩৫ দিন পেরিয়ে গেলেও ভূমধ্যসাগরে এখনো নিখোঁজ আছেন ২৮ জন, যাদের মধ্যে ১৫ জনই নরসিংদীর। সলিল সমাধির হাত থেকে বেঁচে ফেরা ছয় জনের মধ্যে দু’জন গত বৃহস্পতিবার (৩ মার্চ) দেশে ফিরেছেন। তাদের একজন নরসিংদীর রায়পুরার মো. খোরশেদ মৃধার ছেলে ইউসুফ মৃধা (২৯), অন্যজন ফরিদপুরের নগরকান্দার মো. ইউনুস শেখের ছেলে শেখ সামিউল (১৮)।

বর্তমানে এই দু’জন রাজধানীর হাজি ক্যাম্পে হোম কোয়ারেনটাইনে আছেন। তাদের মাধ্যমেই এতদিন পর ‘ওই দিন ঠিক কী ঘটেছিল’ তার বিস্তারিত জানতে পারছেন নিখোঁজদের স্বজনরা। বেঁচে ফেরা এই দুই জন বলছেন তাদের ‘নরকযাত্রা’র দীর্ঘ ইতিহাস আর যাত্রাপথের বিভীষিকাময় নানা ঘটনার কথা।

ইউসুফ মৃধা ও শেখ সামিউল মোবাইল ফোনে সারাবাংলাকে জানান, গত ২৭ জানুয়ারি লিবিয়ার স্থানীয় সময় রাত ৮টার দিকে দুই মিশরীয় চালক তাদের ৩৫ জনকে নিয়ে ইতালির উদ্দেশে রওনা হন। ভূমধ্যসাগরে পাড়ি দেওয়ার সময় বোট থেকে পড়ে যাওয়া একজনকে তুলতে গিয়ে স্পিডবোটটি উল্টে যায়। এরপর ওই প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় পানিতে প্রায় ১১ ঘণ্টা ভেসে ছিলেন তারা। চোখের সামনে ১০ থেকে ১২ জনকে মারা যেতে দেখেছেন। কূল-কিনারাহীন সাগরে ঢেউয়ের ধাক্কায় এক এক করে ভেসে গেছেন তারা। তবে কোনোরকমে ছয় জন উল্টে যাওয়া স্পিডবোটের ওপরে অবস্থান করায় বেঁচে গেছেন।

এতদিনেও নিখোঁজ সেই ২৮ বাংলাদেশির কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। তাদের কেউই আর বেঁচে নেই, ভূমধ্যসাগরে সলিল সমাধি হয়েছে বলেই মনে করছেন বেঁচে ফেরা এই দু’জন।

এদিকে, নিখোঁজদের মধ্যে নরসিংদীর ১৫ জনের নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন— রায়পুরার ডৌকারচরের নাদিম সরকার (২২), আলমগীর সরকার (৩৫), আল-আমিন ফরাজী (৩৩), দক্ষিণ মির্জানগরের এস এম নাহিদ (২৫), আমিরগঞ্জের ইমরান মিয়া (২১), আশিস সূত্রধর (২১), সবুজ মিয়া (২৫), হাইরমারার শাওন মিয়া (২২) সেলিম মিয়া (২৪) ও বেলাব উপজেলার বেলাবর আল আমিন (২৮), নারায়ণপুরের মতিউর রহমান (৩৭), সল্লাবাদের শরীফুল ইসলাম (২৪), সালাউদ্দিন (৩২), মো. হালিম (২৬), বিপ্লব মিয়া (২৪)। এছাড়া বাকি ১৩ জন ফরিদপুর, কিশোরগঞ্জ, বরিশাল, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গাজীপুর ও সিলেট জেলার বাসিন্দা।

বিজ্ঞাপন

রায়পুরার ডৌকারচরের নিখোঁজ তিন জনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রায়পুরার আমিরগঞ্জের হাসনাবাদের তারেক মোল্লা নামের এক দালালের সঙ্গে যোগাযোগ হয় নাদিম, আল আমিন ও আলমগীরের। তিন মাস আগে ইতালি পর্যন্ত যাওয়ার জন্য সাড়ে ৮ লাখ টাকায় ওই দালালের সঙ্গে চুক্তি করেন তারা। সাড়ে ৬ লাখ টাকা করে তার হাতে দেওয়ার পর গত ২৭ ডিসেম্বর তারা ইতালির পথে রওনা হন। প্রথমে তাদের দুবাই নিয়ে এক সপ্তাহ রাখা হয়। পরে মিশর হয়ে তাদের পাঠানো হয় লিবিয়ার বেনগাজী শহরে। সেখানে খাদ্য সংকটে আরও প্রায় ১০ দিন থাকার পর ব্যক্তিগত গাড়ির ডেকের ভেতরে ভরে দুই দিনের পথ পেরিয়ে তাদের নেওয়া হয় ত্রিপলি শহরে। সেখানে তারা দেখা পান এই চক্রের মূল দালাল মনির চন্দ্র শীল নামের এক ব্যক্তির, যার বাড়ি নরসিংদীর রায়পুরার আমিরগঞ্জের হাসনাবাদে।

তারা জানান, এই তিন জনসহ আরও অন্তত ২০ থেকে ২৫ জন দালাল মনির চন্দ্র শীলের বাড়িতে থাকেন আরও সাত দিন। সেখানে অবস্থানের সময়ই তারা জানতে পারেন, বৈধভাবে ইতালি নেওয়ার কথা বললেও এখন তাদের সেখানে পাঠানো হবে অবৈধভাবে। পরে তাদের কাছে গেমিংয়ের (লিবিয়া থেকে বোটে করে ভূমধ্যসাগর পার হয়ে ইতালি পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়ার নাম গেমিং) পরিকল্পনা জানানো হয়।

তাদের জানানো হয়, ৩০০ সিসির দু’টি ইঞ্জিনের একটি স্পিডবোটে করে তাদের নেওয়া হবে, যার ধারণক্ষমতা অন্তত ৫০ জন। মোট ৪২ জনকে নিয়ে জোয়ারা ঘাটে গেলে দেখা যায়, ওই স্পিডবোটটিতে ১৬০ সিসির একটি ইঞ্জিন রয়েছে, যার ধারণক্ষতা সর্বোচ্চ ২৫ জন। ২৫ জনের জায়গায় ৪২ জনকে তোলা হলে চালক কয়েকজনকে নামিয়ে দেন। এরপর ২৭ জানুয়ারি স্থানীয় সময় রাত ৮টার দিকে মিশরীয় দুই চালক স্পিডবোটটিতে ৩৫ জন বাংলাদেশিকে নিয়ে ইতালির পথে রওনা হন।

বেঁচে ফেরা শেখ সামিউল বলেন, ‘২৫ জনের ধারণক্ষমতার স্পিডবোটে আমরা ছিলাম ৩৫ জন। লাইফজ্যাকেট বা কোনো ধরনের সেফটি ইকুইপমেন্ট আমাদের কাউকে দেওয়া হয়নি। লিবিয়ার থেকে রওনা হয়ে তিউনিশিয়া পার হয়ে মাল্টা জলসীমা অতিক্রম করার সময় আমাদের একজন চলন্ত স্পিডবোট থেকে সাগরে পড়ে যায়। তাকে এমন অবস্থায় রেখে আমরা চলে যাব— এটা মনে সায় দেয়নি। পরে স্পিডবোট ঘুরিয়ে তাকে টেনে তোলার সময় বোট একদিকে কাত হয়ে যায়। এসময় বিপরীত দিক থেকে আসা ঢেউয়ের ধাক্কায় স্পিডবোটটি উল্টে গেলে সব যাত্রী সাগরে ডুবে যায়।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের মধ্যে সাত জন কোনো রকমে উল্টে যাওয়া স্পিডবোটের ওপরে উঠতে পেরেছিলাম। এসময় স্পিডবোট ধরে ভেসে ছিল অন্তত ১৫ জন। ভেসে থাকতে থাকতে বেশ কয়েকজনকে মারা যেতে দেখেছি। আবার অনেকে ঢেউয়ের তোড়ে ভেসে গেছে অনেক দূরে। ইতালি পৌঁছার আর মাত্র একঘণ্টার মতো দূরত্ব বাকি ছিল।’

বেঁচে ফেরা ইউসুফ মৃধা বলেন, ‘আমি একাই একজনের শার্টের কলার, আরেকজনের মাফলার ও দুই হাতে আরও দুই জনসহ মোট চার জনকে ভাসিয়ে রেখেছিলাম। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় এদের মধ্যে একজনের মৃত্যু হলে আমি হাত ছেড়ে দিতে বাধ্য হই। এভাবে এক এক করে কেউ ডুবে যাচ্ছিল, কেউ ভেসে যাচ্ছিল। নিজেরা বাঁচব নাকি অন্যদের বাঁচাব— এই ভেবেই সময়গুলো একটা ঘোরের মধ্যে কাটছিল।’

তিনি বলেন, ‘একটা সময় বহু দূরে কোস্টগার্ডের একটি জাহাজ ভেসে যেতে দেখি। আমাদের মধ্যে একজনের লাল জামা পরা ছিল। তার জামা খুলে উড়াতে থাকি আমরা। পরে তারা এসে আমাদের সাত জনকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। উদ্ধার করে তীরে নেওয়ার পথেই রাশেদুলের মৃত্যু হয়। আমাদের ছয় জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর প্রায় একমাস জেলে রাখার পর স্থানীয় দূতাবাসের সহযোগিতায় আমাদের দেশে ফেরার ব্যবস্থা হয়। বৃহস্পতিবার সকালে আমরা দুই জন দেশে ফিরেছি। অন্য চার জনও দ্রুতই দেশে ফিরবে।’

জানা গেছে, সাড়ে ৮ লাখ টাকায় বৈধভাবে প্লেনে করে ইতালি নিয়ে যাওয়ার চুক্তি দালালদের সঙ্গে হলেও অবৈধভাবে সেখানে যাওয়ার বিষয়টি জানা যায় লিবিয়ায় অবস্থানের সময়। অবৈধ পথে ইতালি যাওয়ার ওই যাত্রায় নরসিংদী থেকেই ছিলেন অন্তত ২৪ জন। এখনও নিখোঁজ আছেন তাদের ১৫ জন। একজন বেঁচে ফিরেছেন, দু’জন ফেরার অপেক্ষায়, এক জন মারা গেছেন, পাঁচ জন এখনো লিবিয়ায় অবস্থান করছেন।

নিখোঁজ নাদিম সরকারের বাবা সোবহান সরকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘দালাল তারেক মোল্লার মাধ্যমেই রায়পুরার ১২ জনসহ বিভিন্ন জেলার অন্তত ২০-২৫ জন লোক ইতালি রওনা হয়েছিল। তিনি রায়পুরার আমিরগঞ্জের হাসনাবাদে বসে বৈধভাবে ইতালি নেওয়ার কথা বলে প্রলোভন দেখিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের লোকজনকে অবৈধভাবে বিদেশে পাঠান। তার ও মনির চন্দ্র শীলের মতো দালালদের প্রলোভনের ফাঁদে পড়েই আজ এতগুলো পরিবারে কান্নার রোল উঠেছে। তাদের কঠোর শাস্তি হলে এই ২৮ জনের আত্মা শান্তি পাবে।’

ব্র্যাকের মাইগ্রেশন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে ঢোকার জন্য যে দেশের নাগরিকরা সবচেয়ে বেশি চেষ্টা করে, সে তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান সবসময়ই শীর্ষে। যে জেলাগুলো থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ এই ঝুঁকি নেয় তার মধ্যে নরসিংদী অন্যতম। গত এক দশকে এ পথে কমপক্ষে ৬৫ হাজার বাংলাদেশি শুধু আটকই হয়েছেন। প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত পাঁচ শতাধিক মানুষ। অথচ যে পরিমাণ টাকা দিয়ে তারা এমন ঝুঁকি নেন, এ দিয়ে কিন্তু তারা নিজেদের এলাকাতেই কিছু করতে পারেন। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক দালালদের চিহ্নিত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিলে এই প্রবণতা কমবে না।’

নরসিংদীর জেলা প্রশাসক আবু নইম মোহাম্মদ মারুফ খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘জেলার ১৫ জনসহ মোট ২৮ জন বাংলাদেশি ভূমধ্যসাগরে ৩৫ দিন ধরে নিখোঁজ থাকার বিষয়টি শুনেছি। তবে নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারের কোনো সদস্য আমাদের এ বিষয়ে কিছু জানাননি। এ বিষয়ে কতটুকু কী করা সম্ভব, তা খোঁজ নিয়ে দেখা হবে। স্থানীয় দালালদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

জেলা প্রশাসক আরও বলেন, অভিবাসনপ্রত্যাশী ব্যক্তিদের কাছে প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার জন্য আমাদের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক রয়েছে। এর মাধ্যমে আমরা বিদেশগামী ব্যক্তিদের বিভিন্ন ধরনের সেবা দিয়ে থাকি। এ ক্ষেত্রে আমার অনুরোধ থাকবে— স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে ঝুঁকি নিয়ে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা না করে ভালো করে খোঁজখবর নিয়ে যেন সবাই বিদেশগামী হন। তাহলে আর কোনো মায়ের বুক এভাবে খালি হতে হবে না।

সারাবাংলা/এমও

২৮ সঙ্গী অভিবাসনপ্রত্যাশী ইতালি নরসিংদী ভূমধ্যসাগর ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর