অভিধান, রোজনামাচা, নয়াচীন-এ ‘রাজ’ করছে বাংলা একাডেমি
৬ মার্চ ২০২২ ২৩:১৯
দোয়েল চত্বর থেকে হেঁটে মেলার গেট পর্যন্ত পৌঁছাতে যে মিনিট পাঁচেক সময় ব্যয় হলো, এই সময়টাতে বেশ কয়েকটা প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। আচ্ছা এই মেলা আয়োজন কীসের জন্য? বইকে বাণিজ্যিকীকরণের জন্য, লেখক তৈরির জন্য, নাকি পাঠক তৈরির জন্য?
যদি বইয়ের বাণিজ্যিকীকরণের জন্য হয়ে থাকে, তাহলে তো বইও একটি পণ্য। কিন্তু বইকে পণ্য বানানোর সুযোগ আছে কি? আর যদি থেকেও থাকে, তাতে লাভটা কী? বইকে পণ্য বানানোর যুগের সূচনা যখন হয়নি, তখন তো পৃথিবীতে ‘ম্যাকবেথ’, ‘ইলিয়াড’, ‘ওডিসি’, ‘প্যারাডাইস লস্ট’, ‘ওথেলো (Othello)’ সৃষ্টি হয়েছে। এখন হয় না কেন?
যদি লেখক তৈরির জন্য বইমেলার প্রয়োজন পড়ে, তাহলে হোমার, মিল্টন, দান্তে, ট্যাসো, শেকসপিয়র, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা কাজী নজরুল ইসলাম কোন মেলা থেকে উঠে এসেছিলেন? আর যদি পাঠক তৈরির ব্যাপার থাকে, তাহলে ব্যাগ ভরে বই নিয়ে বাড়ি ফেরা পাঠক কেন আইসক্রিমের মোড়ক, চিপসের ঠোঙ্গা, জুসের বোতল স্বাধনীতা টাওয়ারের জলাধারে ফেলে আসে?
ওহ! ভুলটা তো আমিই করছি। বইয়ে তো জ্ঞান থাকে, কাণ্ডজ্ঞান থাকে না। এটা শিখতে হয় ‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র’— সেখান থেকে।
ভেবেছিলাম আজ একটু বইয়ের দরদাম ও বেচা-কেনা নিয়ে লিখব। কিন্তু হঠাৎ উল্লেখিত প্রশ্নগুলো মাথার মধ্যে ঢুকে সব কিছু এলোমেলো করে দিল। তাই একটু বেখেয়ালিভাবেই আর্চওয়ে পাড় হচ্ছিলাম। হঠাৎ মেলার হাইজেনিক পার্টানার ‘রেকিট বেনকিজারের’ এক তরুণী পরম যত্নে ‘ডেটল হ্যান্ডস্যানিটাইজার’ আমার ডান হাতের তালুতে…।
মেলায় একটু আগেভাগেই ঢুকে পড়েছিলাম বোধ হয়। তাই সব কিছু ফাঁকা মনে হলো। কোনো কোনো প্রকাশনীর স্টল এখনো বন্ধ, কোনোটা খুলছে, কোনোটার বিক্রয়কর্মীরা ডাস্টার দিয়ে বইয়ে জমা ময়লা পরিষ্কার করছে। কয়েকটি প্যাভিলিয়নে ছোট মাপের ভিড়ও দেখা গেল।
বাঙালির সাধারণ কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কথা সবারই জানা। তারা নিজের বয়স, চাকরির বেতন, দোকানের বেচা-বিক্রির কথা কাউকে বলতে চায় না। মুখে আনতে চায় না ভাসুরের নাম। অথচ এগুলো দ্বিধাহীন চিত্তে বলে দিলে এমন কোনো ক্ষতি নেই। ক্ষেত্র বিশেষ লাভের সম্ভাবনাও রয়েছে।
দীর্ঘদিন বইমেলা কাভার করার সুবাদে বেশ কয়েকটি বড় প্রকাশনীর ‘ম্যানেজার বাবু’র সঙ্গে দহরম-মহরম সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তারাও বলতে চান না কত কী বিক্রি হলো গত ২০ দিনে। নাম করা এক প্রশনীর প্রধান বিক্রয় কর্মকর্তা তো আদর করে ভেতরে নিয়ে বসতে দিলেন, গল্প করলেন বেশ কিছুক্ষণ। কিন্তু কত টাকা বিক্রি হলো এ কয়দিনে— এ বিষয়ে একটি তথ্যও দিতে চাইলেন না তিনি। আমিও নাছোড়বান্দা। অবশেষে নাম প্রকাশ করব না— এই শর্তে তিনি জানালেন, গত ২০ দিনে ১৭ লাখ টাকার বই বিক্রি করেছে তার প্রতিষ্ঠান।
ঐতিহ্য প্রকাশনীর ম্যানেজার আমজাদ হোসেন খান কাজল তো উপহারের একটি ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘যান তো সাংবাদিক সাহেব। বিরক্ত কইরেন না। বেচা-বিক্রির হিসাব-নিকাশ করতে পারিনি। তবে গত বারের চেয়ে এবারের বেচা-বিক্রি ভালো। প্রথম ১৫ দিনে আট/দশ লাখ টাকা বিক্রি হয়েছে। পরের পাঁচ দিনের হিসাব এখনো করতে পারিনি।’
কারও কাছ থেকেই যখন বেচা-বিক্রির সঠিক খবর পাওয়া যাচ্ছে না, তখন সোজা বাংলা একাডেমির জনসংযোগে গিয়ে হাজির হলাম। সেখান থেকে প্রথম ১৫ দিনের বেচা-বিক্রির একটি হিসাব এগিয়ে দিয়ে বলা হলো, ছবি তুলে নিন। হার্ড বা সফট কপি দেওয়া যাবে না।
চোখ বুলিয়ে দেখা গেল বাংলা একাডেমির ৯টি বিক্রয়কেন্দ্রে প্রথম ১৫ দিনে বিক্রি হয়েছে প্রায় ৭৫ লাখ টাকার বই। মেলার দুই অংশে সাতটি প্যাভিলিয়ন এবং দু’টি স্থায়ী বিক্রয়কেন্দ্রের এই বেচা-বিক্রিতেও সন্তুষ্ট নয় বাংলা একাডেমি। তাদের লক্ষ্যমাত্রা হয়তো আরও বেশি।
জনসংযোগ থেকে পাওয়া বই বিক্রি সংক্রান্ত তথ্য যাচাইয়ে বাংলা একাডেমির পরিচালক (বিক্রয়, বিপণন ও পুনর্মুদ্রণ বিভাগ) এবং অমর একুশে গ্রন্থমেলার সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদের কাছে গেলে সারাবাংলাকে তিনি জানান, এবারের মেলায় প্রথম ১৫ দিনে বাংলা একাডেমির ৯টি বিক্রয়কেন্দ্রে ৭৪ লাখ ৬ হাজার ৩৫৪ টাকার বই বিক্রি হয়েছে।
অর্থাৎ জনসংযোগ থেকে পাওয়া তথ্য আর মেলার সদস্য সচিবের দেওয়া তথ্য এক ও অভিন্ন। এবার দেখার পালা— কোন বই বিক্রি করে এত টাকা ঘরে তুলল বাংলা একাডেমি।
বর্ধমান হাউজের তথ্যকেন্দ্র যেখানে, ঠিক তার সামনে বাংলা একাডেমির তিন নম্বর বিক্রয়কেন্দ্র। এবারের বইমেলায় যে ৩৫টি প্যাভিলিয়ন রয়েছে, তার মধ্যে এটিও একটি।
এ প্যাভিলিয়নে প্রথম ১৫ দিনে বিক্রি হয়েছে ৩ লাখ ৯৬ হাজার ১২৯ টাকার বই। প্যাভিলিয়নের বিক্রয়কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পুরো বিক্রির সিংহভাগ দখল করে আছে ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’, ‘বাংলা বানান অভিধান’, ‘সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধান’, ‘বাংলা উচ্চারণ অভিধান’, ‘English-Bangla Dictionary’, ‘Bengali-Englis Dictionary’ এবং বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রচিত ‘কারাগারের রোজনামচা’ ও ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বই দু’টি।
নজরুল মঞ্চের সামনে বাংলা একাডেমির প্যাভিলিয়ন থেকেও একই তথ্য পাওয়া গেলো। এ প্যাভিলিয়নটির বিক্রয়কর্মী তুষার সারাবাংলাকে বলেন, বাংলা একাডেমির অভিধান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘কারাগারের রোজনামচা’ ও ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বই দু’টিই বেশি বিক্রি হচ্ছে।
টিএসসির গেট দিয়ে মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢোকার পর বাংলা একাডেমির যে দু’টি প্যাভিলিয়ন রয়েছে, সেখান থেকেও পাওয়া গেলো একই তথ্য। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন গেটের সামনে থাকা বাংলা একাডেমির বিক্রয়কর্মীরাও জানালেন, এবারের মেলায় সব চেয়ে বেশি বিক্রি হচ্ছে অভিধান এবং বঙ্গবন্ধুর বই।
অর্থাৎ বলতে দ্বিধা নেই— এবারের বইমেলায় ‘অভিধান’, ‘কারাগারের রোজনামচা’, ‘আমার দেখা নয়াচীন’ নিয়ে রীতিমতো ‘রাজ’ করছে বাংলা একাডেমি। অবশ্য এতেও খুশি নন প্রতিষ্ঠানটির কর্তাব্যক্তিরা। বাংলা একাডেমির পরিচালক ড. জালাল আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘গতবারের তুলনায় এবার বিক্রি কম। মেলা যে ক’দিন আছে, দেখা যাক কী হয়।’
সারাবাংলা/এজেড/টিআর
অমর একুশে গ্রন্থমেলা আমার দেখা নয়াচীন কারাগারের রোজনামচা বইমেলা বইমেলা ২০২২ বাংলা একাডেমি বাংলা একাডেমি অভিধান