Sunday 20 Oct 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বজ্রকণ্ঠে মুক্তির দিশা

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
৭ মার্চ ২০২২ ০০:০০

ঢাকা: আজ ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। বাঙালি জাতির দীর্ঘ স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের বাঁকে এক অনন্য দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমুদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডাক দিয়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের, মুক্তি সংগ্রামের। বজ্রকণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ মুক্তিকামী জনতার কান ভেদ করে সে মন্ত্র প্রবেশ করে বুকের অলিন্দে, মগজের কোণায় কোণায়। জাতির পিতার সেই ডাক হয়ে হয়ে ওঠে সাত কোটি মানুষের স্বাধীনতার বীজমন্ত্র।

বিজ্ঞাপন

জাতির পিতার বজ্রকণ্ঠের সেই উচ্চারণ বিশ্বকে জানিয়ে দেয়, বাঙালি জাতিকে আর ‘দাবায়ে’ রাখা যাবে না। বাঙালি জেনে যায়, পাকিস্তানের পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার সময় এসেছে। তাই তো ৭ মার্চের ভাষণ কোনো সাধারণ ভাষণ নয়— এটি বাঙালি জাতির রাজনৈতিক দলিল, এটি বাঙালি জাতির সাংস্কৃতিক পরিচয়ের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা, বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ। আর সে কারণেই জাতিসংঘের ইউনেস্কো এই ভাষণকে দিয়েছে বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্যের (ওয়ার্ল্ড ডক্যুমেন্টারি হেরিটেজ) ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রার’র স্বীকৃতি।

বিজ্ঞাপন

১৯৭০ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়ের পর থেকেই পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী টালবাহানা শুরু করে। তারা ক্ষমতা হস্তান্তর করে না। উত্তপ্ত হয়ে উঠতে থাকে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। ১৯৭১ সাল আসতে আসতে মানুষ বুঝে যায়, পশ্চিম পাকিস্তানিদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকার দিন শেষ। স্বায়ত্বশাসন নয়, স্বাধীনতার বিকল্প নেই বাঙালির সামনে। আর এমন উত্তাল সময়ে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভা আহ্বান করে আওয়ামী লীগ।

মুক্তি সংগ্রামের আঁচ তখন সারাবাংলায়। আওয়ামী লীগের সেই জনসভায় তাই নামে মানুষের ঢল। ততদিনে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতায় পরিণত হওয়া বঙ্গবন্ধু ছিলেন সে জনসভার প্রধান অতিথি। জনসভায় মানুষের ঢল। কী নির্দেশনা দেবেন নেতা— সেই নির্দেশনা শুনতেই রেসকোর্স ময়দান পরিণত হয় জনসমুদ্রে।

সেই জনসমুদ্রে যখন হাজির হলেন সাত কোটি মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে ওঠা বঙ্গবন্ধু, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হচ্ছে। ঘড়ির কাটায় ৩টা২০ মিনিট। মঞ্চে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ালেন শেখ মুজিব। কেবল বাঙালি জাতিকেই নয়, গোটা বিশ্বকে জানিয়ে দিলেন, আমরা এখন মুক্তি সংগ্রামেরই কেবল অপেক্ষা করছি। বললেন, ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকের ওপর হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে, সবকিছু— আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি— তোমরা বন্ধ করে দেবে।’

ঐতিহাসিক সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু যে নির্দেশনাগুলো দিয়েছিলেন, পরবর্তী সময়ে ঠিক সেই নির্দেশনা মেনেই দেশ পরিচালিত হতে থাকে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ আজ তার অধিকার চায়।’ সেই অধিকার আদায় করে নিতে, মুক্তির সংগ্রাম চালিয়ে যেতে ৭ মার্চের ভাষণে নির্দেশনা দিয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধু। আপামর জনতা সেই নির্দেশনা বুকে নিয়ে, মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে আরও শাণিত করে ঘরে ফিরে গেল দুর্গ করে তুলে শত্রুর মোকাবিলা করতে।

বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীনতার উদাত্ত আহ্বান ছাড়ছেন মঞ্চ থেকে, তখন মঞ্চে উপবিষ্ট ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ছাত্রলীগের নেতা আ স ম আবদুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আবদুল কুদ্দুস মাখন এবং আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবকের প্রধান আবদুর রাজ্জাক। বঙ্গবন্ধুর ভাষণের মুহূর্তে মুহূর্তে তারা জনসমুদ্রের সামনে ছুঁড়ে দিচ্ছিলেন স্লোগান, জনতার মুখে সেসব স্লোগান ছড়িয়ে পড়ে রেসকোর্স থেকে গোটা বাংলায়। সেদিন মঞ্চে আরও উপস্থিত ছিলেন তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, এ এইচ এম কামরুজ্জামানসহ আরও অনেকে।

ধর্মীয় চিন্তা, সাম্প্রদায়িক মানসিকতা ও দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে গঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে স্থান হয় পূর্ব-পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করে যে বাঙালি জাতি, সে জাতি বুঝে গিয়েছিল, পাকিস্তানের সঙ্গে তার থাকা হবে না। ২৩ বছর ধরেই তাই চলছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্দোলন। সেই আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিসত্ত্বা, জাতীয়তাবোধ ও জাতিরাষ্ট্র গঠনের যে ভিত রচিত হয়, তারই চূড়ান্ত পর্যায়ে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর ছাত্র-কৃষক-শ্রমিকসহ সর্বস্তরের বাঙালি স্বাধীনতা অর্জনের জন্য মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে।

বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে আনে বাঙালি জাতি। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে জন্ম নেয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আর সেই চূড়ান্ত সংগ্রামের সূচনালগ্ন ছিল ৭ মার্চের ভাষণ। তাই ৭ মার্চের ভাষণ এক রাজনৈতিক মহাকাব্য, স্বাধীনতার অনন্য দলিল। সে কারণেই ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর ইউনেস্কো তাদের বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ নেয় এই ভাষণকে।

জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীর আয়োজন মুজিববর্ষের শেষের দিকে জাতীয় জীবনে ঐতিহাসিক এই দিবসটি নানা কর্মসূচিতে পালন করবে জাতি। দিবসটি উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানও দিবসটি উদযাপন করবে।

দিবসটি ঘিরে আওয়ামী লীগের কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সোমবার ভোর ৬টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু ভবন ও দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ৮টায় বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন। এছাড়াও, এদিন সকাল ১১ টা ৩০ মিনিটে ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হবে আলোচনা সভা। এতে সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বক্তব্য দেবেন। আওয়ামী লীগের সকল শাখা কেন্দ্রীয় কর্মসূচির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কর্মসূচি গ্রহণ করে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ স্মরণ করবে।

সারাবাংলা/এনআর/পিটিএম

ঐতিহাসিক ৭ মার্চ রাজনীতির মহাকাব্য

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর