Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জীবিত নির্মল নাকি মৃত বেলাল—কে ধর্ষক প্রমাণ হবে আদালতে

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৭ মার্চ ২০২২ ১৮:১৭

চট্টগ্রাম ব্যুরো: দুই বছর আগে চট্টগ্রাম নগরীর আকবর শাহ থানা এলাকায় পাঁচ বছরের এক শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। শিশুর অভিযোগের ভিত্তিতে স্থানীয়রা নির্মল আইচ নামে এক ব্যক্তিকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করেছিল। কিন্তু তদন্তে নেমে আকবর শাহ থানা পুলিশ ও পরবর্তীতে নগর গোয়েন্দা পুলিশ নির্মলের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা না পেয়ে তাকে বাদ দিয়ে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। উভয় প্রতিবেদনে ধর্ষক হিসেবে দায়ী করা হয় বেলাল হোসেন দফাদার নামে একজনকে, যিনি ঘটনার দুই মাস পর পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যায়।

তবে আদালত উভয় তদন্ত প্রতিবেদন নাকচ করে আসামি নির্মলের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ গ্রহণ করেছেন। বিচার শুরুর জন্য আগামী ১৪ মে আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানির সময় নির্ধারণ করেছেন চট্টগ্রামের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৪ এর বিচারক জামিউল হায়দার।

ট্রাইব্যুনালের পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট নিখিল কুমার নাথ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঘটনার পর আক্রান্ত শিশুটি নিজেই আসামি চিনিয়ে দিয়েছিল। সে হিসেবে তার পরিবারের সদস্যরা স্থানীয়দের নিয়ে নির্মলকে আটক করে পুলিশের কাছে দিয়েছিল। এরপর আদালতে ২২ ধারার জবানবন্দিতেও শিশুটি নির্মলকে দায়ী করেছে। এরপরও থানা এবং ডিবি তদন্ত করে যে প্রতিবেদন দাখিল করেছে সেটা আমাদের কাছে প্রভাবিত মনে হয়েছে। বাদিপক্ষও নারাজি দিয়েছে। আমরাও আদালতে বিষয়টি তুলে ধরেছি। আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গ্রহণ করেছেন। এখন আদালতেই প্রমাণ হবে নির্মল ধর্ষণ করেছিল নাকি করেনি অথবা বেলাল করেছিল কি না সেটা।’

মামলার নথিপত্র অনুযায়ী, ২০২০ সালের ৪ মে দুপুর ২টায় নগরীর আকবর শাহ থানার ফারুক চৌধুরীর মাঠে খেলছিল স্থানীয় বাসিন্দা পাঁচ বছরের এক শিশু। নির্মল আইচও একই এলাকার বাসিন্দা। শিশুর পরিবারে নির্মলের যাতায়াত ছিল এবং তাকে নাতনি হিসেবে সম্বোধন করত। ঘটনার দিন দুপুরে শ্যাম্পু কিনে দেওয়ার কথা বলে নির্মল ওই শিশুকে খেলার মাঠ থেকে ডেকে নিয়ে যায়। পরে তাকে পার্শ্ববর্তী একটি পাহাড়ে নিয়ে ধর্ষণ করে। বাসায় ফিরে শিশুটি তার বাবা-মাকে ঘটনা খুলে বলে। এরপর পরিবারের সদস্য ও স্থানীয়রা মিলে নির্মলকে আটক করে পুলিশের হাতে দেয়।

৭ মে শিশুটি আদালতে ২২ ধারায় জবানবন্দি দেয়। এ ঘটনায় শিশুটির বাবার দায়ের করা মামলার তদন্তভার পান আকবর শাহ থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) বিকাশ চন্দ্র শীল। ২৯ সেপ্টেম্বর তিনি আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। এতে বলা হয়, নির্মলের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত বেলাল হোসেন দফাদার।

এ প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে মামলার বাদি নারাজি আবেদন দাখিল করলে ২০২০ সালের ২৭ অক্টোবর আদালত নগর গোয়েন্দা পুলিশকে (ডিবি) অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন। তদন্তের দায়িত্ব পান প্রথমে ডিবি পশ্চিম জোনের পরিদর্শক জাহেদুল কবীর। তিনি ২০২১ সালের ১২ জানুয়ারি সিরাজ মিয়া ও মিনারুল নামে স্থানীয় দু’জনের ১৬১ ধারার জবানবন্দি গ্রহণ করেন, যারা নির্মলকে দায়ী করেন।

কিন্তু জাহেদুল কবীর বদলি হয়ে গেলে তদন্তভার পড়ে ডিবি পরিদর্শক প্রিটন সরকারের ওপর। তিনি ২০২১ সালের ২৩ নভেম্বর আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। এতেও বলা হয়—নির্মলের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি। ধর্ষণের ঘটনায় জড়িত বেলাল হোসেন দফাদার। এ প্রতিবেদনের বিরুদ্ধেও নারাজি দেন মামলার বাদি।

সোমবার (৭ মার্চ) দ্বিতীয় নারাজি প্রতিবেদনের ওপর আদালতে অধিকতর শুনানি হয়। শুনানি শেষে আদালত প্রতিবেদনটি নাকচ করে দিয়ে সরাসরি নির্মলের বিরুদ্ধে অভিযোগ গ্রহণ করেন। যেহেতু গ্রেফতারের একবছর পর জামিন পেয়েছেন নির্মল, আদালত তার জামিন বাতিল করেননি বলে জানিয়েছেন অ্যাডভোকেট নিখিল কুমার নাথ।

কে এই বেলাল হোসেন দফাদার ?

বেলাল হোসেন দফাদার (৩৯) ২০২০ সালের ২২ জুলাই নগরীর বায়েজিদ বোস্তামি থানা পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান। সেসময় পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ‘সিরিয়াল শিশু ধর্ষক’ বেলাল চট্টগ্রামের রসু খাঁ হিসেবে পরিচিত ছিল।

২০২০ সালে মাত্র ছয় মাসে বায়েজিদ বোস্তামি এলাকায় ৫, আকবর শাহ এলাকায় ২ ও খুলশী এলাকায় এক শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের আট শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। অনুসন্ধানে এর সঙ্গে বেলালের সম্পৃক্ততা পেয়ে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।

বেলাল বন্দুকযুদ্ধে নিহতের পর নগর পুলিশের বায়েজিদ বোস্তামি জোনের তৎকালীন সহকারি কমিশনার (এসি) পরিত্রাণ তালুকদার জানিয়েছিলেন, প্রতিটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে একই কায়দায়। চকলেটের লোভ দেখিয়ে, টাকার বিনিময়ে লাকড়ি সংগ্রহ করে দেওয়ার প্রলোভনে সিএনজি অটোরিকশায় তুলে পাহাড়ে নিয়ে ধর্ষণ করে ছেড়ে দেওয়া হতো। ধর্ষণ শেষে আলামত নষ্ট করতে গোসল করানো হতো। শিশুরা কান্না করলে ছুরি দিয়ে ভয় দেখানো হতো।

এ নিয়ে এলাকায় ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টির পর স্থানীয়দর বরাতেই পুলিশ বেলাল দফাদারের নাম জানতে পেরেছিল। পুলিশ এ-ও জানতে পারে, ২০১৬ সালে বায়েজিদ এলাকায় এক শিশুকে ধর্ষণের জন্য অটোরিকশায় তুলে নিয়ে যাবার সময় জনতা তাকে ধরে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছিল। প্রায় তিন বছর জেল খেটে বেরিয়ে আবারও এলাকায় ফিরে বেলাল একই অপরাধ শুরু করেছিল।

যা বললেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা

পাঁচ বছরের শিশু ধর্ষণের দুই তদন্তকারী কর্মকর্তারই অভিন্ন দাবি, আকবর শাহ থানায় দুই শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে দায়ের হওয়া দুটি ঘটনায়ই বেলাল জড়িত ছিল, যার মধ্যে একটি ওই ফারুক চৌধুরীর মাঠ থেকে তুলে নেওয়া ওই শিশু।

জানতে চাইলে এসআই বিকাশ চন্দ্র শীল সারাবাংলাকে বলেন, ‘নির্মলের বয়স ৭২ বছর। ভালো করে হাঁটতেও পারে না। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, আসামি অটোরিকশা চালায়। ৭২ বছর বয়সী নির্মলের অটোরিকশা চালানোর কোনো সত্যতা আমি পাইনি। বরং স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা বিভিন্ন তথ্যউপাত্তে আমি বেলালের সম্পৃক্ততা পাই। কিন্তু বেলাল তো ঘটনার দুই মাস পর ক্রসফায়ারে মারা যায়। সেজন্য আমি চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করি।’

ডিবি পরিদর্শক প্রিটন সরকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের কাছে তদন্তের আদেশ আসার পর আমরা ডিএনএ পরীক্ষা করাই। কিন্তু ডিএনএ নির্মলের সঙ্গে মেলেনি। স্থানীয়দের সাক্ষ্যেও নির্মলের সম্পৃক্ততার তথ্য আসেনি। বেলালের বিষয়ে তথ্য পেয়েছি। বেলাল তখন বায়েজিদ, আকবর শাহ, খুলশী মিলে একই কায়দায় আটটি শিশুকে ধর্ষণ করেছিল। এই আট শিশুর একটি ছিল ওই পাঁচ বছরের শিশুটি। বাকি সাত শিশুকে যে কায়দায় ধর্ষণ করা হয়েছে, তাকেও একই কায়দায় করা হয়েছে। তদন্তে যা পেয়েছি সেটা উল্লেখ করে আদালতে প্রতিবেদন দিয়েছিলাম।’

সারাবাংলা/আরডি/এসএসএ

জীবিত নির্মল মৃত বেলাল


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর